Samakal:
2025-11-03@07:32:43 GMT

ঋণের টাকায় ‘দুবাই সাম্রাজ্য’

Published: 3rd, March 2025 GMT

ঋণের টাকায় ‘দুবাই সাম্রাজ্য’

কোনো রকম পুঁজি খাটাননি। শুধু কইয়ের তেলে কই ভেজেছেন আশিকুর রহমান লস্কর। বন্দরনগরী চট্টলার এই ‘অখ্যাত’ ব্যবসায়ীর কাছে জালিয়াতি যেন এক শিল্প। চাতুরী করে দেশের ব্যাংক থেকে নেওয়া বিপুল অঙ্কের ঋণের টাকা কৌশলে পাচার করে তা দিয়ে বিদেশে গড়েছেন বাহারি সম্পদ। বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহর দুবাইয়ে কিনেছেন বিলাসবহুল ৬২টি অ্যাপার্টমেন্ট ও ভিলা। দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্পত্তির মালিক এখন তিনি। শুধু দুবাইয়ে নয়, কানাডায়ও আছে তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশের বাইরে তিনি এসব সম্পত্তি কেনেন।

পুরোনো জাহাজ আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের চাঞ্চল্যকর এই অপরাধ উদ্ঘাটিত হয়েছে সমকালের অনুসন্ধানে। পাচারের ডলার প্রথম নেওয়া হয় অর্থ পাচারের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, পানামা, লাইবেরিয়া এবং সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানিতে। এসব দেশ করের স্বর্গ হিসেবে পরিচিতি। এর পর এসব দেশ থেকে স্থানান্তর হয় দুবাই ও কানাডায়। কয়েক বছর ধরে তিনি যে অর্থ পাচার করেছেন, তা হয়েছে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের কয়েক কর্মকর্তার যোগসাজশে। ঋণখেলাপির মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে বছর দুয়েক আগে ওই ব্যবসায়ী কানাডায় পালিয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিফোরএডিএস) এক প্রতিবেদনে দুবাইয়ে লস্করের সম্পদের বিবরণ রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, কানাডায় পালানোর আগে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েক বছরে আশিক লস্কর পাচার করেছেন প্রায় ১৯০ মিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার কোটি টাকা। সুদে-আসলে বিভিন্ন ব্যাংকে এখন তাঁর নামে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কাছে বন্ধক রাখা সম্পত্তির দর ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার বেশি হবে না। 

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ২০১৮ সালে লস্করের অর্থ পাচার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠিয়েছিল। দুদক সূত্র জানিয়েছে, বিএফআইইউর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, লস্করের মালিকানাধীন মাহিন এন্টারপ্রাইজের ১৫টি এবং গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের ছয়টি পুরোনো জাহাজ আমদানির এলসির ক্ষেত্রে এবি ব্যাংক যথাযথ নিয়মকানুন অনুসরণ করেনি। মাহিন এন্টারপ্রাইজ কয়েক বছর ধরে আমদানির কোনো দায় পরিশোধ করেনি। অথচ এলসির বিপরীতে বারবার বিদেশে অর্থ পাঠানো হয়েছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ও শাখা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে এ ক্ষেত্রে অর্থ পাচার হয়ে থাকতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়। 
ঋণের বেশির ভাগ অর্থ বিদেশে পাচার হওয়ার এ রকম বিস্তর প্রমাণ থাকলেও বিস্ময়করভাবে সরকারি কোনো তদন্ত তালিকায় লস্করের নাম নেই। আর্থিক খাতের বড় অপরাধী ধরতে এবং পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ডিসেম্বর থেকে সরকারি একাধিক সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ১১টি অনুসন্ধান দল কাজ শুরু করলেও তাদের তালিকায় লস্কর নেই।

কে এই লস্কর
আশিকুর রহমান লস্করের বাবা আতিউর রহমান লস্কর ছিলেন মেরিন সার্ভেয়ার। তাদের আদি বাড়ি ফরিদপুর হলেও দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের খুলশীতে স্থায়ীভাবে বাস করে আসছিলেন। আতিউর লস্কর চাকরি থেকে অবসরের পর ২০০০ সালে ভোগ্যপণ্য ব্যবসা শুরু করেন। তাতে সুবিধা করতে না পেরে ২০০৬ সালে আসেন জাহাজভাঙা ব্যবসায়।

