জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী তরুণ নেতাদের হাতে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তার ঘোষণাপত্রের শুরুতেই উল্লেখ করেছে, ‘২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন, ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ, ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারকে হটানোর পরও আমরা গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে—এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে পারিনি।’ বরং লাখ লাখ শহীদের রক্তের দামে কেনা যে বন্দোবস্ত, তার মধ্যে ফ্যাসিস্ট জন্ম দেওয়ার সব অনুষঙ্গই খুব ভালোভাবে বিদ্যমান ছিল।
ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমত ও প্রধানত দরকার হয় অ্যাবসলিউট কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, যা ব্রিটিশ-পাকিস্তান হয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। পাশাপাশি এই বন্দোবস্তের যে সংবিধান, তার মূলনীতিতে খুবই কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটা দলের কিংবা আরও পরিষ্কার করে বললে একটা নির্দিষ্ট ব্যক্তিতান্ত্রিক মতাদর্শ। কেন্দ্রীভূত অ্যাবসলিউট ক্ষমতা ও জাতিবাদী মতাদর্শ দুইয়ের মিশেলে ফ্যাসিবাদ কায়েমের চেষ্টা চালানো হয় একবার ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বাকশালের প্রকল্প ব্যর্থ হলেও ফ্যাসিবাদের ভ্রূণ অক্ষুণ্ন রয়ে যায়।
২০০৮ সালে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে নির্বাচনে জেতার পর ওই ভ্রূণকে ব্যবহার করেই ফ্যাসিবাদ কায়েমের নীলনকশা নিয়ে হাজির হয় শেখ হাসিনা ও তাঁর মাফিয়া গোষ্ঠী। তাদের সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে প্রথম বাধা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।
২০১১ সালে প্রথমে এক ‘জুডিশিয়াল ক্যু’র মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। তারপর ওই দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটির জোরে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ব্যবস্থাকে বাতিল করে আওয়ামী লীগ। বলা হয়, ’৭২ সালের ‘মূল’ বন্দোবস্তে ফেরত নেওয়া হয়েছে।
তারপরই একে একে আসে ২০১৪ সালের বিনা ভোট, ২০১৮ সালের রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের ডামি ভোটের নির্বাচন। ইতিমধ্যেই ধীরে ধীরে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন পোক্ত করে নেয় শেখ হাসিনার মাফিয়া গোষ্ঠী। বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রীয় খুন, গুম, ক্রসফায়ারের মচ্ছব শুরু হয়ে যায়। চলে ইতিহাসের নিকৃষ্ট গুম ও আয়নাঘরের নির্যাতন। আর এই সবকিছু করতে পারার যে প্রধানতম টুলস, সেটা ছিল সেই বাহাত্তরের বন্দোবস্ত। এ বন্দোবস্তে পাওয়া ক্ষমতাবলেই শেখ হাসিনা ও তাঁর খুনি মাফিয়া বাহিনী ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ইতিহাসের এক জঘন্যতম গণহত্যা চালায় এ দেশের গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতার ওপর।
নতুন সংবিধান তো বটেই, এমনকি বর্তমান সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখন যা-ই করা হোক না কেন, এর পরিবর্তনসমূহ স্থায়ী করতে হলে গণপরিষদ গঠনের কোনো বিকল্প নেই। যদি এই সংবিধান রেখেও দিতে হয়, তা–ও এর ফ্যাসিবাদী বন্দোবস্ত (ক্ষমতাকাঠামো ও মতাদর্শ) বিলুপ্ত করতে হলে গণপরিষদ লাগবে।হাসিনার মাফিয়া বাহিনীর চালানো গণহত্যা রুখে দিতে গিয়ে হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট ১ দফার ঘোষণায় ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ উল্লেখ করে ছাত্র-তরুণেরা। গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন জুলাই-আগস্ট মাসে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই কোটি কোটি ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসেনি। বরং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকেই গণ-অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল তারা।
