নিরাপত্তা শঙ্কায় এবার জমছে না সাহ্রি অনুষ্ঠান
Published: 13th, March 2025 GMT
কয়েক বছর ধরে রোজার সময় রাতে সাহ্রিকে কেন্দ্র করে জমজমাট হয়ে ওঠে রাজধানীর হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ ধরনের সাহ্রি অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। তাই গত কয়েক বছরে রাতে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজন নিয়ে সাহ্রি করার জন্য রাজধানীর রেস্তোরাঁয় ভিড় করতে দেখা যেত।
কিন্তু এবার রোজায় রাতের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। সাহ্রি অনুষ্ঠানে হাঁকডাক নেই। নেই রেস্তোরাঁয় জমজমাট ভিড়। ফলে রেস্তোরাঁর মালিকেরা হতাশ। তাঁরা লোকসানের শঙ্কায় আছেন। মূলত নিরাপত্তাঝুঁকির কারণেই সাহ্রি খেতে বাইরে যাচ্ছেন না আগ্রহীরা।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফায়েদ করিম বলছেন, ‘প্রতিবছর রমজানে প্রায় রাতে বন্ধুদের নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় সাহ্রি করতে যেতাম। তবে এবার এখন পর্যন্ত একবার বের হয়েছি। তবে নিরাপত্তার জন্য সবাই মিলে এই রমজানে আবার বের হতে পারব কি না, এখনো জানি না।’
ধানমন্ডি, পুরান ঢাকা, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় সাহ্রি অনুষ্ঠানের জন্য বুকিং পাচ্ছে না। ক্রেতার অভাবে ওই এলাকার বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ রাতে বন্ধ থাকে।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, মানুষ এখন আতঙ্কে আছে। তাই রেস্তোরাঁয় সাহ্রি খেতে যান না। অন্য বছর বাইরে সাহ্রি করা একধরনের উৎসবের মতো ছিল। এবার সেই আমেজ নেই বললেই চলে। গতবারের ১০ শতাংশ ক্রেতাও মিলছে না।
সরেজমিন ধানমন্ডিআজ ভোররাতে (বৃহস্পতিবার) সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার রেস্তোরাঁগুলো অনেকটাই ক্রেতাশূন্য। রাস্তায়ও নেই আগের মতো সাহ্রি করতে আসা মানুষ। রাস্তাঘাট পুরো ফাঁকা, মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের টহল দল দেখা গেছে। চারদিকে যেন সুনসান নীরবতা। অনেক রেস্তোরাঁ রাতে খোলা থাকলেও সাহ্রি করতে আসা মানুষের তেমন কোনো আনাগোনা দেখা যায়নি।
রাত তিনটার দিকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের বোহো রেস্তোরাঁর সরেজমিনে দেখা যায়, সাহ্রি করতে আসা লোকজন নেই বললেই চলে। অনেক টেবিল ফাঁকা পড়ে আছে। এ সময় কথা হয় রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলামীনের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রথম ১৫ রোজায় সাধারণত একটু কম লোকজন থাকে। তবে সময়ের সঙ্গে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়বে। রাত তিনটা পর্যন্ত খোলা রাখা হয় ধানমন্ডির রেস্তোরাঁটি।
সাহ্রি শেষে রেস্তোরাঁটির নিচে থাকা চার বন্ধু আড্ডা দিচ্ছিলেন। নিরাপত্তা নিয়ে চার বন্ধুর একজন তৌহিদ হাসান বেশ চিন্তায় আছেন। সাহ্রি শেষে নিজ বাসা বছিলায় কীভাবে নিরাপদে যাবেন, তা নিয়ে চার বন্ধু কথা বলছেন। তৌহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তায় চলাফেরা করা আগের চেয়ে কম নিরাপদ।
ধানমন্ডির ২/এ রোডের রেস্টুরেন্ট রংস ফরচুনে একই অবস্থা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, ভোররাত চারটা পর্যন্ত খোলা থাকলেও সাড়ে তিনটার দিকেও তেমন ক্রেতা সমাগম দেখছেন না। তাই ফাঁকা রেস্তোরাঁ নিয়ে বসে আছেন রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী ফাথুম মুবিনন। ১৫ রোজার পর ক্রেতার অংশগ্রহণ বাড়বে বলে আশা করছেন ফাথুম মুবিনন।
ব্যবসায় মন্দাধানমন্ডির দ্য প্যাসিফিক লাউঞ্জ প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার জাহিদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর থেকে এ বছর ক্রেতা তুলনামূলক বেশ কম। অন্য রমজানে ধানমন্ডির বেশির ভাগ বুফে রেস্তোরাঁগুলো খোলা থাকলেও এ বছর এমন রেস্তোরাঁ বন্ধ আছে। আগে থেকে বুকিং না হলে আমরাও প্রয়োজনে বন্ধ রাখছি।’