কিছুদিন পর ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর ছেলে আশিকুর রহমান লস্কর। তিনি ব্যবসার দায়িত্ব নিয়ে মনোযোগ দেন ভুয়া নথিপত্রের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের দিকে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রভাবশালীদের সঙ্গে তাঁর ছিল বিশেষ সখ্য। এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ফয়সাল মোরশেদ খান তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তিকে সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি এই পরিচয়কে সব সময় কাজে লাগিয়েছেন লস্কর। তিনি ২০১৩ সালে কার্যক্রমে আসা মেঘনা ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন। ব্যাংকটিতে তাঁর শেয়ার ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। ঋণখেলাপির মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে ২০২৩ সালের ৫ মার্চ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। পরদিন ৬ মার্চ চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে দুবাই হয়ে তিনি কানাডা পালিয়ে যান। আগে থেকেই তাঁর পরিবার টরন্টোতে বাস করত। সম্প্রতি তাঁর ভাই ইনামুর রহমান লস্কর মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে বিদেশ চলে গেছেন।

আমদানির আড়ালে যেভাবে পাচার 
সমকাল লস্করের ওই সময়কার আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছে, নিজের নামের দুই প্রতিষ্ঠান মাহিন এন্টারপ্রাইজ ও এআরএল শিপ ব্রেকিং এবং বেনামি প্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নামে জাহাজ আমদানির জন্য এক যুগ ধরে এবি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় তিনি ৩৯টি ঋণপত্র খোলেন। ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল সময়ে প্রথম পর্যায়ে ১৮টি পুরোনো জাহাজের এলসি খোলা হয়। এর মধ্যে ১৩টির দর ঠিকমতো পরিশোধ করেন। নানা সমস্যা দেখিয়ে পাঁচটি জাহাজের ৪ কোটি ৪ লাখ ডলার পরিশোধ না করায় ব্যাংক তাঁর নামে ৩২৭ কোটি টাকার ‘ফোর্স ঋণ’ (গ্রাহক নির্দিষ্ট সময়ে দায় পরিশোধ না করলে ব্যাংক তা পরিশোধ করে গ্রাহকের নামে জোর করে ঋণ সৃষ্টি করা) দেখিয়ে বিদেশি ব্যাংকের দায় সমন্বয় করে। 

২০১৩ থেকে ২০১৭ সালে মাহিন এন্টারপ্রাইজের নামে ১৩ কোটি ২৯ লাখ ডলারের আরও ১৫টি এলসি খোলা হয়। সব এলসি হয় এক বছর পর পরিশোধের শর্তে। এক বছর পার হলেও লস্কর অর্থ সমন্বয় করেননি। ফলে আরও ৯৮১ কোটি টাকার ফোর্স ঋণ সৃষ্টি করে ব্যাংক। এ ছাড়া তাঁর বেনামি কোম্পানি গ্র্যান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজের নামে ছয়টি এলসির বিপরীতে বিদেশে পাঠানো হয় ৫ কোটি ২৮ লাখ ডলার। এর বিপরীতে এবি ব্যাংকে ৪৬৪ কোটি টাকার ‘ফোর্স ঋণ’ সৃষ্টি হয়। 

এভাবে একজন ঋণখেলাপিকে দিনের পর দিন এলসি খুলতে দিয়ে এবি ব্যাংক আমদানির দায় পরিশোধ করে গেছে। একই সঙ্গে যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জাহাজ আমদানি হয়েছে, তাদের ক্রেডিট রেটিং বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। উল্টো নিয়ম ভেঙে লস্করকে বিদেশি ব্যাংকের ঋণে গ্যারান্টি দিয়েছে এবি ব্যাংক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নেভিস আইল্যান্ডে নিবন্ধিত অ্যাঞ্জেলিনা শিপিং ইনকরপোরেটেড থেকে মাহিন এন্টারপ্রাইজ এবং গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নামে তিনটি জাহাজ আমদানি দেখানো হয়। ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল কোম্পানিটির নিবন্ধন হয়, যার ঠিকানা চার্লসটাউনের ৫৫৬, মেইন স্ট্রিট। জাহাজ আমদানির বৈশ্বিক তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ভোলজা’র ডেটাবেজ অনুযায়ী, অ্যাঞ্জেলিনা শিপিং থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ মাত্র ছয়টি জাহাজ আমদানি হয়েছে। কিন্তু সেখানে লস্করের কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। চার্লসটাউনের ৭০০ মিটার দূরে অবস্থিত গভর্নমেন্ট রোডে নিবন্ধিত ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল। এখান থেকে গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নামে দুটি জাহাজের আমদানি দেখানো হয়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট আইসিআইজের তৈরি প্রতিবেদন প্যারাডাইস পেপারসে অর্থ পাচারে সহায়তাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠান দুটির নাম ছিল। একইভাবে নেভিসে নিবন্ধিত ম্যাক্সিমাস শিপিং, প্রিয়াঙ্কা শিপিং, ভিনসেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ইনস, ভাইটাল ভেঞ্চার, সিকারিও গ্রুপ, এমএস ওয়ারন মেরিটাইম এবং বাউন্টি শিপিং থেকে লস্করের কোম্পানির নামে একটি করে জাহাজ আমদানি দেখানো হয়।

