আজ খতমে তারাবিহতে পবিত্র কোরআনের সুরা নিসার ৮৮ থেকে সুরা মায়িদার ৮২ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করা হবে। পঞ্চম পারার দ্বিতীয়ার্ধ এবং পুরো ষষ্ঠ পারা—মোট দেড় পারা। এই অংশে মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক, মানুষের অধঃপতনের কারণ, বন্ধু নির্বাচনে নীতিমালা, মুনাফিকদের কূটচাল, মানুষ হত্যা, জিহাদ, ঈসা (আ.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র, কুফর ও শিরক, সমাজসংস্কারের নানা দিক, চুরির শাস্তি, ইহুদিরা যে কারণে অভিশপ্ত, হিজরত ও হাবিল-কাবিলের কাহিনিসহ নানা বিষয়ের কথা রয়েছে।
সফর অবস্থায় নামাজ আদায়ের পদ্ধতি
সুরা নিসার ১০১ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সফর অবস্থায় কীভাবে নামাজ আদায় করতে হবে, সে পদ্ধতি বলে দিয়েছেন। কেউ অবস্থানস্থল থেকে ৪৮ মাইল, তথা ৭৮ কিলোমিটারের দূরত্বে সফর করলে মুসাফির হয়। গন্তব্যে পৌঁছার পর ১৫ দিনের কম সময় অবস্থানের ইচ্ছা থাকলে মুসাফির থাকবে। এর বেশি সময় থাকলে মুসাফির থাকবে না। মুসাফির অবস্থায় চার রাকাত ফরজ নামাজ দুই রাকাত পড়বে। একে শরিয়তের পরিভাষায় কসর বলে। সুন্নত নামাজে কসর নেই অর্থাৎ সুন্নত নামাজ কম পড়া যায় না।
আরও পড়ুনসুরা নমলে হজরত সোলায়মান (আ.) ও রানি বিলকিসের ঘটনা১২ মার্চ ২০২৪
ইহুদিকে বাঁচাতে কোরআনের আয়াত
নবীজি (সা.) তখন মদিনায়। কিছুদিন হলো তিনি হিজরত করে এসেছেন। সাধারণ মুসলমানরা দারিদ্র্য ও অনাহারে দিনাতিপাত করছে। তাদের খাদ্য বলতে যব ও গমের আটা আর খেজুর। মদিনায় তেমন একটা পাওয়া যেত না এসব। সিরিয়া থেকে চালান এলে লোকেরা কিনে রাখতেন। বিশেষ প্রয়োজনে কেউ যত্ন করে তুলে রাখতেন। একবার হজরত রেফাআহ (রা.) কিছু গমের আটা কিনে বস্তায় রেখে দিয়েছিলেন। বস্তার মধ্যে কিছু অস্ত্রশস্ত্র রেখেছিলেন। আনসার গোত্রের বনি উবাইরাকের এক মুসলিম সেই বস্তা থেকে একটি বর্ম চুরি করল। তার নাম ছিল তমা ইবনে উবাইরাক। তমা বর্মের সঙ্গে লেগে থাকা আটা ছড়াতে ছড়াতে নিজ ঘর পর্যন্ত গেল। এরপর সেটি জায়েদ ইবনে সামিন নামক এক ইহুদির কাছে লুকিয়ে রাখল। তমার কাছে বর্মের অনুসন্ধান চাইলে সে বর্ম নেয়নি মর্মে আল্লাহর নামে শপথ করল। রেফাআহ বলল, আমি তার ঘরে আটার চিহ্ন দেখেছি। কিন্তু তমা ইবনে উবাইরাক শপথ করায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। সবাই মিলে আটার চিহ্নের পথ ধরে ওই ইহুদির ঘর পর্যন্ত পৌঁছাল। বর্মটি পেল সেখানে। ইহুদি বলল, তমা ইবনে উবাইরাক আমাকে এটি দিয়েছে। হজরত কাতাদাহ (রা.) নবীজির (সা.) কাছে এসে এটি যে বনি উবাইরাক ঘটিয়েছে, ব্যাপারটি জানালেন। তমা ইবনে উবাইরাকের এলাকাবাসী বনু জুফারের লোকেরা রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে কাতাদাহ ও রেফাআহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বললেন, চোরাই মাল ইহুদির ঘরে পাওয়া গেছে। আটার নিদর্শন ও ঘরে বর্ম পাওয়ার কারণে নবীজি (সা.) ইহুদিকে শাস্তি দেওয়ার মনস্থ করেন। তখন সুরা নিসার ১০৫ আয়াত নাজিল হয়, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনার ওপর অবতীর্ণ করেছি সত্য কিতাব; যেন আল্লাহ আপনাকে যা হৃদয়ঙ্গম করিয়েছেন তার মাধ্যমে মানুষের ভেতর ন্যায়বিচার করেন। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে বিতর্ককারী হবেন না।’
আরও পড়ুনবাদশাহ ও এক বুদ্ধিমান বালকের ঘটনা১১ মার্চ ২০২৪দাম্পত্যজীবনে আপস
