গুতেরেসের সফর: রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন দিকে
Published: 17th, March 2025 GMT
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা একটি ঐতিহাসিক এবং ভূরাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না পেয়ে নিজ ভূখণ্ডে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক হিসেবে তারা দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেই সময়ে প্রথম বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে।
এরপর নিয়মিত বিরতিতে তাদের আগমন ঘটতে থাকে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিগত সময়ে বেশির ভাগ রোহিঙ্গার নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করতে পারলেও ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা কয়েক দশক ধরে শরণার্থী হিসেবে কক্সবাজারের উখিয়ায় রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে বসবাস করছিল। ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্যও অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এই নতুন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে তাদের সামগ্রিক ভরণ-পোষণ দেখাশোনা এবং ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশকেই বহন করতে হচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে মূলত রোহিঙ্গাদের প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনা এবং ভরণপোষণ ব্যতীত এই সমস্যা সমাধানের তেমন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং সাফল্য দেখা যায়নি। এখানে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছিল, ছিল অদূরদর্শী পরিকল্পনা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র হিসেবে আমরা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ ছিলাম।
এই বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের অষ্টম বছর প্রায় শেষের দিকে। বিগত আট বছরে আমরা একজন রোহিঙ্গাকেও তার নিজ দেশে পাঠানোর মতো অবস্থা তৈরি করতে পারিনি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি আমাদের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হলেও বিগত সময়ে আমরা একটি রোড ম্যাপ তৈরি করতে পারিনি। পারিনি একটি সামগ্রিক শরণার্থী পলিসি বা জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে।
এতসব ব্যর্থতার মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। তার বেশ কিছু নমুনা দেখা গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো একজন উপদেষ্টার পদমর্যাপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ এর নিয়োগ দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার মোকাবিলার জন্য একটি নিবেদিত দপ্তর তৈরি হয়েছে, যার প্রধান কাজ হলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাওয়া।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আমরা দেখতে পারি। কেননা, বিগত সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনই দেখা হতো। বর্তমান সরকারের এই উদ্যোগ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য একটি বাস্তবসম্মত উদ্যোগ।
রাখাইন অঞ্চলে চীন ও ভারতের কোনো অন্তর্নিহিত স্বার্থ রয়েছে কি না, সেটিও আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। যদি তা–ই থাকে, তাহলে সেটিও মাথায় রেখে একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। যাতে ভারত ও চীনকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়। কেননা, ভারত ও চীন তাদের নিজেদের স্বার্থ বলি দিয়ে বাংলাদেশের কথা চিন্তা করবে বলে মনে হয় না।রোহিঙ্গা সমস্যাটাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরার কথা বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে। যাতে করে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘসহ অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ সহায়তা পেতে পারি। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, রোহিঙ্গা সমস্যাকে সামনে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করার কাজ চলছে।
এ প্রসঙ্গে ইউএন রিফিউজি এজেন্সির প্রধান ফিলিপো গ্র্যান্ডির একটি মন্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন ‘আমাদের উচিত এই বিষয়টাকে বৈশ্বিক পরিসরে নিয়ে যাওয়া। ইউএন সম্মেলনের মাধ্যমেই আমরা এই বিষয়টাকে আবারো বৈশ্বিক এজেন্ডাতে নিয়ে আসতে পারি।’
এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ইফতার ও মতবিনিময় করেন। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি। জাতিসংঘের মহাসচিবের এই ভ্রমণকে রোহিঙ্গা সমস্যাকে বিশ্বদরবারের একটি গুরুত্বের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে আমরা দেখতে পারি। তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়কে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান।
বিগত সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি দুটি বড় কারণে আরও জটিল একটি জায়গায় চলে গেছে। এর একটি হলো মিয়ানমারে সামরিক ক্যু; এবং দ্বিতীয়টি হলো সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে আরাকান আর্মির উত্থান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের ভিন্নতর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যেটি হতে হবে কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত। এ প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ আর কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় রাখবেন বলে প্রত্যাশা করা যায়।
প্রথাগত দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে বহুমাত্রিক কূটনৈতিক ব্যবস্থার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা জরুরি বলে মনে করা হয়। তাদের বোঝাতে হবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের নিজেদের জন্যও জরুরি একটি বিষয় এবং এর সমাধান হলে তারাও একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ গঠনের মাধ্যমে লাভবান হবে।