পুরান ঢাকার রেস্তোরাঁগুলো সাহ্রির জন্য বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এবার পুরান ঢাকার রেস্তোরাঁগুলোর ব্যবসা মন্দা। ক্রেতা বেশ কম। বংশালের হোটেল রাজ্জাক সাহ্রির জন্য বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এবার তারা ক্রেতা পাচ্ছে না। ফলে রাতের বেলায় ফাঁকাই থাকে বলা চলে।
কাপ্তানবাজারের খন্দকার রেস্তোরাঁয় এবার বেচাকেনা বেশ কম। বেচাকেনা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে বলে জানান রেস্তোরাঁর মালিক খন্দকার রুহুল আমিন। তিনি জানান, গতবার সাহ্রির সময় প্রতিদিন ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা বেচাকেনা হতো। এবার তা ৫-৬ হাজার টাকায় নেমেছে। নিরাপত্তার কারণে ভোররাতে লোকজন কম বের হন।
ইমরান হাসান কাসুন্দি রেস্তোরাঁর মালিক। ক্রেতা না থাকায় তাঁর এই রেস্তোরাঁ রাতের পালায় লোকবল কমিয়ে দিয়েছেন। তাই তিনি লোকসানের মুখে পড়বেন বলে জানান।
স্টার রেস্তোরাঁও সাহ্রির জন্য জনপ্রিয়। কিন্তু এবার সেই জমজমাট ভাব নেই। গতকাল দুপুরে ধানমন্ডির স্টার কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক মনিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘গত বছর থেকে সাহ্রি বিক্রি এ বছর কিছুটা কম। গতবারের ১০-২০ শতাংশ ক্রেতা কমেছে। তবে কী কারণে এ রকম হচ্ছে, তা আমরা উদ্ঘাটন করতে পারিনি এখনো।’
সাহ্রির জন্য মিরপুর, বনানী, ধানমন্ডিসহ বেশ কয়েক জায়গায় রেস্তোরাঁ খোলা থাকলেও গত বছরের চেয়ে তার সংখ্যা অনেকাংশেই কম। উত্তরার বহু রেস্তোরাঁ এখন রাতে খোলা রাখা হয় না।
রাতে ঘরের বাইরে বের হওয়া নিয়ে আতঙ্ক চেপে বসেছে রাজধানীর মানুষের মধ্যে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী কাভি সালসাবিল বিনতে তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছর অন্তত একবার রাতে পরিবার নিয়ে সাহ্রি করতে যাই। তবে এবার ঢাকায় চুরি ও ছিনতাইয়ের খবর দেখে এখনো বাচ্চাদের নিয়ে বের হওয়ার সাহস হয়নি। পরিস্থিতি ভালো মনে হলে হয়তো সাহ্রি করতে যাব।’
বেড়েছে অপরাধবিগত মাসগুলোতে রাজধানীতে বেড়েছে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বনশ্রীতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণ ছিনতাইয়ের ঘটনা। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিককালে ডাকাতি ও দস্যুতার (ছিনতাই) ঘটনায় মামলা বেড়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২২৭টি। খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৩৭টি। রাজধানীতে চুরি–ছিনতাইয়ের ঘটনা তুলনামূলক বেশি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাতে আমরা টহল বাড়িয়েছি। রাতে এখন পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। নগরবাসী রাতে স্বস্তিতে চলাচল করতে পারেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।’
অনলাইনেও বেচাকেনা কমব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাতে ক্রেতা সমাগম কম। তাই অনেক মালিক তাঁর রেস্তোরাঁ খোলা রাখছেন না। সরেজমিনে ধানমন্ডির কিছু রেস্তোরাঁর মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরাসরি ক্রেতাদের জন্য খোলা না থাকলেও কিছু রেস্তোরাঁ অনলাইনে তাদের খাবার বিক্রি করছে। এসব রেস্তোরাঁ রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত খোলা থাকে।
ফাস্টফুড প্রতিষ্ঠান টেকআউটের মহাব্যবস্থাপক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মোহাম্মদপুর ও উত্তরায় ছিনতাই বেশি হওয়ায় সেসব জায়গায় গ্রাহকদের অনলাইন মাধ্যমগুলোর পিকআপ সেবা দিতে পারছি না। নিরাপত্তার কারণে চালকস্বল্পতার কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অর্ডার নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ তিনি আরও জানান, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে ১৫ শতাংশ কম বেচাকেনা হচ্ছে। রোজার দ্বিতীয় ভাগে রাতে বেচাকেনা কিছুটা বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
