মহাসড়কে দাঁড়িয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থামাতে সিগন্যাল দেয় হাইওয়ে পুলিশ। চালক অটোরিকশা থামিয়ে কৌশলে পুলিশকে তাতে উঠিয়ে ঝুলিয়ে রাখেন। ঝুলন্ত অবস্থায় অটোরিকশা চালিয়ে যান প্রায় আধা কিলোমিটার। গাজীপুরের শ্রীপুরের জৈনাবাজার এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনা ঘটে। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়। ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কী মর্মান্তিক! চালক কতটা বেপরোয়া হলে সড়ক নিরাপদ রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে গাড়িতে টেনেহিঁচড়ে এভাবে নিতে পারেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেই যদি এমন আচরণ হয়, সাধারণ যাত্রী তো কোন ছার!

গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই, চালকের লাইসেন্স নেই, যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা, বেপরোয়া গতি– সড়কে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে রক্ত, অকালে হারিয়ে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনমতে, ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত আরও বেশি। এমন নৈরাজ্য কি কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে? 
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) উদাসীনতায় প্রযুক্তিনির্ভর সুশৃঙ্খল অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবায়ও নৈরাজ্য দেখা যাচ্ছে। পুরোনো জরাজীর্ণ গাড়ি, অ্যাপে না গিয়ে খ্যাপে যাত্রী তোলা, রাস্তায় যেখানে সেখানে পার্কিং, যাত্রীর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে না চাওয়া, যাত্রীর সঙ্গে চালকের দুর্ব্যবহার, ফুটপাতে বাইক উঠিয়ে দেওয়া– এমন সব অভিযোগ জমা হচ্ছে রাইড শেয়ারিং সেবার বিরুদ্ধে। অভিযোগের বিপরীতে সুরাহা হচ্ছে খুবই কম। অথচ যাত্রীরা যেন কাঙ্ক্ষিত সেবা পান, এজন্য বিআরটিএ’র ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭’ নামে চমৎকার এক নীতিমালা রয়েছে। খাতা-কলমে ২০১৮ সালের ৮ মার্চ থেকে কার্যকর হলেও কাজীর গরুর মতো কিতাবেই কেবল আছে এ নীতিমালা!

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সমকাল কার্যালয় (৩৮৭ তেজগাঁও) থেকে কয়েকটি রুটে উবারের ভাড়া যাচাই করে দেখা যায়, সমকাল থেকে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকে (দূরত্ব ৫.

৩ কিমি.) উবার এক্সে যেতে খরচ ৪২৮ টাকা, উত্তরা নর্থ মেট্রোস্টেশন (১৪ কিমি.) যেতে ৮৩৭ টাকা, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড (৭.৭ কিমি.) যেতে ৫৪০ টাকা। এ ছাড়া স্বল্প দূরত্বের মধ্যে সমকাল কার্যালয় থেকে ফার্মগেট মেট্রোস্টেশনে (১.৯ কিমি) যেতে ৩১৩ টাকা, আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (১.৪ কিমি.) যেতে লাগছে ২২৮ টাকা। প্রিমিয়ার সার্ভিস নিলে দূরত্বভেদে ৪০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি গুনতে হবে। সময়ভেদে এই ভাড়ায় তারতম্য ঘটলেও যাত্রীরা যখন রাস্তায় বেশি চলাচল করেন, ওই সময়টাতে তাদের ‘গলাকাটা ভাড়াই’ যেন নিয়তি! রাইড শেয়ারিংয়ের ভাড়া নিয়ে বিআরটিএ’র রাইড শেয়ারিং নীতিমালা কী বলছে দেখা যাক। এখানে ‘ট্যাক্সক্যাব সার্ভিস গাইডলাইন ২০১০’ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ৬০ টাকা এবং এরপর প্রতি কিলোমিটারের জন্য ১৫ টাকা হবে। রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের আওতায় চলাচল করা ব্যক্তিগত মোটরকারের ভাড়া ‘ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস গাইডলাইন ২০১০’ অনুযায়ী নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি হতে পারবে না।’’

