গত ১৭ মার্চ দিবাগত রাত ২টারও বেশি। গাজাবাসী তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। একটু পরই সাহ্রির জন্য তাদের ওঠার কথা। তাদের ঘুম ভাঙে হানাদার বাহিনীর বিমান হামলা আর মানুষের বীভৎস কান্নার শব্দে। ভোরে যখন মুয়াজ্জিন আজান দিচ্ছিলেন, তখনও তিনি কান্না ধরে রাখতে পারছিলেন না। রাতভর চলা ইসরায়েলি গণহত্যা পুনঃনবায়নের প্রথম রাতেই চার শতাধিক মানুষ নিহত হন। ইসরায়েল ১৭ মার্চ রাতে গাজায় গত ১৭ মাসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলা চালায়। এতে চার শতাধিক মানুষ নিহত হন। এর মধ্যে ১৭৪ জন শিশু, ৮৯ জন নারী এবং ৩২ জন বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন। এর পরদিন দেইর আল-বালাতে আবুবকর আবেদ বলেন, ‘আমি গোলাবর্ষণ ও বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এটি থামছে না।’ গাজার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বেইত হানুনের হোসাম শাবাত এক শব্দে পরিস্থিতির উত্তর দিয়েছেন– ‘মৃত্যু’। রাশা আবু জালাল একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও মা। সম্প্রতি সেই ভয়াবহ রাতের বর্ণনা তিনি সংবাদমাধ্যম ড্রপ সাইটের কাছে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি অলৌকিকভাবে আমার পরিবার নিয়ে গত রাতে বেঁচে গেছি। তারা আমাদের বাড়ির পাশের একটি বাড়িতে বোমা হামলা চালায়। বাড়িটি আমাদের বাড়ির ওপর ধসে পড়ে। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা নিরাপদে ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, কিন্তু আমাদের পাশের বাড়িতে ১১ জন নিহত হন।’ ড্রপ সাইটের প্রতিবেদন অবলম্বনে লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত
গাজা সিটি– ১৮ মার্চ ভোর ৩টায় রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেওয়া এক বিশাল বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠি। মুহূর্তের জন্য মনে করলাম, আমি বুঝি মারা গেছি। আমি বালিশ থেকে মাথা তুললাম, তখনও আমার চারপাশে কী ঘটছে, বুঝতে পারিনি। বাতাস ধূসর ধুলায় ভরপুর। হঠাৎ আমার পাঁচ সন্তানের চিৎকার আমার কানে বাজল। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে তখন বেঁচে ছিলাম কিনা বুঝতে পারছিলাম না। আমি তাদের জড়িয়ে ধরতে ছুটে গেলাম।
এরপর আরও বিস্ফোরণ। রাতভর ইসরায়েলের বিমান হামলা বিনা সতর্কতায় নিরন্তর গাজায় আঘাত হেনেছে। আমার ভীতসন্ত্রস্ত ১২ বছর বয়সী মেয়ে সাইদার শরীর ভয়ে কাঁপছিল। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা! আমরা কি মারা যাব?’ আমি উত্তর দিতে পারিনি। আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার স্বামীর সন্ধান করলাম। সে আমার পাশে ঘুমাচ্ছিল; কিন্তু তাকে খুঁজে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর, সে ধুলো থেকে বেরিয়ে এলো, পানিতে ভেজা কাপড়ের টুকরো হাতে নিয়ে। আমাকে ও বাচ্চাদের মুখ এবং নাক ঢেকে রাখতে বলল; যাতে আমরা দম বন্ধ করা ধুলা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি।
আমি লক্ষ্য করলাম, পাশের ঘরের দেয়াল সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। এটি ছিল সেই ঘর যেখানে আমরা সাধারণত ঘুমাতাম; কিন্তু কাকতালীয়ভাবে গত রাতে আমার স্বামী ও আমি আমাদের পাঁচ সন্তানকে নিয়ে একটি গরম ঘরে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিই। আমি জানতাম না, এতটুকু সিদ্ধান্ত আমাদের জীবন বাঁচাবে।