দুই বছর ধরে ফুডপ্যান্ডার চালক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন মোহাম্মদ দিদার। নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে রাতে খুব একটা বের হন না। তিনি প্রথম আলোকে জানান, সম্প্রতি তাঁর এক সহকর্মীর সাইকেল, মোবাইল ও টাকা ছিনতাই করে কিছু সন্ত্রাসী। তাই আগের থেকে রাতে তুলনামূলক ৫০ শতাংশ কম চালক কাজ করছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ধ নমন ড র অন ষ ঠ ন র র জন য জনপ র য় গত বছর থ কল ও ব যবস বছর র র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
পিডিবির ভুলে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো বাংলাদেশকে
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) খামখেয়ালিজনিত এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশকে দুই কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।
খামখেয়ালিটি হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২০০০ সালে হওয়া ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে (বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা) একটি মামলায় পক্ষভুক্ত না হওয়া। পক্ষভুক্ত হতে গেলে বাংলাদেশকে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হতো। তা করেনি পিডিবি। ফলে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে একতরফা রায় হয়েছে। দুই যুগ পর এখন বাংলাদেশকে জরিমানা দিতে হয়েছে ৩৩৩ গুণ বেশি অর্থ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত ১৯ মে পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ হিসেবে পিডিবিকে দেওয়া হবে, যা তারা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডকে। হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্পনসর (পৃষ্ঠপোষক) ছিল এই স্মিথ কো-জেনারেশন।
আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানঅবশ্য পিডিবি অর্থ বিভাগের ঋণ নেয়নি। সংস্থাটি নিজের তহবিল থেকে গত ২৩ মে ২৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কোম্পানিটি।
এই পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করেই ২০২৪ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। জটিলতা এড়াতে তাঁরা দুজন পরে হোটেল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় (বাংলাদেশ হাউস) গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।’
ঘটনা শুরু যেভাবেমূল ঘটনা ১৯৯৭ সালের অক্টোবরের। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার হরিপুরে বেসরকারি খাতে ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কো-জেনারেশন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে দুটি চুক্তি করে বাংলাদেশ। কোম্পানিটির সঙ্গে পিডিবির একটি চুক্তি হয় ১৯৯৭ সালের ১৪ অক্টোবর। দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর সরকারের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয় বিদ্যুৎ কেনার (পিপিএ)।
চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ১৯৯৮ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু কোম্পানিটি তা পারেনি। শর্ত ছিল নির্ধারিত দিন থেকে উৎপাদন করতে না পারলে দুই মাস মেয়াদ বাড়াবে সরকার, তবে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তো দূরের কথা, কোনো নির্মাণকাজ করতে পারেনি; বরং আরও ৬ মাস ২০ দিন সময় চায়। সরকার তা না মেনে ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পিপিএ ও জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করে দেয়। শুধু তা–ই নয়, ব্যাংক নিশ্চয়তার (পিজি) ১৫ লাখ ডলারও নিয়ে নেয় পিডিবি।
সচিবালয়ে গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক থেকে মার্কিন কোম্পানিটিকে ২ কোটি ডলার দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বিদ্যুৎসচিব ফারজানা মমতাজ এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কথা আসেনি। যদিও সম্প্রতি আলাদা এক চিঠিতে অর্থ বিভাগ এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
বিদ্যুৎসচিবের সঙ্গে গত ১৫ মে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করে জানতে চাওয়া হয় যে যাঁদের কারণে বাংলাদেশকে এখন ২৪৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে, তাঁদের তিনি বাঁচিয়ে দিলেন কেন। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।
ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদবিষয়টি যেভাবে আদালতে গড়ালঅর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে পাঠানো বিদ্যুৎসচিবের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটি ২০০০ সালে ঢাকার সাব জজ পঞ্চম আদালতে আরবিট্রেশন মিসকেইস (বিবিধ মামলা) এবং নারায়ণগঞ্জের সাব জজ প্রথম আদালতে আরেকটি আরবিট্রেশন বিবিধ মামলা করে। উভয় মামলাই আদালত খারিজ করে দেন। আদালতে মামলার পাশাপাশি কোম্পানিটি পরে পিপিএ বাতিল ও পিজি নগদায়নের বিরুদ্ধে আইসিসি আরবিট্রেশনে যেতে পিডিবিকে নোটিশ দেয়। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি হতে পারেন আরবিট্রেটর।
কিন্তু আইসিসি বিদেশে আরবিট্রেশন মামলায় অংশগ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনাল খরচ বাবদ নির্ধারণ করে ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা উভয় পক্ষকে সমানভাবে বহন করতে হবে। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার দিতে হবে অগ্রিম। অর্ধেক হিসেবে তখন পিডিবির খরচ করতে হতো অগ্রিমের ৬০ হাজার ডলার।
তখনকার পিডিবির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ট্রাইব্যুনাল খরচের কোনো অর্থ দেবে না। পিডিবির তৎকালীন আইনজীবী প্যানেল একই পরামর্শ দেয়। আইনজীবীরা আরও মত দেন, দেশে আরবিট্রেশন আইন হয়েছে ২০০১ সালে। এর আগে আইসিসির আরবিট্রেশনের রায় বাংলাদেশের বাইরে কার্যকর হবে না। তাঁরা মামলায় পক্ষভুক্ত না হতে পিডিবিকে পরামর্শ দেন।
পরে একপক্ষীয় শুনানি শেষে আইসিসি আরবিট্রেশন আদালত ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর রায় দেন। রায়ে বলা হয়, পিডিবি বছরে ৪ শতাংশ সুদসহ মোট ১ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে।
রায় বাস্তবায়নের ছয় মামলাআইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নে স্মিথ কো-জেনারেশন পরে ছয়টি মামলা করে। এগুলো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব অব কলাম্বিয়া, ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্ক, সুপ্রিম কোর্ট অব নিউইয়র্ক, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের কোর্ট অব সেশন, সুইজারল্যান্ডের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব বাডেন এবং ঢাকার আদালতে।
আইসিসির রায় বাস্তবায়নে ২০০৭ সালের ২০ জুলাই রায় দেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব কলাম্বিয়া। স্মিথ কো-জেনারেশন এ আদালতে বিষয়টি আবার উত্থাপন করে। এরপর ২০২৪ সালের ১৯ মে পিডিবির বিরুদ্ধে সংশোধিত চূড়ান্ত রায় দেন আদালত। এবারের রায়ে বলা হয়, পিডিবি ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধ করবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে। কোম্পানিটি তখন তার আইনি প্রতিষ্ঠান ডোয়ান মরিস এলএলপিকে বিষয়টি জানায়। কিন্তু রায় আর বাস্তবায়ন হচ্ছিল না।
বিষয়টি নিয়ে জানতে গত ২৮ মে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনিও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর যে বিপদে পড়েছিলেনআন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন যায় উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি দল, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও ছিলেন। ২১-২৬ অক্টোবর (২০২৪) ছিল এ বার্ষিক সভা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টা ও গভর্নরের ওয়াশিংটন যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে স্মিথ কো-জেনারেশন আরেকটি মামলা করে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায়। আদালত তখন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের জবানবন্দি নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু যেহেতু অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা আছে এবং তাঁরা পিডিবির সঙ্গে সম্পর্কিত নন, তাই তাঁরা জবানবন্দি দেননি।