এরপর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার কর্তব্য দাঁড়ায়, একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটানো এবং এর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করা।
নতুন সংবিধান তো বটেই, এমনকি বর্তমান সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখন যা-ই করা হোক না কেন, এর পরিবর্তনসমূহ স্থায়ী করতে হলে গণপরিষদ গঠনের কোনো বিকল্প নেই। যদি এই সংবিধান রেখেও দিতে হয়, তা–ও এর ফ্যাসিবাদী বন্দোবস্ত (ক্ষমতাকাঠামো ও মতাদর্শ) বিলুপ্ত করতে হলে গণপরিষদ লাগবে।
জাতীয় সংসদ দিয়ে কেবল সংবিধানের সাধারণ পরিবর্তন করা সম্ভব, কোনো মৌলিক পরিবর্তন নয়। যদিও সাধারণ সংশোধনীও সংসদের হাতে থাকা উচিত নয়। যদি গণপরিষদ গঠন না করে সংস্কার করা হয়, তাহলে আবারও ভবিষ্যতে যেকোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে পেছনে নিয়ে যেতে পারে। দেশের রাজনৈতিক পরিসরে নির্বাচনের পর রেগুলার সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে ঘষামাজার সংস্কার বা মেরামতের প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু রেগুলার সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কিছু উপরিভাগের সাধারণ পরিবর্তন করা যাবে, যেগুলো এমনকি সরকার তার নির্বাহী ক্ষমতাবলেই করতে পারে।
আরও পড়ুননতুন দলের সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে যে প্রশ্ন০৫ মার্চ ২০২৫কিন্তু নয়া বন্দোবস্ত তৈরির যে রাষ্ট্র সংস্কার, সেটা করতে হলে নির্বাহী ক্ষমতাবলে তো নয়ই, সংবিধানে সংশোধন করেও করা সম্ভব নয়। অতএব নয়া বন্দোবস্ত করতে হলে হয়তো এই সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান তৈরি করতে হবে অথবা এই সংবিধানেরই যেসব জায়গায় স্বৈরতন্ত্রের বীজ লুকিয়ে আছে, সেগুলো সরিয়ে সেখানে গণতান্ত্রিক বীজ পুনঃস্থাপন করতে হবে মানে সংবিধান সংস্কার করতে হবে। নয়া বন্দোবস্ত করতে তাই গণপরিষদের বিকল্প নেই।
ইতিমধ্যে এনসিপি তার ঘোষণাপত্রে দলের প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন এবং গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেছে। এখন প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, আমরা কি নতুন করে রাষ্ট্র বানাচ্ছি যে গণপরিষদ নির্বাচন লাগবে কিংবা ফার্স্ট রিপাবলিক কি বাতিল হয়ে গেছে যে সেকেন্ড রিপাবলিক লাগবে?
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে দুইটারই উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। অবশ্য যারা এখনো নিজেদের মনের অজান্তেই জুলাইয়ের আগে বসবাস করেন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু যাঁরা জুলাই পার করে এসেছেন, রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে, যাঁদের বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানকে হারিয়েছেন, যাঁদের আহত শরীর বাকি জীবনের জন্য বোঝা হয়ে গিয়েছে, তাঁদের কাছে এ প্রশ্নেরই হয়তো প্রয়োজন নেই। তাঁরা প্রশ্ন ছাড়াই বোঝেন, যে রিপাবলিকের প্রতিটি পয়সার জোগান দিতেন যাঁরা, তাঁদেরই পয়সায় কেনা বন্দুক দিয়ে তাঁদের সন্তানদের বুকেই গুলি চালিয়েছে এই রিপাবলিক। এই রিপাবলিকের হাত হাজারো শহীদের রক্তে রঞ্জিত খুনি হাত। একে আর বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না!