আরেক করের স্বর্গ লাইবেরিয়ার ট্রাস্ট কোম্পানি অটাম হারভেস্ট মেরিটাইম থেকে আমদানি দেখানো হয় তিনটি জাহাজ। লাইবেরিয়ার মনোরোভিয়ায় এই কোম্পানির নিবন্ধন হয় ২০১২ সালের ১৩ জুলাই। বিদেশি কোম্পানির ক্রেডিট রিপোর্ট সরবরাহকারী এজেন্সি ‘ডি অ্যান্ড বি’ বারবার চেষ্টা করেও ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোনো তথ্য পায়নি। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটির রেটিং দেওয়া হয় ‘শূন্য’। বিএফআইইউর তদন্ত প্রতিবেদনে এ রকম ট্রাস্ট কোম্পানি থেকে আদৌ জাহাজ আমদানি হয়েছে কিনা, প্রশ্ন তোলা হয়। একই অঞ্চলে নিবন্ধিত রুথ এন্টারপ্রাইজ এবং সেয়াশর ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন থেকে আনা হয় একটি করে জাহাজ। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ সিঙ্গাপুরে সোমাপ ইন্টারন্যাশনাল থেকে আমদানি দেখানো হয় ১ কোটি ৮৪ লাখ ডলার দামের একটি জাহাজ।
বিদেশি ব্যাংকের ঋণের গ্যারান্টির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই নিয়ম ভেঙে এইচএসবিসি ব্যাংক নিউইয়র্ক, সোনালী ব্যাংক ইউকে, হাবিব ব্যাংক ইউকে এবং ইউনাইটেড ন্যাশনাল ব্যাংক ইউকে থেকে লস্করের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৩৬০ দিন মেয়াদে সাড়ে ৩ কোটি ডলার ঋণের গ্যারান্টি দেয় এবি ব্যাংক। এই ঋণও শোধ না করায় বাধ্য হয়ে এবি ব্যাংক আরও ২৭৩ কোটি টাকার ফোর্স ঋণ সৃষ্টি করে। দুদকের ২০২১ সালের এক অনুসন্ধানে লস্করের পাশাপাশি তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরীকে এ ঘটনায় দায়ী করা হয়।
এবি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ২০১৩ ও ২০১৪ সালের শাখা ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী সমকালকে বলেন, দুদক কয়েক দফা অনুসন্ধান করে অর্থ পাচারের সত্যতা পায়নি। এ কারণে দুদক তাঁকে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে। কোনো কিছু থাকলে তো মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হতো। আর যা কিছু হয়েছে প্রধান কার্যালয়ের জ্ঞাতসারেই হয়েছে।

এবি ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, লস্কর ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান চৌধুরীসহ প্রধান কার্যালয়ের কয়েকজন সহায়তা পান। এবি ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগে দু’জনই মেয়াদ শেষের আগে পদত্যাগে বাধ্য হন।
এবি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক সমকালকে বলেন, তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মাহিন এন্টারপ্রাইজের ঋণ ছিল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। পুরোনো জাহাজ আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়টি জানতেন কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একবার এ বিষয়ে একটা প্রতিবেদন এলে তার জবাব দেওয়া হয়েছিল। ব্যবসায়ী হিসেবে লস্করকে চিনলেও তাঁর কাছ থেকে কোনো সুবিধা তিনি নেননি।
 