আমরা যেমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথা গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করার কথা বলছি, ঠিক তেমনি আঞ্চলিক এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্রের কথাও মাথায় রাখতে হবে। এর মধ্যে চীন ও ভারত দুটি দেশই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। চীন ও ভারত কেন আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য সহায়তা করবে সেই বিষয়ে আমাদের গভীর পর্যালোচনা করতে হবে।
রাখাইন অঞ্চলে চীন ও ভারতের কোনো অন্তর্নিহিত স্বার্থ রয়েছে কি না, সেটিও আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। যদি তা–ই থাকে, তাহলে সেটিও মাথায় রেখে একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। যাতে ভারত ও চীনকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়। কেননা, ভারত ও চীন তাদের নিজেদের স্বার্থ বলি দিয়ে বাংলাদেশের কথা চিন্তা করবে বলে মনে হয় না।
আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শরণার্থী শিবিরের জীবনযাপন এর দিকেও নজর রাখতে হবে, যেন তারা একটি সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যা একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সন্তানেরাও যেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেতে পারে সেদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।
তা না হলে একটি বিরাট তরুণ সমাজ হতাশাগ্রস্ত জীবনযাপন করবে, যা আমাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং শরণার্থীদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় অর্থের জোগান একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় বাংলাদেশের জন্য।
প্রতিবছর অর্থের জোগান কমে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার জন্য একটি অশনিসংকেত। তাই যথাযথ জোগানের ব্যবস্থা করাও আমাদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যসহায়তা কমানোকে একটি ‘অপরাধ’ বলে বিবেচনা করেন। তিনি তাদের সহায়তা বৃদ্ধির জন্য কাজ করার জোরালো আশ্বাস দেন।
এমন একটি জটিল অবস্থায় একটি সামগ্রিক, ব্যাপক ও বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি বিষয়। সেখানে বিভিন্ন ধাপে আমাদের কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে যাওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, পাশাপাশি তাদের স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিয়ে কূটনৈতিক আলাপ চালিয়ে যেতে হবে। এর সঙ্গে শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্যও কাজ করতে হবে, যেন তারা একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।
বুলবুল সিদ্দিকী নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শরণ র থ দ র ন উপদ ষ ট র র জন য একট জনগ ষ ঠ র ক পদক ষ প ও আম দ র ন র জন য ক টন ত ক দ র জন য ন য একট সমস য ক ক জ করত সমস য ট ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
জামায়াতের প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ অভিনব। কারণ, তখন দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষ পদের মধ্যে একমাত্র কার্যক্ষম ব্যক্তি ছিলেন রাষ্ট্রপতি। বহাল ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
তৎকালীন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তাদের শপথ পাঠ করাতে পারবেন কি না, এই মর্মে বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের উপদেশমূলক মতামত চান। সুপ্রিম কোর্ট ইতিবাচক মতামত দেন। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের এই উপদেশ গ্রহণ করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ পড়ান।
বিভিন্ন সাংবিধানিক পদধারী যে শপথ গ্রহণ করেন, সেটাও বিদ্যমান সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের বিধানমতে তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত শপথ। যেহেতু বিগত শেখ হাসিনা সরকার ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে, কাজেই প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টাদের শপথবাক্যও সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, মুহাম্মদ ইউনূস সরকার তাহলে কোন শপথ পাঠ করলেন? উত্তর হলো, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টারা যে শপথ পাঠ করতেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা সেই শপথ পাঠ করেন। সুতরাং এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মূলত বিদ্যমান সাংবিধানিক রীতি মেনে শপথ নিয়েছে।
আবারও প্রশ্ন উঠতে পারে, বিদ্যমান সংবিধানবহির্ভূত শপথ গ্রহণ করার জন্য এই সরকার কি বৈধ না অবৈধ? এ বিষয়ে উভয় দিকেই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা সম্ভব। এই বিষয়ে আমি সরাসরি উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকছি।
বাস্তবতা হচ্ছে, একটি ক্রান্তিকালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এমন জরুরি ও ক্রান্তিকালীন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সাংবিধানিক বিধান আমাদের বিদ্যমান সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ ও চতুর্থ তফসিলে রয়েছে। আমি এর আগে অনেক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি বলেছি, লিখেছি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত এই সরকারের সব কার্যক্রম, এমনকি পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন পর্যন্ত সময়কালের বৈধতা দিতে গেলেও সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। সে ক্ষেত্রে সমাধান হলো বিদ্যমান সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া বা অধিকতর সংশোধন করা।
এখন প্রশ্ন হলো, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রণীত জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? আমি আগেই উল্লেখ করেছি, পরবর্তী সংসদ গঠিত হওয়ার পর অবশ্যই সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। আর কিছু না হোক, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কার্যক্রমে বৈধতা প্রদানের জন্য হলেও এটি করতে হবে। আমার সুস্পষ্ট মতামত হলো, জুলাই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ, এর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টিসহ সবকিছুই সেই সংশোধনীর মাধ্যমে করা সম্ভব এবং সেটিই বাস্তবসম্মত হবে।
