জন্মনিবন্ধন নিয়ে এক আদিবাসীর অভিজ্ঞতা
Published: 22nd, February 2025 GMT
ময়মনসিংহের দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে সবুজে মোড়া ভূমি, সেখানেই বাস করেন লিওন রিছিল। গারো জনগোষ্ঠীর সদস্য। তাঁর সম্প্রদায়ের সামগ্রিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য– নাগরিক নিবন্ধন সেবা, বিশেষত জন্ম ও মৃত্যু সনদ পাওয়ার লড়াই।
লিওনের জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত ব্যক্তিগত। তিনি বলেন, ‘‘আমার নাম ‘লিওন’ থেকে ইংরেজি বানানে হয়ে গেছে ‘লায়ন’।’’ এক রকম ম্লান হাসি দিয়ে জানান, এ সামান্য ভুল অনেকটা প্রতীকী। এটি বাংলাদেশের গারো জনগোষ্ঠীসহ অন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি হওয়া বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা ও প্রতিবন্ধকতার চিত্র তুলে ধরে।
লিওনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস (সিভিআরভিএস) ব্যবস্থার গুরুতর সমস্যাগুলো তুলে ধরে। গারো জনগোষ্ঠীসহ অন্য নৃগোষ্ঠী সাধারণত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে, যেখানে নাগরিক সেবা অনেকটা সীমিত। জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ে প্রায়ই সরকারি স্বীকৃতি পায় না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকে না। ভাষাগত সমস্যার কারণে নামের ভুল বানান বা অন্যান্য ভুল হয়, যা ব্যক্তির জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
লিওন বলেন, ‘আমাদের জন্য এটি শুধু একটি অসুবিধার বিষয় নয়। নামের বানান ভুল বা সনদের অভাব আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো অধিকার, এমনকি আত্মপরিচয় থেকে বঞ্চিত করে।’ লিওনের নিজের নামই এর উদাহরণ। একটি ছোট ভুল, যেখানে ‘ই’ হয়ে গেছে ‘আই’; তাঁর নাম ‘লিওন’ থেকে ‘লায়ন’-এ রূপান্তরিত করেছে। এ ধরনের ভুল কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি নয়; এটি সেই ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতার প্রতীক, যা মানুষকে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে।
গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে সিভিআরভিএস ব্যবস্থার বিষয়ে সচেতনতার অভাব আরেকটি গুরুতর সমস্যা। অনেকেই জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের গুরুত্ব বোঝেন না বা এই প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন করতে হয় তা জানেন না। লিওন বলেন, ‘আমাদের গ্রামে বেশির ভাগ শিশুর জন্ম বাড়িতে হয়, হাসপাতালে নয়। এতে স্বাস্থ্যকর্মী বা হাসপাতাল থেকে জন্মসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমাদের এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার জন্য কেউ আসে না।’
লিওন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কথাও তুলে ধরেন, ‘‘ইউনিয়ন পরিষদ, যাদের এ সেবাগুলো সহজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত বা জটিল করে তোলে। তারা আমাদের বলেন, ‘আজ আসুন, কাল আসুন’; এভাবেই চলতে থাকে।’’ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাব সমস্যাকে আরও তীব্র করে তোলে। হতাশ হয়ে অনেকে নিবন্ধনের চেষ্টা ছেড়ে দেন। ফলে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো অলিপিবদ্ধ থেকে যায়।
গারো জনগোষ্ঠীর জন্য মৃত্যু নিবন্ধনের বিষয়টিও একইরকম সংকটপূর্ণ। লিওনের পরিবারেই সম্প্রতি চারজন আত্মীয় মারা গেছেন। তাদের কারও মৃত্যু নিবন্ধিত হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘আমার জানা মতে, আমাদের বংশের কেউ কখনও মৃত্যু নিবন্ধন করেনি।’ সাংস্কৃতিক এবং বাস্তবিক বাধাগুলোর কারণে এ প্রক্রিয়াটিকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় তাদের কাছে। যদিও এটি উত্তরাধিকার, স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান এবং নীতি প্রণয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লিওনের বিশ্বাস, সমাধান রয়েছে কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে। সরকারি দপ্তরগুলোয় বিশেষত সিভিআরভিএস সেবায় আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো ভাষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা কমাতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, ‘যদি আমাদের সম্প্রদায়ের একজন করে প্রতিনিধি এ অফিসগুলোয় কাজ করত, তারা আমাদের সমস্যাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারত এবং সে অনুযায়ী সাহায্য করতে উদ্যোগী হতো।’
সচেতনতা বৃদ্ধিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য এলাকার জনগণকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের গুরুত্ব বোঝানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে এই জ্ঞানঘাটতি কমানো সম্ভব। কর্মশালা, কমিউনিটি মিটিং এবং মোবাইল নিবন্ধন ইউনিট কার্যক্রম এসব সেবা আরও সহজলভ্য করতে পারে।
লিওনের গল্প শুধু একজন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের চ্যালেঞ্জের কথা নয়। এটি বাংলাদেশের সিভিআরভিএস ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। সে অনুযায়ী জনগণের বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে জরুরি নাগরিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
লিওনের লড়াই এখনও চলছে– শুধু তাঁর নামের সঠিক বানান পুনরুদ্ধার করার জন্যই নয়। বরং তাঁর সম্প্রদায়ের প্রত্যেক সদস্যের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। তিনি গর্বিত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা গারো, আমাদের এই পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের অধিকারও।’ v
লেখক: সিনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার, নারী মৈত্রী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ র ব যবস থ আম দ র ন বন ধ র জন য সমস য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
করিডোরের জন্য দু’দেশের সম্মতি লাগবে: জাতিসংঘ
রাখাইন রাজ্যের বেসামরিক নাগরিকের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠাতে করিডোরের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্মতি প্রয়োজন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
ঢাকার জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় সমকালকে এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশে জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা।
জাতিসংঘ অন্য অংশীদারকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন জোরদার করবে। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে যে কোনো মানবিক সহায়তা বা সরবরাহের জন্য প্রথমে দুই সরকারের মধ্যে সম্মতি প্রয়োজন। সীমান্ত অতিক্রম করে সহায়তা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর অনুমতি নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটি ছাড়া জাতিসংঘের সরাসরি ভূমিকা সীমিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত রোববার এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোরের ব্যাপারে সম্মত। কারণ এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’
এ খবর চাউর হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নের শঙ্কা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সরকার কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তথাকথিত মানবিক করিডোর স্থাপন নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা হয়নি বলে দাবি করছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
গত অক্টোবরে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে ১২ পাতার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে রাখাইনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়। রাখাইনের পণ্য প্রবেশের জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সীমান্ত বন্ধ রয়েছে, আয়ের কোনো উৎস নেই। ভয়াবহ মূল্যস্থিতি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে ধস, জরুরি সেবা এবং সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা করছে জাতিসংঘ।