মধ্যরাতে এলসি খোলার সুযোগ
লস্করকে অবৈধ ঋণ সুবিধা দিতে নানা অনিয়মের পথে হেঁটেছে এবি ব্যাংক। ঋণখেলাপি, বেনামি ঋণের সুনির্দিষ্ট তথ্য উদ্ঘাটন ও বিএফআইইউর পরিদর্শনে অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়ার পরও ২০২০ সালে ফের লস্করকে নতুন করে ঋণ দেওয়া হয়। ব্যাংকিং রীতিনীতি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা না মেনে ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাত ১টা পর্যন্ত শাখা খোলা রেখে ১৩৪ কোটি টাকার এলসি খোলা হয়। খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়ার ঝুঁকি বিবেচনায় শাখার নিয়মিত কর্মকর্তারা এই এলসি খুলতে রাজি হননি। যে কারণে বাধ্যতামূলক ছুটিতে থাকা এক কর্মকর্তা এবং অন্য শাখা থেকে দু’জনকে ডেপুটেশনে এনে রাতে ওই এলসি খোলা হয়। 

কর্মচারীর নামে ৬৭০ কোটি টাকার ঋণ
গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নামে ছয়টি জাহাজ আমদানি দেখিয়ে বের করা হয়েছে ৬৭০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কোনো কাগজপত্রে আশিকুর রহমান লস্করের নাম নেই। এই প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুবিধাভোগী যে লস্কর, তা নিশ্চিত হয়েছে সমকাল। যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নিবন্ধন নেওয়া হয় মো.

মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাঁর স্ত্রী সাদিকা আফরিন দীপ্তির নামে। মাহিন এন্টারপ্রাইজের সাবেক কর্মচারী এই মোয়াজ্জেম। এ ছাড়া তিনি লস্করের ফুফাতো ভাই। 

এবি ব্যাংকের লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাহিন এন্টারপ্রাইজ এবং গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন করতেন মো. শাহাদাত হোসেন নামে এক ব্যক্তি। আবার মাহিন এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাব থেকে গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের ঋণ পরিশোধেরও নজির পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নামে পুরোনো জাহাজ আমদানির জন্য এবি ব্যাংকে এলসি খোলা হয়। এলসির শর্ত অনুযায়ী অগ্রিম ৩৪ কোটি টাকা জমা দিতে হয়েছিল, এই টাকা জমা দেন লস্কর। তবে এই টাকাও নিজস্ব উৎস থেকে আসেনি। আইএফআইসি ব্যাংক থেকে মাহিন এন্টারপ্রাইজের নামে ‘ইমার্জেন্সি বিজনেস নিড’ নামে ঋণ নেন তিনি। এর পর মাহিন এন্টারপ্রাইজের হিসাব থেকে চারটি চেকের বিপরীতে গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের অনুকূলে তা জমা করা হয়।
মাহিন এন্টারপ্রাইজ এবং গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের ব্যাংক হিসাবের জমা-উত্তোলনকারী শাহাদাত হোসেন সমকালকে বলেন, ‘আমি মাহিন এন্টারপ্রাইজে হিসাব বিভাগে চাকরি করতাম। গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের আলাদা লোক ছিল, তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাংকে যেতাম। এ কারণে আমার নাম এসেছে।’

মোয়াজ্জেম ফরিদপুরের চর কমলাপুরের মোশারফ হোসেন ও মুজিবুন নেছার সন্তান। কোম্পানি নিবন্ধনে মোয়াজ্জেমের বর্তমান ঠিকানা লেখা চট্রগ্রামের পাহাড়তলীর পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনির ডব্লিউ/ই-১৪ নম্বর বাসা। গত ২৩ জানুয়ারি ওই ঠিকানায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ওই বাসার নিরাপত্তা প্রহরী আরিফ হোসেন জানান, এই নামে বাসায় কেউ থাকেন না। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রে বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ আছে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার দারোগার হাটের ১৭৪ নম্বর বাসা। ওই বাসায়ও মোয়াজ্জেম নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। ফরিদপুরের গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়েও তাঁর হদিস মেলেনি। এরই মধ্যে তিনিও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
মো. আজম উল্লাহ দীর্ঘদিন লস্করের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘মোয়াজ্জেম হলেন লস্কর স্যারের ফুপাতো ভাই। তিনিও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে শুনেছি।’