আরও পড়ুনসংস্কার প্রশ্নে বিএনপি যে ছাড় দিল, অন্যরা কি দিচ্ছে২৯ জুন ২০২৫২.বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এখনই একটি বিশেষ অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক আদেশ (আইন) জারি করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার ২০২৫।
আমি এই প্রস্তাবটি দেখেছি। এ ধরনের যেকোনো আদেশ প্রণয়নের ক্ষেত্রে এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে হয় এবং বাংলায় ‘যেহেতু’ ও ইংরেজিতে ‘হোয়ারএস’ শব্দ দিয়ে শুরু করতে হয়। প্রস্তাবিত আদেশে মোট ৯টি ‘যেহেতু’ ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় যেহেতুতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৫ আগস্ট ২০২৪–এর ঘটনাপ্রবাহে ‘কন্সটিটিউয়েন্ট পাওয়ার’ (গাঠনিক শক্তি) বাংলাদেশের নাগরিকের ওপর হস্তান্তরিত হয়েছে এবং সেই ক্ষমতাবলে জনগণ ক্ষমতার মালিকানা গ্রহণ করেছে।
এই ধরনের ধারণা সৃষ্টি করা বাস্তবতাবর্জিত। কারণ, আগেই বলেছি, একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে পরবর্তী সংসদ কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে। কাজেই এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো আদেশ জারি করা হলে, বর্তমান সরকারের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হবে।
প্রস্তাবিত আদেশের মাধ্যমে বিদ্যমান সংবিধানকে ১৯৭২ সালের সংবিধান হিসেবে আখ্যায়িত করে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের তিন–চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হবে বলে বলা হয়েছে। তত দিন পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকবে বলে বলা হয়েছে। এই প্রস্তাবনা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।প্রস্তাবিত আদেশের মাধ্যমে বিদ্যমান সংবিধানকে ১৯৭২ সালের সংবিধান হিসেবে আখ্যায়িত করে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের তিন–চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হবে বলে বলা হয়েছে। তত দিন পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকবে বলে বলা হয়েছে। এই প্রস্তাবনা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
তাহলে এত দিন মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার যে সাংবিধানিক, প্রশাসনিক, বিচারিক দায়িত্ব পালন করল, সংস্কারের উদ্যোগ নিল, সেগুলো কিসের ভিত্তিতে করল? জামায়াতের প্রস্তাবিত আদেশে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সর্বসম্মতি’তে (ওয়াইডস্প্রেড কনসেনসাস) ও জনগণের ‘কন্সটিটিউয়েন্ট পাওয়ার’ বলে এই সরকারের কাজ সম্পাদিত হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
তাই যদি হবে, তাহলে কেন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার, সংবিধানের ১২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহাহিসাবনিরীক্ষক, সংবিধানের ১৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং অন্যান্য সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দিলেন? রাষ্ট্রপতি যে এত দিন ধরে সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ বলে এত এত অধ্যাদেশ জারি করলেন, আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও তার অধীনে বিচারকাজ চলমান রইল, তার কী হবে?
আরও পড়ুনশিবিরের এই সাফল্য জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে সুবিধা দেবে কি১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫৩.এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বর্তমান সরকারের কার্যক্রম বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হচ্ছে এবং এসব কাজের অনুমোদন (র্যাটিফিকেশন) ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে বিদ্যমান সংবিধানকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু জামায়াতের প্রস্তাব অনুসারে এই বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করা হলে দেশে ব্যাপক ‘সাংবিধানিক বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি হবে। সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে।
এই প্রস্তাবে বর্ণিত এই আদেশের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হলে সংবিধান, আইন, আদেশ পুরোপুরি কিংবা এগুলোর অসংগতিপূর্ণ অংশ বাতিল হিসেবে গণ্য হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকারান্তরে এই প্রস্তাবিত আদেশকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই বিধান আমাদের বিদ্যমান সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদের অনুকরণে লিখিত।
এ ছাড়া এই আদেশ অমান্য করলে বা চেষ্টা করা হলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, কোনো আদালত এই আদেশের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ কোনো রায় বা আদেশ দিতে পারবেন না। পরবর্তী নির্বাচনের প্রার্থীকে এটি মেনে চলার জন্য আবশ্যিকভাবে হলফনামা দিতে হবে; এই আদেশের বিরুদ্ধে কোনো প্রচারণা করা যাবে না, এমন বিধানও সন্নিবেশিত করা হয়েছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে এমন একটি অবাস্তব ও অকার্যকর আইনি বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
৪.প্রভিশনাল কন্সটিটিউশনাল অর্ডার ২০২৫ জারি করবে কে? সহজেই অনুমেয় যে সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদের দফা ক) এবং খ)–এর বিধানমতে, কোনো অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তন বা রহিতকরণ হয়ে যায়, এমন বিধান করা যাবে না।
সংবিধানের এই বিধান উপেক্ষা করার জন্য আদেশ জারি করে সেটাকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়ার প্রস্তাব করেছে জামায়াত। প্রস্তাবিত আদেশে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই আদেশ প্রণয়ন ও জারি করবে এবং ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে এই প্রস্তাবিত আইন কার্যকর হবে।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা যখন বিদ্যমান সংবিধানের ওপরই নির্ভরশীল, তাহলে তারা কীভাবে এমন একটি অযৌক্তিক আদেশ প্রণয়ন করবে?
মো. রুহুল কুদ্দুস সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি; সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি।
*মতামত লেখকের নিজস্ব