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কটি স্বামী-স্ত্রীর। কখনো কোনো সম্পর্কে নানা জটিলতা তৈরি হয়। সংসার টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কোনোভাবেই যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধন আর ভালো না হয়, তাহলে তারা চাইলে আপসে আলাদা হতে পারবে। কখনো দেখা যায়, স্বামী স্ত্রীকে প্রাপ্য সম্মান দেয় না, অধিকার বঞ্চিত করে রাখে, নির্যাতন করে; তবে স্ত্রীকে ছেড়ে দেয় না। এ অবস্থায় স্ত্রী সমঝোতা ও বোঝাপড়ায় আপস করতে না পারলে বিচ্ছেদ করার অধিকার তার রয়েছে। ইসলাম স্ত্রীকে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য করে না; বরং ইসলাম সংসার আলাদা করারই অনুমোদন দেয়। (সুরা নিসা, আয়াত: ১২৮)
দস্তরখানের নামে সুরার নাম
পবিত্র কোরআনের পঞ্চম সুরা মায়িদা, মদিনায় অবতীর্ণ। এ সুরার আয়াত সংখ্যা ১২০। মায়িদা অর্থ দস্তরখান। এ সুরায় দস্তরখান–সম্পর্কিত একটি ঘটনা থাকায় এ নামকরণ করা হয়েছে। প্রত্যেক নবী-রাসুলদের সঙ্গে বিশ্বাসী একদল সঙ্গী থাকত। তাঁরা নবী-রাসুলদের কথা মেনে চলত। মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গীদের সাহাবি বলা হতো। ঈসা (আ.)-এর সঙ্গীদের বলা হতো হাওয়ারি। হাওয়ারিরা ঈসা (আ.)-এর কাছে আসমান থেকে খাবারের দস্তরখান পাঠানোর আবেদন করেছিল। ঈসা (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহ খাদ্যভর্তি খাঞ্চা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাজিল হয় সুরা মায়িদার ১১৫ আয়াত।
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘অবতীর্ণের হিসেবে সুরা মায়িদা শেষ সুরা। এ সুরায় হালাল-হারামের অনেক বিধিবিধান নাজিল হয়েছে এবং তিনটি কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৫, ৫৪৭) এ সুরার ৩ আয়াতটি বিদায় হজের প্রাক্কালে নাজিল হয়েছিল। এ আয়াতের মাধ্যমে ইসলামকে পরিপূর্ণ দ্বীন বা জীবনবিধান হিসেবে মানুষের জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে।
আরও পড়ুনসুরা বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াত আয়াতুল কুরসি নামে পরিচিত২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩যেসব খাদ্য হারাম
আল্লাহ তাআলা যা হারাম করেছেন, চিরকাল তা হারাম থাকবে। মানুষের কল্যাণে তিনি হালালের পরিমাণই বেশি রেখেছেন। এ সুরার ৩ আয়াতে তিনি একটি হারাম খাবারের তালিকা দিয়েছেন। যেমন মৃত প্রাণী, (প্রবাহিত) রক্ত, শূকরের মাংস, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে বলি দেওয়া পশু, যে প্রাণী গলা টিপে বা শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে, আঘাতে নিহত প্রাণী, উঁচু স্থান থেকে পড়ে মৃত, সংঘর্ষে মৃত, যে পশুকে হিংস্র জন্তু খেয়েছে—তবে এসব প্রাণী জীবিত জবাই করতে পারলে খাওয়া যাবে। মূর্তিপূজার বেদির ওপর বলি দেওয়া প্রাণী ও জুয়ার তির দিয়ে ভাগ্য নির্ণয় করা খাদ্য।
হাবিল-কাবিলের কাহিনি
হজরত আদম ও হাওয়া (আ.)–এর দুই ছেলে ছিল কাবিল ও হাবিল। কাবিল ছিল বড়। হাবিল ছিল ছোট। আদম-হাওয়া দম্পতির আকলিমা নামের একটি মেয়ে ছিল। নিয়ম অনুযায়ী হাবিলের সঙ্গে আকলিমার বিয়ের ব্যাপারটি সামনে আসে। কাবিল তা মেনে নিতে পারেনি। গোল বাঁধল। আল্লাহর আদেশে তারা উৎসর্গ নিবেদন করেছিল। হাবিল আল্লাহভীরু হওয়ার ফলে তারটি কবুল হলো। কাবিল উদ্যত হয়ে তাকে হত্যা করল। এ সুরার ২৭ আয়াতে আল্লাহ মুহাম্মদ (সা.)-কে উম্মতদের এ ঘটনা শোনানোর আদেশ দেন।
রায়হান রাশেদ : লেখক ও আলেম
আরও পড়ুনএকজন রোজাদারের রোজনামচা কেমন হতে পারে১৩ মার্চ ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন জ ল হয় অবস থ য় র আয় ত আল ল হ