দুবাইয়ে ৬২ সম্পত্তি
যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (সিফোরএডিএস) দুবাই ভূমি বিভাগের রেকর্ড ও কিছু ইউটিলিটি কোম্পানির তথ্য বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীর একটি তালিকা তৈরি করে। ২০২০ ও ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা তালিকাটি ২০২৪ সালের মে মাসে অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) ‘দুবাই আনলকড’ নামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ৪৬১ বাংলাদেশির নামে দুবাইয়ে ৯২৯টি সম্পত্তির তথ্য উঠে আসে। তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশিদের মধ্যে দুবাইয়ে সর্বোচ্চ ১৪২টি সম্পত্তির মালিকানা সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের পরিবারের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬২টি সম্পত্তি আশিকুর রহমান লস্করের। এর মধ্যে তাঁর নিজের নামে রয়েছে ৩০টি এবং স্ত্রী রুবাইয়া লস্করের নামে ৩২টি। দুবাইয়ের এসব অ্যাপার্টমেন্টের আনুমানিক বাজারদর অন্তত ৭১৫ কোটি টাকা।

দুবাইয়ের কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ পাম জুমেইরাহতে লস্করের অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে ১৫টি। এর মধ্যে নিজ নামে ছয়টি এবং স্ত্রীর নামে ৯টি। দেশটির শীর্ষস্থানীয় রিয়েল এস্টেট অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘লাক্সহ্যাবিটাট’র ১৯ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, পাম জুমেইরাহতে আকারভেদে প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টের দাম ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা। দুবাইয়ের পাঁচতারকা হোটেল ‘কেম্পিনস্কি’তে পাঁচটি অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে লস্করের নিজ নামে দুটি ও স্ত্রীর নামে তিনটি। হোটেলটির ওয়েবসাইটে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দু’জনের জন্য একটি কক্ষের ভাড়া দেখানো হয় ১৩ হাজার ৫৯৯ দিরহাম, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪ লাখ ৬২ হাজার টাকার বেশি। দুবাইয়ের ব্যয়বহুল আবাসন প্রকল্প ওয়াদি আল সাফা-৭। সেখানে তিনি কিনেছেন ৪২টি ভিলা। প্রতিটি ভিলার গড় দাম ১৫ থেকে ১৮ লাখ দিরহাম।

কিছু সম্পত্তি এরই মধ্যে অন্যের নামে স্থানান্তরের তথ্য পেয়েছে সমকাল। দেশটির ভূমি বিভাগের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, আল খুদরাউই টাওয়ারের তৃতীয় তলায় ১ হাজার ৪৪০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টটি ২০২২ সাল পর্যন্ত ছিল লস্করের নামে। এটি তাঁর ছেলে মিহরান রহমান লস্করের নামে স্থানান্তর করা হয়েছে। দেশটির সম্পত্তি বেচাকেনার ওয়েবসাইট ‘প্রপার্টি ফাইন্ডার’-এ গত ১৮ ফেব্রুয়ারি চারটি ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন ছিল। সেই অনুযায়ী এই সম্পত্তির বাজারদর প্রায় ১৬ কোটি টাকা।

দুবাই আনলকড প্রতিবেদনে বলা হয়, শিথিল নীতিমালার কারণে দুবাইয়ের আবাসন খাত অপরাধী, পলাতক আসামি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা ব্যক্তিদের আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে। অবৈধ অর্থ লুকিয়ে রাখার বড় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে দুবাই। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ পাচার রোধ ও অপরাধীদের অর্থায়ন দমনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে যে কয়েকটি দেশের দিকে বেশি নজর দিয়েছে, এর অন্যতম দুবাই ও কানাডা।

কানাডায় বিলাসবহুল বাড়ি
বিশ্বের আরেক ব্যয়বহুল শহর কানাডার টরন্টোতে আশিকুর রহমান লস্করের আছে তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট। যার বাজারদর অন্তত ২০০ কোটি টাকা। টরন্টোতে ‘আশিকুর লস্কর’ নামে জনৈক ব্যক্তির আরও চারটি সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশটির নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘টেরানেট এক্সপ্রেস’ থেকে গত ১৮ ডিসেম্বর এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। নির্ধারিত ফি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি থেকে দেশটির সম্পত্তির মালিকানার তথ্য পাওয়া যায়। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে যে ব্যক্তির সম্পদের তথ্য খোঁজা হচ্ছে তাঁর নাম, জন্মতারিখসহ কিছু তথ্য সরবরাহ করতে হয়। টেরানেট এক্সপ্রেস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় লস্করের সম্পত্তির মধ্যে টরন্টো স্ট্যান্ডার্ড কনডেনিয়াম প্ল্যান ২০৩০, ইউনিট ৩, লেভেল ১০-এ রয়েছে একটি অ্যাপার্টমেন্ট। একই কনডেনিয়ামে লেভেল ‘ই’, ইউনিট ১১০ এবং ১৫৬ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টের মালিকও তিনি।