২০১৮ সালে যখন এই নীতিমালা করা হয়, তখন রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা কোম্পানিগুলো কমবেশি আপত্তি তুলেছিল। তবে বিআরটিএ যৌক্তিক কারণে শক্ত অবস্থানে থাকায় ভাড়ার এই রেট মেনে নিতে বাধ্য হয় কোম্পানিগুলো। রাইড শেয়ারিং কোম্পানি নীতিমালা মেনেই তো রাস্তায় গাড়ি নামিয়েছে, তাহলে সমকাল থেকে আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১.৪ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে কোন হিসাবে ২২৮ টাকা যাত্রীকে গুনতে হবে! এর জবাব কে দেবে? শুধু এই একটি কারণেই তো রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে বিআরটিএ!
রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে যাত্রীদের অসংখ্য অভিযোগ। বেশির ভাগেরই সমাধান নেই। নীতিমালায় যাত্রী ও চালকের সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের কল সেন্টার ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার কথা বলা হলেও তার বাস্তবতা নেই। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশে উবারের অর্থনৈতিক প্রভাব ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে উবার। অনুষ্ঠানে উবার বাংলাদেশ প্রধানসহ কোম্পানিটির শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে এক সংবাদকর্মী অভিযোগ করেন, ‘দুই বছর আগে তিনি উবারের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করলেও এখন পর্যন্ত তার সমাধান পাননি।’ রাইড শেয়ারিং নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘বিআরটিএ এবং সংশ্লিষ্ট রাইড শেয়ারিং সেবাদাতার ওয়েবসাইটে যাত্রীর অভিযোগ জানানোর সুযোগ রাখতে হবে। অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়ে আপডেট অভিযোগকারীকে জানানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাত্রীর অভিযোগ বিষয়ে ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, নজরদারি এবং অভিযোগ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত যাবতীয় খরচ রাইড শেয়ারিং কোম্পানি বহন করবে।’

কিন্তু বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটে রাইড শেয়ারিং কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই, কোনো অভিযোগ তারা মনিটরও করে না। 
রাইড শেয়ারিং নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‍রাইড শেয়ারিংয়ের আওতায় সব মোটরযানের তালিকা বিআরটিএ’র ওয়েবপোর্টালে শ্রেণিবদ্ধভাবে একটি মেন্যুতে রাখতে হবে। বিআরটিএ’র পোর্টালে এমন কোনো ডেটাবেজই নেই। বাংলাদেশে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা, কোন শহরে কত গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছে–  গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এমন বেশ কিছু প্রশ্ন ই-মেইলে উবারের কাছে পাঠিয়েছিলাম। এ লেখা প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত একাধিকবার যোগাযোগ করার পরও কোনো উত্তর তারা দেয়নি।

ধারণা করা যায়, এ ধরনের ডেটা প্রকাশ পেলে তারা যে নীতিমালা লঙ্ঘন করছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। 
রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ চিঠি দিয়ে বিআরটিএকে তিনটি সুপারিশ করে। এগুলো হচ্ছে– ১০ বছরের পুরোনো যানবাহন রাইড শেয়ারিং সেবায় নিয়োজিত না করার বিধান করা, রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ যানবাহন নিবন্ধন করতে পারবে, তা ঠিক করে দেওয়া এবং শুধু ঢাকা মহানগর থেকে নিবন্ধন নেওয়া যানবাহনই এ সেবায় যুক্ত হতে পারবে, তা নিশ্চিত করা। পুলিশ বলেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জরাজীর্ণ ও পুরোনো কার-মোটরসাইকেল মেরামত করে ঢাকায় রাইড শেয়ারিংয়ে যুক্ত হচ্ছে। তাই কোম্পানিগুলো সর্বোচ্চ কত যানবাহন চালাতে পারবে, এর একটা সিলিং থাকা উচিত (৮ মে ২০১৯, প্রথম আলো)। গাড়ির চাপ যেন আর না বাড়ে সেজন্য ট্রাফিক বিভাগের সুপারিশ আমলে নিতেই হবে।
রাইড শেয়ারিং সেবা যাত্রী, চালক ও মালিকপক্ষের অনেক তথ্য সংরক্ষণ করে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্যও রয়েছে। এসব তথ্য যেন বেহাত না হয়, তৃতীয় পক্ষের কেউ যেন এগুলো ব্যবহারের সুযোগ না পায়, সেটি নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের যাবতীয় তথ্য বাংলাদেশের মধ্যেই সার্ভারে সংরক্ষণ 
করতে হবে। কোনো তথ্য কোনোভাবেই দেশের বাইরে নেওয়া যাবে না।’ এসব তথ্য যে বাংলাদেশে আটকে নেই, তা তো ওপেন সিক্রেট। 

