ময়মনসিংহের দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে সবুজে মোড়া ভূমি, সেখানেই বাস করেন লিওন রিছিল। গারো জনগোষ্ঠীর সদস্য। তাঁর সম্প্রদায়ের সামগ্রিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য– নাগরিক নিবন্ধন সেবা, বিশেষত জন্ম ও মৃত্যু সনদ পাওয়ার লড়াই।
লিওনের জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত ব্যক্তিগত। তিনি বলেন, ‘‘আমার নাম ‘লিওন’ থেকে ইংরেজি বানানে হয়ে গেছে ‘লায়ন’।’’ এক রকম ম্লান হাসি দিয়ে জানান, এ সামান্য ভুল অনেকটা প্রতীকী। এটি বাংলাদেশের গারো জনগোষ্ঠীসহ অন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি হওয়া বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা ও প্রতিবন্ধকতার চিত্র তুলে ধরে।
লিওনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস (সিভিআরভিএস) ব্যবস্থার গুরুতর সমস্যাগুলো তুলে ধরে। গারো জনগোষ্ঠীসহ অন্য নৃগোষ্ঠী সাধারণত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে, যেখানে নাগরিক সেবা অনেকটা সীমিত। জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ে প্রায়ই সরকারি স্বীকৃতি পায় না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকে না। ভাষাগত সমস্যার কারণে নামের ভুল বানান বা অন্যান্য ভুল হয়, যা ব্যক্তির জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
লিওন বলেন, ‘আমাদের জন্য এটি শুধু একটি অসুবিধার বিষয় নয়। নামের বানান ভুল বা সনদের অভাব আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো অধিকার, এমনকি আত্মপরিচয় থেকে বঞ্চিত করে।’ লিওনের নিজের নামই এর উদাহরণ। একটি ছোট ভুল, যেখানে ‘ই’ হয়ে গেছে ‘আই’; তাঁর নাম ‘লিওন’ থেকে ‘লায়ন’-এ রূপান্তরিত করেছে। এ ধরনের ভুল কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি নয়; এটি সেই ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতার প্রতীক, যা মানুষকে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে।
গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে সিভিআরভিএস ব্যবস্থার বিষয়ে সচেতনতার অভাব আরেকটি গুরুতর সমস্যা। অনেকেই জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের গুরুত্ব বোঝেন না বা এই প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন করতে হয় তা জানেন না। লিওন বলেন, ‘আমাদের গ্রামে বেশির ভাগ শিশুর জন্ম বাড়িতে হয়, হাসপাতালে নয়। এতে স্বাস্থ্যকর্মী বা হাসপাতাল থেকে জন্মসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমাদের এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার জন্য কেউ আসে না।’
লিওন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কথাও তুলে ধরেন, ‘‘ইউনিয়ন পরিষদ, যাদের এ সেবাগুলো সহজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত বা জটিল করে তোলে। তারা আমাদের বলেন, ‘আজ আসুন, কাল আসুন’; এভাবেই চলতে থাকে।’’ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাব সমস্যাকে আরও তীব্র করে তোলে। হতাশ হয়ে অনেকে নিবন্ধনের চেষ্টা ছেড়ে দেন। ফলে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো অলিপিবদ্ধ থেকে যায়।
গারো জনগোষ্ঠীর জন্য মৃত্যু নিবন্ধনের বিষয়টিও একইরকম সংকটপূর্ণ। লিওনের পরিবারেই সম্প্রতি চারজন আত্মীয় মারা গেছেন। তাদের কারও মৃত্যু নিবন্ধিত হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘আমার জানা মতে, আমাদের বংশের কেউ কখনও মৃত্যু নিবন্ধন করেনি।’ সাংস্কৃতিক এবং বাস্তবিক বাধাগুলোর কারণে এ প্রক্রিয়াটিকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় তাদের কাছে। যদিও এটি উত্তরাধিকার, স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান এবং নীতি প্রণয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লিওনের বিশ্বাস, সমাধান রয়েছে কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে। সরকারি দপ্তরগুলোয় বিশেষত সিভিআরভিএস সেবায় আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো ভাষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা কমাতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, ‘যদি আমাদের সম্প্রদায়ের একজন করে প্রতিনিধি এ অফিসগুলোয় কাজ করত, তারা আমাদের সমস্যাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারত এবং সে অনুযায়ী সাহায্য করতে উদ্যোগী হতো।’
সচেতনতা বৃদ্ধিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য এলাকার জনগণকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের গুরুত্ব বোঝানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে এই জ্ঞানঘাটতি কমানো সম্ভব। কর্মশালা, কমিউনিটি মিটিং এবং মোবাইল নিবন্ধন ইউনিট কার্যক্রম এসব সেবা আরও সহজলভ্য করতে পারে।
লিওনের গল্প শুধু একজন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের চ্যালেঞ্জের কথা নয়। এটি বাংলাদেশের সিভিআরভিএস ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। সে অনুযায়ী জনগণের বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে জরুরি নাগরিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
লিওনের লড়াই এখনও চলছে– শুধু তাঁর নামের সঠিক বানান পুনরুদ্ধার করার জন্যই নয়। বরং তাঁর সম্প্রদায়ের প্রত্যেক সদস্যের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। তিনি গর্বিত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা গারো, আমাদের এই পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের অধিকারও।’ v