টেরানেটের সার্চে একই এলাকায় আশিকুর লস্কর নামে জনৈক ব্যক্তির চারটি সম্পত্তির মধ্যে টরন্টো স্ট্যান্ডার্ড কনডেনিয়ামের প্ল্যান ২০৩০, ইউনিট ৬, লেভেল ৪১-এ রয়েছে একটি। এ ছাড়া টরন্টো স্ট্যান্ডার্ড কনডেনিয়াম প্ল্যান ২২০৪ এর ইউনিট ৩২৯, লেভেল ‘বি’ এই নামে নিবন্ধিত। একই কনডেনিয়ামের ইউনিট ৮০-এর লেভেল ‘বি’ এবং ইউনিট ৮১-এর লেভেল ‘বি’ আশিকুর লস্কর নামে নিবন্ধিত।
বৈশ্বিক অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফাইন্যান্স আনকাভার্ডের একজন কর্মী সমকালকে বলেন, সম্পদের তথ্য গোপন করতে বিভিন্ন দেশে নামের অংশবিশেষ ব্যবহার করে কোম্পানি নিবন্ধন নেওয়ার রেওয়াজ আছে।

কোন ব্যাংকে কত টাকার খেলাপি
লস্করের কাছে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা পাবে এবি ব্যাংক। এর মধ্যে মাহিন এন্টারপ্রাইজরে ঋণ ১ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এআরএল শিপ ব্রেকিংয়ের নামে ৮ কোটি টাকা এবং বেনামি কোম্পানি গ্র্যান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজের নামে ৪৬৪ কোটি টাকা। অন্য ব্যাংকগুলো এসব প্রতিষ্ঠানকে চলতি মূলধন ঋণ দিয়েছে। লস্কর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯১ কোটি টাকার খেলাপি ঢাকা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায়। পর্যায়ক্রমে ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় ১৭৫ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ১০২ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের লালদীঘি শাখায় ১০০ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ৩৪ কোটি টাকা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের পাহাড়তলী শাখায় ২৯ কোটি টাকার খেলাপি রয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স ফাইন্যান্সের কাছে খেলাপি ৭২ কোটি টাকা। ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ১৯ কোটি ও মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্টে ১২ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি রয়েছে।

লস্করের কাছে এবি ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ থাকলেও রহস্যজনকভাবে পাওনা আদায়ে ব্যাংকটির নড়াচড়া কম। ঢাকা ব্যাংক ও ফিনিক্স ফাইন্যান্স এরই মধ্যে আদালতের মাধ্যমে কিছু সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছে। এবি ব্যাংক শুধু গত ১১ জানুয়ারি বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির জন্য দুটি পত্রিকায় নিলাম নোটিশ দিয়েও কোনো সাড়া পায়নি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চারটি ইউনিয়নের সাগরপার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ১৮০টি শিপইয়ার্ড। এর মধ্যে সোনাইছড়িতে তিনটি শিপইয়ার্ড রয়েছে লস্করের। গত ২২ জানুয়ারি এসব শিপইয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ভেতরে নানা জাতের সবজি চাষ হচ্ছে। সোনাইছড়ির শীতলপুরে ৩০২ দশমিক ৫০ শতক জমির ওপর গড়ে ওঠা মাহিন এন্টারপ্রাইজের ইয়ার্ডটি ঢাকা ব্যাংক দখল পাওয়ার পর পাহারার জন্য সাতজন নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দিয়েছে। নিরাপত্তা প্রহরী ইব্রাহীম খলিল ও জালাল আহমেদ জানান, ব্যাংক এই সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করলেও উপযুক্ত ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না।
সোনাইছড়ির বক্তারপাড়ায় মাহিন এন্টারপ্রাইজের আরেকটি ইয়ার্ডের নিরাপত্তা প্রহরী রাশেদ একই রকম তথ্য দিয়ে জানান, দীর্ঘদিন তিনি বেতন-ভাতা পান না। এখন কার কাছে গেটের চাবি বুঝিয়ে দেবেন, সেই লোকও পাচ্ছেন না। সোনাইছড়ির জোড়ামতলার গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নিরাপত্তা প্রহরী আরিফ হোসেন বলেন, আমার ৯ মাসের বেতন বকেয়া। ইয়ার্ডের জমিতে কলা, শিম, বেগুন চাষের পাশাপাশি ধারদেনা করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছি।