রাইড শেয়ারিং বিশেষ করে উবারের আয় ভাগাভাগি নিয়ে এখন গাড়ির মালিক এবং চালকরাও সন্তুষ্ট নন। বর্তমানে কমিশন হিসেবে চালকদের আয়ের ১০০ টাকার মধ্যে প্রায় ৩০ টাকাই নিয়ে যাচ্ছে উবার। গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ, তেল-গ্যাস এবং মালিকের অংশ দেওয়ার পর চালকের হাতেও দিন শেষে থাকছে না সন্তোষজনক অর্থ। চালকরা বলছেন, এ কারণে অ্যাপে না গিয়ে খ্যাপে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এতে বাড়ছে যাত্রী ও চালকের নিরাপত্তা ঝুঁকি।
সড়ক-মহাসড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি রাইড শেয়ারিং সেবাকেও যাত্রীবান্ধব করে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। 

হাসান জাকির: সহকারী  সম্পাদক, সমকাল
prantojakir@gmail.com
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর বহন ব আরট এ র ন বন ধ সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

মঙ্গলবার কুয়াকাটায় রাস উৎসব, গঙ্গা স্নান বুধবার

প্রায় ২০০ বছর ধরে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মদনমোহন সেবাশ্রম মন্দির ও কুয়াকাটার রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরে পৃথক আয়োজনে রাস উৎসব পালন করে আসছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এবছরও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে হবে এ উৎসব। রাস উৎসব উপলক্ষে কলাপাড়ায় বসছে ৫ দিনব্যাপী মেলা। 

কলাপাড়ায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শেষ সময়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে মন্দিরের আঙ্গিনাসহ রাধা ও কৃষ্ণের ১৭ জোড়া প্রতিমা।

মঙ্গলবার পূর্ণিমা তিথিতে রাত ৯টা ২২ মিনিটে অধিবাসের মধ্যে দিয়ে শুরু হবে রাস পূজার আনুষ্ঠানিকতা। পরের দিন বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ৬ মিনিটে এ তিথি শেষ হবে। সেদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কুয়াকাটা সৈকতে গঙ্গা স্নান করবেন পুণ্যার্থীরা। এর পর মন্দিরের আঙ্গিনায় রাধা-কৃষ্ণের যুগল প্রতিমা দর্শন করবেন তারা। তাই, দুই মন্দিরেই ১৭ জোড়া প্রতিমা বানানো হয়েছে। প্যান্ডেল সাজানোর কাজ শেষ। চলছে লাইটিং ও সাজসজ্জার কাজ। 

এ উৎসব উপলক্ষে কলাপাড়ার মন্দির প্রাঙ্গণ, কুয়াকাটার মন্দির প্রাঙ্গণ ও সৈকতে অস্থায়ীভাবে বসছে শতাধিক পোশাক, প্রসাধনী, খেলনা ও গৃহস্থালী সামগ্রীর দোকান। কুয়াকাটায় তিন দিনব্যাপী উৎসব হলেও কলাপাড়ায় এ উৎসব চলবে পাঁচ দিন। এসব দোকানে অন্তত ৩০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রির আশা করছেন আয়োজকরা। 

কলাপাড়ার শ্রী শ্রী মদনমোহন সেবাশ্রমের রাস উদযাপন কমিটির সভাপতি দিলীপ কুমার হাওলাদার বলেছেন, আজকের মধ্যেই আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। হিন্দু ধর্মালম্বীদের এ উৎসব হলেও এখানে ৫ দিনব্যাপী মেলায় সব ধর্মের মানুষের আগমন ঘটে। আমাদের মন্দির প্রাঙ্গণে অন্তত ৭০টি দোকান বসেছে। আশা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে রাস উৎসব সম্পন্ন হবে। 

কুয়াকাটার রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক নীহার রঞ্জন মন্ডল বলেছেন, আগামীকাল রাতভর মন্দির প্রাঙ্গণে ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলবে। পরদিন সকালে গঙ্গা স্নান হবে। লাখো পুণ্যার্থীর আগমনের আশা করছি আমরা। বুধবারও গঙ্গা স্নান হবে। উৎসব উপলক্ষে আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

কলাপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাউসার হামিদ বলেছেন, রাস উৎসব উপলক্ষে কুয়াকাটায় ১ লাখ পুণ্যার্থী সমাগমের আশা করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। 

ঢাকা/ইমরান/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