মুক্তিযুদ্ধ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এটি পূর্বাপর কোনো ঘটনার সঙ্গে তুলনীয় নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সব আমলেই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের বয়ানগুলো পক্ষপাতদুষ্ট। যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে, তখন তাদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছে।
স্বাধীনতার পর বেতার-টেলিভিশন খুললে মনে হতো, মুক্তিযুদ্ধ যেন আওয়ামী লীগের একার যুদ্ধ ছিল। তখন বেতার-টেলিভিশন-রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অন্য দল ও ব্যক্তির ভূমিকা স্থান পেত না। অথচ অন্যান্য দলও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিল। ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফ্ফর), কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিংহ) ও মনোরঞ্জন ধরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেস মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মণি সিংহ ও মনোরঞ্জন ধর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। এর বাইরে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টিসহ আরও বেশ কিছু বাম সংগঠন মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে একটি র্যাডিক্যাল ধারা ছিল, যারা স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করে নতুন দল জাসদ গড়ল; তখন তাদের অবদানও উল্লেখ করা হতো না। তাজউদ্দীন আহমদ যেদিন মুজিব মন্ত্রিসভা থেকে মন্ত্রিত্ব হারালেন, সেদিনই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা মুছে গেল!
একাত্তরে বাঙালি অফিসার ও সিপাহিরা সেনা ছাউনি থেকে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এসে প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা করেছিল। তারাই ছিল রণাঙ্গনের মূল শক্তি। স্বাধীনতা-উত্তর তাদের কথাও বেতার-টেলিভিশন বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে শোনা যেত না।
একাত্তরের যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে সৈনিক-ছাত্র-জনতা অস্ত্র তুলে ধরেছিল। কৃষকের পর্ণ কুটির পরিণত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দুর্গে। লাখ লাখ নরনারী-শিশু প্রাণ দিয়েছিল; অগণিত নারী ধর্ষণের নির্মম শিকার হয়েছিল; এক কোটি লোক উদ্বাস্তু হয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল; অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংখ্যার কেউ হিসাব রাখেনি। তবে আন্দাজ করা যায়, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারীদের চেয়ে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংখ্যা দুই/তিন গুণ। জনগণের এই গৌরবময় ভূমিকা সব আমলেই উপেক্ষিত।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে অবস্থা বদলে গেল। বেতার-টেলিভিশন-রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের কথা ঘটা করেই প্রচার হতে লাগল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যে রাজনৈতিক যুদ্ধ; দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল– সেই ইতিহাস চাপা পড়ে গেল। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ কারও নাম উচ্চারিত হতো না। উচ্চারিত হতো না মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কথাও। মনে হতো, মুক্তিযুদ্ধ ছিল যেন কেবলই সামরিক যুদ্ধ।
বিগত শতাব্দীর আশির দশকে দেশে নানা কারণে ভারত-বিদ্বেষ বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে হোক বা অন্য কারণে; মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অবদানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হতো। এখনও হয়। এটি অর্থহীন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের এক শ্রেণির জেনারেল-সাংবাদিক-লেখকের ভূমিকাও অগ্রহণযোগ্য। তারা বিস্মৃত হয়েছেন– ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনী হিসেবে অংশ নিয়েছিল। এসব জেনারেল-সাংবাদিক-লেখক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ বলছেন। তারা এও বলছেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। আসলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর (ভারতীয় বাহিনী) সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল; ভারতীয় বাহিনীর কাছে নয়। এ অপতথ্যের প্রতিবাদ জানাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সর্বদাই উদাসীন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানা অপতথ্যের সুযোগ নিয়েছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করেছিল। খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট প্রভৃতি অপকর্মে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। তাদের অন্যতম জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে এখনও বহাল তবিয়তে। দলটি কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও বিএনপির সঙ্গে মিলে শক্তি সঞ্চয় করেছে। বিভিন্ন সময়ে একাত্তরের অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি উঠলেও তারা অতীতে তা আমলে নেয়নি, এখনও নিচ্ছে না। জামায়াত শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল। সেই সুবাদে নিজেদের এখন দেশপ্রেমিক বলে পরিচয় দিচ্ছে এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ছড়াচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপতথ্য-অপপ্রচারে তরুণ প্রজন্মের কোনো কোনো অংশ বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তির পেছনে শেখ হাসিনার বিগত ১৫ বছরের স্বৈরশাসন বড় ফ্যাক্টর। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় ও পারিবারিকীকরণ করেছিলেন। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা তারস্বরে চিৎকার করে যা বলতেন, তার মর্মকথা এই– ‘স্বাধীনতা এনেছেন বঙ্গবন্ধু। আর দেশ চালাবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।’ নির্বাচন, গণতন্ত্র কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে, ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে এবং ২০২৪ সালে ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করে সরকার গঠন করেছে। এসব অপকর্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের নামে। তাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ক্ষোভ উগরে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরালের ওপর। মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মারক হয়েছিল বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার লক্ষ্যবস্তু। এসব ধ্বংসযজ্ঞের নেপথ্যে হয়তো স্বাধীনতাবিরোধীদের হাত ছিল; সেই সঙ্গে ছিল জন-আক্রোশ।
এটি দুঃখজনক যে, অন্তর্বর্তী সরকারও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভুল রাজনীতিতে পা দিয়েছে। গত ২২ মার্চ সমকালে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী চারশ রাজনীতিবিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না। তাদের পরিচয় হতে যাচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। সমকালের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত ১০ মার্চ কার্যপত্রে (খসড়াসহ অন্যান্য বিষয়) স্বাক্ষর করেছেন। এখন এটি নাকি চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার না জানার কথা নয়– মুক্তিযুদ্ধ ছিল রাজনৈতিক যুদ্ধ। রাজনৈতিক নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব দানকারী নেতারা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। কী হাস্যকর ব্যাপার!