তিন শিপইয়ার্ডের বাইরে চট্টগ্রামের অভিজাত আবাসিক এলাকা খুলশী হিলসের ৫ নম্বর রোডের ২০৫ নম্বরে একই বাউন্ডারিতে সাড়ে ১৫ শতক জমির ওপর রয়েছে লস্করের তিনটি বাড়ি। আদালতের নির্দেশে একটি বাড়ির দখল পেয়েছে ঢাকা ব্যাংক। আর খুলশী হিলসের ২ নম্বর রোডের ৬১/সি নম্বর বাড়িটি তাঁর বাবা আতিউর রহমান লস্করের। এটি বন্ধক রয়েছে এবি ব্যাংকের কাছে। তাদের এসব বাড়ি দেখে রাখার জন্য একজন করে নিরাপত্তা প্রহরী আছেন। বিপুল পাওনার বিপরীতে ঝামেলার এসব সম্পদ কেউ কিনতে রাজি হচ্ছে না। তিন ইয়ার্ড ও বাড়ি বিক্রি করে সব মিলিয়ে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

এবি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক দিদারুল আলম সমকালকে বলেন, ‘ঋণ আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। যতটুকু জানি, গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের ঋণের সুবিধাভোগী মাহিন ট্রেডার্সের আশিকুর রহমান লস্কর। তাদের সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ করতে পারছি না। গ্র্যান্ড ট্রেডিংয়ের নিবন্ধন যার নামে, সেই মোয়াজ্জেম হোসেন ও সাদিকা আফরিন দীপ্তিকেও আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।’
ঢাকা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর লস্করের খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর চেষ্টা করছেন। দেশীয় সম্পদ বিক্রি করে যতটা সম্ভব ঋণ আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সমকালকে বলেন, বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার প্রতিরোধে প্রতিটি এলসি খোলার আগে ভালোভাবে যাচাই করার নির্দেশনা রয়েছে। প্রকৃত দাম যাচাই, পণ্য ঠিকমতো আসছে কিনা– এসব দেখা এবং ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্যাংকের দায়িত্ব। পুরোনো জাহাজ আমদানির আড়ালে কেউ মানি লন্ডারিং করে থাকলে গ্রাহকের পাশাপাশি অবশ্যই ওই ব্যাংকেরও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

দুদকের ক্লিন সনদ
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৩টি কোম্পানি বৈধভাবে দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পেয়েছে। এ তালিকায় লস্কর ও তাঁর পরিবারের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের লঙ্ঘন করেই প্রতিটি ডলার নিয়েছেন বিদেশে।
পুরোনো জাহাজ আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের তথ্য উঠে আসে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০১৮ সালের এক পরিদর্শনে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানিয়েছে, লস্করের অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুই দফা প্রতিবেদন দেয় বিএফআইইউ। সুনির্দিষ্টভাবে সেখানে অর্থ পাচারের তথ্য ছিল। ২০২১ সালে দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অনুসন্ধান করে এর সত্যতা মেলে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেন তিনি। তবে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা না করে ২০২২ সালে লস্করকে ক্লিন সনদ দেয় দুদক।

লস্করের কারণেই ধুঁকছে জাহাজভাঙা শিল্প
পরিবেশ বিপর্যয় ও শ্রমিকের নানা ঝুঁকির পরও কর্মসংস্থানের জন্য জাহাজভাঙা শিল্পকে দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) তথ্য অনুযায়ী, জাহাজভাঙা শিল্পে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সম্ভাবনার পরও কয়েকজনের উচ্চ খেলাপির কারণে ব্যাংকগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অর্থায়ন সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে জাহাজভাঙা কমেছে।

জাহাজভাঙা শিল্পের পর্যবেক্ষক শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে জাহাজভাঙার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩২টি। গত ছয় বছরের মধ্যে যা সর্বনিম্ন। ব্যাংকগুলো মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পেছনে দায়ীদের প্রধান বিবেচনা করা হয় আশিকুর রহমান লস্করকে। জাহাজভাঙা শিল্পের ২০ হাজার ৯২ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা খেলাপি। এই খেলাপির ৬৯ শতাংশই লস্করের।