আমি দ্রুত আমার আবায়া পরলাম, আমার তিন বছর বয়সী মেয়ে মাসাককে কোলে নিলাম এবং আমার স্বামী কোলে নিয়েছে আমাদের পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে হুরকে। অন্য তিন সন্তান– ১২ বছর বয়সী সাইদা, ১০ বছর বয়সী জেইন এবং ৮ বছর বয়সী শাম আমাদের পেছনে ছিল। যখন আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ালাম, তখন এটাও জানতাম না, আমরা মৃত্যু থেকে পালাচ্ছি নাকি মৃত্যুর দিকে ছুটছি।
বাইরে আমরা প্রতিবেশী জামাসি পরিবারের বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখলাম। এটি সরাসরি বিমান হামলার শিকার হয়। আমরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, প্যারামেডিক এবং সিভিল ডিফেন্স টিম তাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনছে। তারা বাড়ি থেকে তখন ১১ জনকে উদ্ধার করল। তাদের মধ্যে পাঁচজনই নিহত, তাদের মধ্যে আট বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে সিওয়ারও রয়েছে। সে আগের দিন বাড়ির বাইরে খেলছিল। এখন সে আর নেই।
আমরা সেই এলাকা থেকে পালিয়ে গেলাম, আশপাশের একটি এলাকায় আত্মীয়দের সঙ্গে আশ্রয় নিলাম। আমরা যা কিছু নিতে পারলাম তা নিলাম; কিন্তু আমরা নিরাপত্তার সব অনুভূতি পেছনে ফেলে এসেছি। পালানোর সময় আমার স্বামী বলছিল, ‘যখন আমি বাচ্চাদের চিৎকার শুনলাম, আমি অসহায় বোধ করছিলাম। আমি শুধু তাদের জীবিত বের করে আনার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি তাদের কীসের মধ্যে নিয়ে এসেছি– এমন এক জীবনে যেখানে আমরা এক মৃত্যু থেকে আরেক মৃত্যুর দিকে ছুটছি?’
আমরা এখন একটি ঘরে একসঙ্গে অনেকে ঠাসাঠাসি করে আছি। যদিও আমরা অন্য এলাকায় আছি, ভয় সর্বত্র আমাদের অনুসরণ করে। গাজায় কেউই নিরাপদ বোধ করে না। ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান আকাশে অবিরাম ঘুরছে, নির্মমভাবে বেসামরিক বাড়িগুলোতে বোমাবর্ষণ করছে। অকারণে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
আমরা এখনও হতবিহ্বল। মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত। আমার আট বছর বয়সী মেয়েটি আর ঘুমাতে পারছে না। আমি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি; কিন্তু সে কাঁদতে কাঁদতে জেগে উঠেছে। সে আমাকে বলল, ‘মা, আমি যখনই চোখ বন্ধ করি, আমার মনে হয় আরেকটি বোমা আমাদের ওপর এসে পড়ছে।’ আমি তাকে শান্ত করতে তার পাশে শুয়ে পড়লাম। আজ সকালে আমি আবিষ্কার করলাম যে, সে ভয়ে বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে।
আমার ১২ বছর বয়সী মেয়ে সাইদা আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘মা, বিমানগুলো কি আবার আসবে?’ আমি তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারছি না। আমি তাকে কীভাবে আশ্বস্ত করব– যখন আমি আর বিশ্বাস করি না যে, আমি আগামীকাল জেগে উঠব কিনা?
আমি আমার স্বামীর ক্লান্ত, বিষণ্ন চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই দুঃস্বপ্ন কখন শেষ হবে?’ সে বলল, ‘আমরা এই পৃথিবীতে একা। কেউ আমাদের খেয়াল করে না।’
আমরা জীবন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি; কিন্তু গাজায় জীবন আর আগের মতো নেই। আমরা এই বিমান হামলা থেকে বেঁচে গেছি; কিন্তু আমরা কি সত্যিই এই যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেছি?
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম র স ব ম আম দ র প ইসর য করল ম
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।