আইসক্রিম বিক্রেতা থেকে ‘কমলা কবিরাজ’ জুনাইদ
Published: 7th, March 2025 GMT
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার চাপরতলা ইউনিয়নের কালিউতা গ্রামে প্রতিদিন ভিড় করছেন শত শত মানুষ। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা নারী, পুরুষ ও শিশুরা অপেক্ষায় রহস্যময় এক কবিরাজের। কারও হাতে বোতল, কারও হাতে কমলা, আবার কেউ এনেছেন গাছের ঢাল ও মুড়ি। কিছুক্ষণ পর বদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ‘কমলা কবিরাজ’।
কবিরাজের হাতে থাকা পচা কমলা ও গাছের ঢাল নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঝাড়ফুক শুরু করেন। রোগীরাও সমস্বরে আল্লাহু আকবার বলে স্লোগান দেন। রোগীদের হাতে থাকা জিনিসে ফুঁ দিয়ে তান্ত্রিক আচার পালন করেন। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই অপচিকিৎসার আসর।
কমলা কবিরাজের আসল নাম জুনাইদ আহমেদ। তিনি উপজেলার চাপরতলা ইউনিয়নের কালিউতা গ্রামের বাতেন মিয়ার ছেলে। একসময় তিনি আইসক্রিম বিক্রি করতেন। বছরখানেক আগে তিনি দাবি করেন, গভীর রাতে এক ‘জিন’ তাকে কবিরাজি চিকিৎসার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে। এর পর তিনি পেটের ব্যথার রোগীদের কমলা দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। কোন এক কাকতালীয় কারণে কেউ সুস্থ হয়ে গেলে তা দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পেড়। ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় বাড়তে তাকে, আর ‘কমলা কবিরাজ’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন জুনাইদ।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, প্রথম দিকে গ্রামের লোকজন এই কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলেও পরে কবিরাজ প্রতি মাসে তিনটি মসজিদে মোটা অঙ্কের টাকা দান শুরু করলে আপত্তি বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ইউনিয়নের কিছু প্রভবশালী ব্যক্তি এই প্রতারণার অংশীদার বলে অভিযোগ রয়েছে।
কমলা কবিরাজের আসর ঘিরে আশপাশের এলাকায় কমলা ও নিমগাছের ঢালের চাহিদা বেড়ে গেছে। স্থানীয় দোকানিরা বাড়তি লাভে এসব বিক্রি করছেন। কবিরাজের চিকিৎসার নামে মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জনের এই প্রবণতা এখন স্পষ্ট।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, হবিগঞ্জের নুর উদ্দিন নামে এক প্যারালাইসিস রোগীকে গাছের ঢাল দিয়ে আঘাত করছেন। এরপর সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করে বলা হচ্ছে, তিনি সুস্থ হয়ে গেছেন। নুর উদ্দিন বলেন, ‘তেল মালিশ করায় একটু ভালো লাগছে। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হয়েছি কি না জানি না।’
একইভাবে লাখাই উপজেলার লুৎফা নামের এক কিশোরী এসেছেন, যিনি জানেনই না তিনি কী রোগে আক্রান্ত! কবিরাজ তার ‘জিন’-এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করবেন, এরপর কমলা পড়া ও গাছের ঢাল দিয়ে ঝাড়ফুঁক করলে তিনি ভাল হয়ে যাবেন- এমনটাই তার বিশ্বাস।
সালমা বেগম নামের এক বৃদ্ধা এসেছেন নাতনি কেয়াকে নিয়ে। কেয়া পড়াশোনায় মনোযোগী নয়, তাই কবিরাজের ‘কমলা পড়া’ নিলে সে ভালো ছাত্রী হয়ে যাবে বলে তার ধারণা। তবে প্রশ্ন করা হয়, নিজের চোখে কাউকে ভাল হতে দেখেছেন কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে বৃদ্ধা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নিজের চোখে এমন কোনো পরিবর্তন দেখিনি।’
স্থানীয় ইসলামিক চিন্তাবিদ আতাউর রহমান গিলমান জানান, ‘কুরআন-হাদিসে এমন কোন চিকিৎসার কথা নেই। এসব কবিরাজি অপচিকিৎসা ইসলামে নিষিদ্ধ এবং মানুষকে প্রতারিত করার একটি পদ্ধতিমাত্র।’
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.
চাপরতলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মনুসর মিয়া দাবি করেন, এক সময় আইসক্রিম বিক্রি করা জুনাইদ আজ কবিরাজ হিসেবে পরিচিত। অথচ তার চিকিৎসার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ধর্মীয় বা চিকিৎসাবিদদের কেউই এসব পদ্ধতির স্বীকৃতি দেন না। প্রয়োজন প্রশাসনের আরও কঠোর হস্তক্ষেপ, যাতে মানুষ অপচিকিৎসার খপ্পরে না পড়ে।’
নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খায়রুল আলম বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীনা নাসরিন জানান, ‘যদি কোনো ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ করেন, তাহলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব র হ মণব ড় য় উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
কাজের আনন্দই জীবনের সার্থকতা
জন্মদিনের অনুষ্ঠান নয়, তবে অনানুষ্ঠানিক আয়োজনটি ছিল সে উপলক্ষেই। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ ও সুবক্তা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন ছিল গত ২৫ জুলাই। তাঁর অগণিত অনুরাগীরা চেয়েছিলেন তাঁকে নিয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মিলিত হতে। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে, তারপর আর জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে কিছুতেই সম্মত হননি তিনি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ষষ্ঠতলায় কেন্দ্রের প্রাক্তনী ও তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠজন আলাপচারিতার এক ঘরোয়া আয়োজন করেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে। সেখানে তিনি বললেন, কাজের মধ্য দিয়ে জীবনে যে আনন্দ পেয়েছেন, সেটিই জীবনের সার্থকতা। এই আনন্দই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে, শক্তি জোগায়।
এ আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন। তিনি তাঁর চিরপরিচিত সরস অথচ বুদ্ধিদীপ্ত গভীর তাৎপর্যময় কথায় উত্তর দিয়েছেন। কবিতা, সাহিত্য, শিল্প থেকে শিক্ষা, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংগঠন, প্রেম–ভালোবাসা—সবকিছু উঠে আসে প্রশ্নোত্তরভিত্তিক কথোপকথনে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্যের বহু কালজয়ী লেখকের রচনা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। এক অন্তরঙ্গ প্রাণবন্ত আবহ বিরাজমান ছিল সন্ধ্যা থেকে অনেকটা রাত অবধি এই আয়োজনে।
আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় শুরুতেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কবিতা আবৃত্তি করে জানতে চান, তিনি কবিতার চর্চা করেননি কেন? জবাবে তিনি বলেন, কবি শামসুর রাহমান একবার তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর মধ্যে কবিত্বের ঘাটতি আছে। তাঁর নিজেরও সে রকম মনে হয়েছে। তারপর সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর প্রকাশ ও অনেক রকম কাজ করতে গিয়ে আর কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেন, এখন একটা কঠিন সময় যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে দেখেন, কী আশা করেন তাদের কাছে?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘তরুণেরা কী হবে, তা তরুণদের ওপরে নির্ভর করে না। সেটা নির্ভর করে আমরা তাদের কী বানাতে চাই, তার ওপর। দেখতে হবে তরুণদের গড়ার মতো আমাদের ক্ষমতা কতটা আছে। অর্থাৎ শিক্ষক কেমন হবে, তার ওপরে নির্ভর করে তাঁর ছাত্র কেমন হবে। সক্রেটিস শিক্ষক ছিলেন বলে ছাত্র প্লেটো হয়েছেন। প্লেটোর শিক্ষা পেয়ে ছাত্র অ্যারিস্টটল হতে পেরেছেন। বড়দের যদি বড়ত্ব না থাকে, তবে ছোটরা বড় হতে পারে না। দুর্ভাগ্য যে আমরা বড়রা তাদের সামনে আদর্শ দাঁড় করাতে পারিনি। ফলে এখন বড়দেরই ছোটদের পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে।’
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম জানতে চান, তিনি এত বিচিত্র ধরনের এত বিপুল কাজ করেছেন। এই প্রাণশক্তি পান কেমন করে?
উত্তর দিতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘শক্তি আসে আনন্দ থেকে। কাজ করতে পারাটাই আনন্দের। আর সব সময় আশাবাদী থাকি। আশা কখনো শেষ হয় না। আশা শেষ মানে আমি শেষ।’
আলাপচারিতায় আরও অংশ নেন দুদক চেয়ারম্যান এম এ মোমেন, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, চিকিৎসক আমজাদ হোসেন, অভিনয়শিল্পী খায়রুল আলম সবুজ, কথাশিল্পী আনিসুল হক, ছড়াকার আমিরুল ইসলাম, উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার, অভিনয়শিল্পী আফসানা মিমি, মশিউর রহমান, আলী নকী প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাক্তনী খাদিজা রহমান।