ফরিদুল হক যুগ্ম সদস্যসচিব, জাতীয় নাগরিক পার্ট (এনসিপি)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ক ন ড র প বল ক এই স ব ধ ন ছ ত র জনত র জন ত ক ব যবস থ আগস ট ত করত সরক র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
৯ ঘণ্টা ধরে শাহবাগ অবরোধ, জনভোগান্তি চরমে
জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং দ্রুত স্থায়ী বিধানে যুক্ত করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় ৯ ঘণ্টা ধরে অবরোধ করে রেখেছেন ‘জুলাই যোদ্ধারা’। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে জুলাই শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের (আহত) ব্যানারে তাঁরা এ ‘অবস্থান কর্মসূচি’ পালন করছেন।
রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ে আশপাশের সড়কগুলোতে। এসব সড়কে দিনভর ব্যাপক যানজট তৈরি হয়। ফলে বৃষ্টির মধ্যে জীবনের তাগিদে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষদের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। বাধ্য হয়ে বিকল্প পথে চলে গণপরিবহন, অনেক যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেখা গেছে হেঁটে হেঁটে। বিশেষ করে অফিসফেরত মানুষকে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
বেলা ১১টায় শাহবাগ মোড়ের সঙ্গে যুক্ত সব সড়কের মুখ আটকে দিয়ে সড়কের মাঝখানে অবস্থান নেন অবরোধকারীরা। এ সময় তাঁরা জুলাই সনদ দ্রুত বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবি জানান। অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জুলাই যোদ্ধা সংসদ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম ওই কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়। এ সময় অবরোধকারীরা ‘জুলাই নিয়ে টালবাহানা, চলবে না চলবে না’, ‘জুলাইয়ের চেতনা দিতে হবে ঘোষণা’, ‘জুলাই সনদ দিতে হবে, দিতে হবে, দিতে হবে’ স্লোগান দিতে থাকেন।
বন্ধ হয়ে পড়ে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, সায়েন্স ল্যাব ও গুলিস্তানগামী প্রধান সড়কগুলোও। ফলে সকাল থেকেই এসব এলাকায় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এসব সড়কে চলাচলকারী গণপরিবহনগুলো বিকল্প পথে চলাচল করে।
বেলা তিনটার দিকে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ–সংলগ্ন মূল সড়কে পুলিশের ব্যারিকেড ও বাঁশ ব্যবহার করে সড়ক আটকে রেখেছেন অবরোধকারীরা। শাহবাগ থানার সামনের সড়কেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন তাঁরা।
বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ষাটোর্ধ্ব নূরে আলম বলেন, ‘কেরানীগঞ্জে যাব। কোনো বাস পাচ্ছি না। রিকশায় যে কিছু দূর যাব, তারাও ভাড়া বেশি চাচ্ছে।’ একপর্যায়ে হেঁটেই রওনা দেন তিনি।
এক পথচারী ইমরান হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দুই দিন পরপর সড়ক অবরোধ হয়। এর ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের।’
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শাহবাগ থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হতে দেখা যায় মোটরবাইক আরোহীদের। শাহবাগ থানার সামনে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশাকে বাধা দিলে চালক বলেন, ‘এত দাবিদাওয়া এত দিন আছিলো কই।’ তবে গণপরিবহন আটকে দেওয়া হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যানবাহন এবং তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স শুরু থেকেই চলাচল করতে দেখা গেছে।
অবরোধকারীদের দাবি
অবরোধকারীদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে জুলাই শহীদ ও জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি; শহীদ পরিবার ও আহতদের আজীবন সম্মান; চিকিৎসা, শিক্ষা ও কল্যাণের পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করা; শহীদ পরিবার ও আহতদের প্রতি দায়িত্ব গ্রহণ করা; আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান ও কল্যাণমূলক ব্যয় রাষ্ট্রকে বহন করা; আহত ও শহীদ পরিবারের জন্য আজীবন সম্মানজনক ভাতা নিশ্চিত করা; শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য বিশেষ আইনি সুরক্ষা ও সহায়তাকেন্দ্র গঠন করা; শহীদ ও আহতদের ওপর সংগঠিত দমন-পীড়নের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচারকাজ সম্পন্ন করা এবং একটি স্বাধীন সত্য ও ন্যায় কমিশন গঠন করা।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খালিদ মনসুর বলেন, সকাল থেকেই শাহবাগে অবরোধের কারণে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। শাহবাগ থানা-পুলিশ আলোচনার মাধ্যমে অবরোধকারীদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
তবে জুলাই যোদ্ধা সংসদের মুখ্য সংগঠক মাসুদ রানা জানান, তাঁদের আন্দোলন চলছে। সনদ ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তাঁরা এখানেই থাকবেন।