স্মিথ কো-জেনারেশন তখন আবার আদালতে (যুক্তরাষ্ট্র) যায়। আদালত ২৫ অক্টোবর (২০২৪) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুরকে আটক করে আদালতে নিয়ে আসতে ইউএস মার্শাল সার্ভিসকে নির্দেশ দেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা দুজন তখন আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সরকারি বাসভবনে। তাঁরা ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসির ১০ নম্বর সড়কে অবস্থিত অ্যাম্বাসি স্টু হোটেলে। দূতাবাসের গাড়িতে করে তাঁরা ম্যারিল্যান্ডে রাষ্ট্রদূতের বাসায় চলে যান।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগ এলএলপিকে নিয়োগ দেয়। তারা আপিল করলে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত করেন এবং শুনানির দিন ধার্য করেন ২৮ অক্টোবর (২০২৪)। ফলি হোয়াগ এলএলপি বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতার আবেদন জানায় বিচারকের কাছে এবং বিচারক তা গ্রহণ করেন। এভাবেই অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর ওই যাত্রায় রক্ষা পান।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ৩০ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।নিষ্পত্তির পথ খুলল যেভাবেমধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়কে ভিত্তি ধরে দেশে তখন গুরুত্বের সঙ্গে কাজ শুরু করেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর এ বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপর স্মিথ কো-জেনারেশনের মধ্যস্থতাকারী, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান অনলাইনে ৫টি বৈঠক করেন। শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, জব্দ করা ব্যাংক নিশ্চয়তার ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হোক। বিপরীতে স্মিথ কো-জেনারেশন দাবি করে ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। আরও দাবি করে, মামলার খরচ বাবদ আরও ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার তাদের দিতে হবে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাবে কোম্পানিটিকে বলা হয়, ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান আইনের আওতায় বিদ্যুৎ খাতে তাদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। এতেও রাজি হয়নি স্মিথ কো–জেনারেশন। বাংলাদেশ পরে ১ কোটি ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়। স্মিথ কো-জেনারেশন তখন নতুন প্রস্তাব দেয়। সেটি হলো, এককালীন ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। অথবা ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার ও দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারা মেনে নেবে।
বিষয়টি নিয়ে মধ্যস্ততায় থাকা বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে গত ২৬ মে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অবশ্য অর্থ বিভাগ ও পিডিবি সূত্র জানায়, পরে স্মিথ কো-জেনারেশন ২ কোটি ডলারে রাজি হয়। বাংলাদেশ সরকারও সিদ্ধান্ত নেয়, এই পরিমাণ অর্থ ওই কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আগেই সম্মতি দিয়ে রেখেছিলেন (গত ১৮ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা। গত ২৮ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।
ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ‘দেশের বদনাম হলো’১৯৯৬-৯৯ সময়ে পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন নুরউদ্দিন মাহমুদ কামাল, তিনি ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর মারা যান। ১৯৯৯-০০ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক সচিব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক, যিনি মারা যান ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ২০০০-০২ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক, যিনি মারা যান ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে শাস্তি দিতে হবে। এমনকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবিরও শাস্তি পাওয়া উচিত। অর্থ বিভাগের পরামর্শ মেনে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করা।