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬০ দিন পর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা, উৎসবের আমেজ
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) দীর্ঘ ১৬০ দিন পর একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে টানা বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসেছেন। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে বইছে উৎসবের আমেজ।
সকালে কুয়েট ক্যাম্পাসে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস। ছাতা মাথায় দল বেঁধে ছুটছেন ক্লাসরুমের দিকে। কখনো এক ছাতার নিচে দু-তিনজন। কারও সঙ্গে অভিভাবকও এসেছেন। সকাল নয়টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি শিক্ষাবর্ষের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী ক্লাসে যোগ দেন। নতুন উপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে শ্রেণি কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করেন।
ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইসিই) বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী দীপ্ত বলেন, ‘আমাদের প্রায় এক সেমিস্টার নষ্ট হয়ে গেছে। এই সময়টা খুব অস্বস্তিতে কেটেছে। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে, তবে এখন আবার ক্লাস শুরু হওয়াটা ইতিবাচক দিক। আমরা আশাবাদী।’ একই ব্যাচের শিক্ষার্থী আম্মান বলেন, ‘অনেক দিন জীবনটা থেমে ছিল। আজকের দিনটা বিশেষ মনে হচ্ছে। ঠিক যেন স্কুলজীবনের প্রথম দিনের মতো। সব হতাশা কাটিয়ে আমরা অনেকটা নতুন করে শুরু করছি।’
হুমায়ুন কবির নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ে। পাঁচ মাস ধরে ক্লাস বন্ধ থাকায় ও মানসিকভাবে খুব চাপের মধ্যে ছিল। একসময় অসুস্থও হয়ে পড়ে। কুয়েটে এমন পরিস্থিতি আগে দেখিনি। কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে হয়তো আগেই খুলে যেত। তারপরও এখন অন্তত খুলেছে, এটা বড় স্বস্তি।’
কুয়েটের ছাত্র পরিচালক আবদুল্লাহ ইলিয়াস আক্তার বলেন, আজ থেকে কুয়েটে ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে এখনো সব শিক্ষার্থী আসেননি। যাঁদের কেবল ক্লাস রয়েছে, তাঁরা অংশ নিচ্ছেন। যাঁদের পরীক্ষা ছিল, তাঁরা প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় চেয়েছে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন হবে ১৪ আগস্ট, ক্লাস শুরু ১৭ আগস্ট।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ওই রাতেই তৎকালীন উপাচার্য ও কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠে। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২৬ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদ ও সহ-উপাচার্য অধ্যাপক শরিফুল আলমকে অব্যাহতি দেয়। ১ মে চুয়েটের অধ্যাপক হজরত আলীকে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার দাবিতে ৪ মে থেকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষক সমিতি। এরপর কোনো শিক্ষকই ক্লাসে ফেরেননি। শিক্ষক সমিতির বিরোধিতার মুখে হজরত আলী দায়িত্ব পালন করতে না পেরে ২২ মে পদত্যাগ করেন।
এরপর ১০ জুন নতুন উপাচার্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার কুয়েটের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী। পরদিন শুক্রবার তিনি খুলনায় এসে দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় আন্দোলন কর্মসূচি তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার ক্লাস শুরুর নোটিশ জারি করা হয়।