বক্তব্য দেননি লস্কর
বক্তব্যের জন্য আশিকুর রহমান লস্করকে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে ই-মেইল ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। উচ্চ আদালতে লস্করের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে রিট মামলা পরিচালনা করেছেন এ রকম দু’জন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত জানা না থাকায় কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
চট্রগ্রামের অর্থঋণ আদালতে লস্করের মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনজীবী রাজীব দাশ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সমকালকে বলেন, জাহাজভাঙা শিল্পে যেমন মুনাফা, সে রকম লোকসান। এর মধ্যে করোনা মহামারি, হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে লস্কর ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়েন। এসব কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লস্কর দেশে ফিরতে চান বলেই অর্থঋণ আদালতের মামলা পরিচালনা করছেন। আর দুবাই ও কানাডায় বিপুল সম্পত্তির কোনো তথ্য আমার জানা নেই। এই আইনজীবী লস্করের বক্তব্য সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য কয়েক দফা সময় নিলেও শেষ পর্যন্ত তা দেননি।

সার্বিক বিষয়ে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে সমকাল। গতকাল রাতে তাঁর মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তিনি সাড়া দেননি। 

 


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ফ ইন য ন স র ব যবস থ ২০২২ স ল ২০১৮ স ল কর মকর ত র ব পর ত ন র জন য ফ র স ঋণ ন বন ধ ত স ন ইছড় ঋণখ ল প ব যবস য় সরবর হ ক র ঋণ র ঋণ র কর র স র হক র এলস র সরক র অপর ধ ক বছর সমক ল প রহর টরন ট ইউন ট র এসব র একট

এছাড়াও পড়ুন:

স্বামী-সন্তানের সঙ্গে বান্দরবানে বেড়াতে যাচ্ছিলেন, মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে বাসের চাকায় মৃত্যু নারীর

চট্টগ্রামের পটিয়ায় মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ার পর বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। আজ সোমবার সকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত নারীর নাম ফজিলাতুন নেসা (২৮)। তিনি মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার মহেশপুর গ্রামের আলিমুজ্জামান সুজনের স্ত্রী।

পুলিশ জানায়, স্বামীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে গতকাল রোববার চট্টগ্রামে বেড়াতে আসেন ফজিলাতুন নেসা। তাঁদের ছয় বছর বয়সী সন্তানও সঙ্গে ছিল। গতকাল চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটের একটি বাসায় তাঁরা রাত্রিযাপন করেন। সকালে সেখান থেকে মোটরসাইকেলে করে তাঁরা বান্দরবানের উদ্দেশে রওনা দেন। আলিমুজ্জামান মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন এবং তাঁর পেছনে ছয় বছর বয়সী সন্তান হুমায়ের হাম্মাদ, এরপর ফজিলাতুন নেসা বসে ছিলেন।

সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়ার নয়াহাট এলাকায় পৌঁছায় মোটরসাইকেলটি। সেখানে সামনে থাকা একটি লেগুনা হঠাৎ সড়কে থেমে গেলে তাৎক্ষণিক মোটরসাইকেলটির ব্রেক কষেন আলিমুজ্জামান। এ সময় ফজিলাতুননেসা মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়েন। এর পরপরই পেছন থেকে একটি যাত্রীবাহী বাস ফজিলাতুন নেসাকে পিষ্ট করে। তাঁকে উদ্ধার করে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

গতকাল রাতে চট্টগ্রাম নগরের যে বাসাটিতে ফজিলাতুন নেসা ছিলেন, সেটি তাঁর স্বামী আলিমুজ্জামানের বন্ধু রবিউল ইসলামের। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রবিউল ইসলামের বোন আশরিফা আহমদ ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফজিলাতুন নেসার স্বামী নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির কনিষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক। পরিবার নিয়ে পাহাড় দেখতে বান্দরবানে বেড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি। বেড়াতে যাওয়ার পথেই স্বামী-সন্তানের সামনে দুর্ঘটনায় তাঁর প্রাণহানি হয়েছে।

পটিয়া ক্রসিং হাইওয়ে থানার সার্জেন্ট ওয়াসিম আরাফাত দুর্ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিহত নারীর লাশ আইনি–প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। লেগুনা ও বাসের চালককে আটক করা সম্ভব হয়নি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