লেখক: সিনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার, নারী মৈত্রী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ র ব যবস থ আম দ র ন বন ধ র জন য সমস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সত্য মিথ্যা যাচাই না করে শেয়ার করবেন না, মেসেজটা তৃণমূলে ছড়িয়ে দিন: সিইসি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, 'আমাদের একটা অভ্যাস হয়ে গেছে একটা নেতিবাচক সংবাদ দেখলেই যাচাই-বাছাই না করে শেয়ার করে দেওয়া হয়। অত্যন্ত ভিত্তিহীন সংবাদও আমরা শেয়ার করে দেই।'

সিইসি বলেন, 'দয়া করে সত্য মিথ্যা যাচাই না করে শেয়ার করবেন না। এই মেসেজটা তৃণমূলে ছড়িয়ে দিন। তথ্যটা যেন আগে যাচাই করে তারপরে শেয়ার করেন।'

আজ সোমবার রাজধানীর ভাটারায় আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নে (এজিবি) এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন সিইসি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ভুয়া সংবাদের প্রচার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপপ্রয়োগ রোধে করণীয় সম্পর্কে তিনি এসব কথা বলেন।

থানা আনসার কোম্পানি/প্লাটুন সদস্যদের আনসার মৌলিক প্রশিক্ষণের (৪র্থ ধাপ) সমাপনী উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিইসি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো সংবাদ দেখা মাত্রই নাগরিকদের যাচাইবাছাই করতে আহ্বান জানান সিইসি। নিশ্চিত হওয়ার আগে শেয়ার না করতে বলেন তিনি।

জাতীয় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে আনসার ভিডিপির ভূমিকাকে মূল শক্তি বলে উল্লেখ করেন সিইসি। তিনি বলেন, 'এনারাই অধিক সংখ্যায় নিয়োজিত থাকেন। এবং আমাদের হিসেব করতে গেলে প্রথম এদেরকেই হিসেব করতে হয় যে, কতজন আনসার ভিডিপি সদস্য আমরা মোতায়েন করতে পারব। মূল কাজটা আঞ্জাম (সম্পাদন) দিতে হয় কিন্তু আনসার এবং ভিডিপির সদস্যদের।'

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ। নির্বাচনকালীন জনগণের নিরাপত্তা, ভোট কেন্দ্রের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণে আনসার বাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি। নির্বাচনে দেশজুড়ে প্রায় ৬ লাখ আনসার ও ভিডিপি সদস্য দায়িত্বপালন করবেন বলেন মহাপরিচালক।

অনুষ্ঠানে মহড়ায় ঢাকা মহানগর আনসারের চারটি জোনের অধীন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩২০ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্য অংশ নেন।  আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের সদস্যরা টহল, দায়িত্ব বণ্টন ও জরুরি প্রতিক্রিয়া অনুশীলনে অংশ নেন।

মহড়ায় ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জামাদি নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া, ভোটারদের শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ভোট প্রদানে সহায়তা, জাল ভোট প্রতিরোধ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা এবং সেনা, বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশের সঙ্গে দ্রুত সমন্বয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন জোনের অধিনায়ক এবং প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