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ‘স্বাধীনতা পেয়েছি’ বলে বক্তব্য শুনেছি। তখন মনে হয়েছিল, বিষয়টি আবেগতাড়িত। পরে যখন দ্বিতীয় রিপাবলিকের বক্তব্য শুনলাম; দাবি উঠল দ্বিতীয় রিপাবলিকের কথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য, তখন এটি আবেগের ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রশ্ন জাগে, এর পেছনে অন্য কোনো রাজনীতি আছে কিনা!
মুক্তিযুদ্ধের ফসল ১৯৭২ সালের সংবিধান। এর মানে এই নয় যে, সংবিধানটি একশ ভাগ নির্ভুল। তা ছাড়া স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সংবিধান অনেক সংশোধনীর কাঁচিতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিছু অগণতান্ত্রিক বিধি-বিধান যুক্ত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের পথে বাধা। তাই বিগত ১৫ বছর এবং তারও আগে থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে দাবি রয়েছে– সংবিধান সংশোধন করতে হবে; সংবিধানের গণতন্ত্রায়ন করতে হবে। বলা বাহুল্য, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দেশ পরিচালনার মূলনীতি বাতিলের দাবি করা হয়নি; কখনও কোনো রাজনীতিকের মনে দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের চিন্তাও উদয় হয়নি। অথচ সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে প্রজাতন্ত্রের নাম ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার কথা বলা হয়েছে। তবে ওই প্রস্তাব অনুসারে ইংরেজিতে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ পরিবর্তন হবে না। রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) স্থলে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে প্রস্তাবিত ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রের’ বিরোধ নেই। বরং সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকারের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত।
ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিলের সুপারিশ করা হলেও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা হয়েছে। প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ ৫.
বলা হচ্ছে, ‘দেশ পরিচালনার এই চার মূলনীতি নাকি আওয়ামী লীগের নীতি। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের উৎখাতের মধ্য দিয়ে চার মূলনীতির প্রতি অনাস্থা প্রকাশিত হয়েছে।’ এই চার মূলনীতির অন্যতম গণতন্ত্র নিয়ে কমিশনের আপত্তি নেই (কমিশন সংবিধানের মূলনীতিতে গণতন্ত্র সন্নিবেশিত রাখার সুপারিশ করেছে)। তাদের যত আপত্তি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে।
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নিয়ে গণপরিষদের ভেতরের ও বাইরের কোনো দল প্রশ্ন তোলেনি। পাকিস্তানের ২৩ বছর ধরে গণতন্ত্রের সংগ্রাম ছিল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দলের ঘোষণায় ছিল শোষণমুক্তি ও সমাজতন্ত্র। তারই প্রতিফলন ষাটের দশকের সেই হৃদয়মথিত ধ্বনি– কেউ খাবে, কেউ খাবে না/ তা হবে না, তা হবে না; মুক্তির একই মন্ত্র/ সমাজতন্ত্র সমাজতন্ত্র। শুরুতে আওয়ামী লীগ এ ধ্বনি তোলেনি। বামরা তুলেছিল; আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ কর্মীরা কণ্ঠ মিলিয়েছিল। এ দাবি বুকে ধারণ করেই একাত্তরের তরুণ-অরুণেরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল; জীবন উৎসর্গ করেছিল। সেই রক্তে-লেখা জাতীয় দাবি মুছে ফেলা কি এত সহজ!
বিগত শতাব্দীর চল্লিশ দশকজুড়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত ছিল; রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়েছিল। ১৯৪৭-উত্তর পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামের কাফেলায় শরিক হয়েছিল। রাজপথে একযোগে আওয়াজ তুলেছিল– ধর্মের নামে শাসন করা চলবে না; ধর্মের নামে শোষণ করা চলবে না। এ ধ্বনির মর্মবাণী অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা। একাত্তরে মানুষের যেমন আরাধ্য ছিল গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, তেমনি আরাধ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র; ধর্মরাষ্ট্র নয়। আন্দোলনের ফসল হিসেবেই ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র সংবিধানে এসেছে, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।
ভাষা থেকেই ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি, যা ছিল মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম চালিকাশক্তি। তবে তা বহু ধর্ম ও জাতি অধ্যুষিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি করা উচিত কিনা– এ নিয়ে ১৯৭২ সালেই মতদ্বৈধতা ছিল। গণপরিষদ অধিবেশনে জাতীয় পরিচয় বাঙালি করার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বাঙালি নই। আমাদের বাপ-দাদা কখনও বলেন নাই যে, আমরা বাঙালি।’ তিনি বাংলাদেশি পরিচয়ের কথা তুলে ধরেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যুক্তিযুক্ত। সুদীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল সত্য, তবে একাত্তরে মুক্তিসংগ্রাম কেবল বাঙালির সংগ্রাম থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশাপাশি গারো, সাঁওতাল, মুন্ডা, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খাসিয়া, মণিপুরিসহ এই জনপদের সব জাতিগোষ্ঠী যোগ দিয়েছিল। তাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘বাংলাদেশ নেশন’ ধারণাই বিকশিত হয়েছিল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংগত দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়।
পরবর্তী সময়ে রাজনীতিকদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন ঘটেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬.২-এ রয়েছে– ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ এ অনুচ্ছেদে নাগরিক পরিচয়ের সমাধান মিলেছে। সমস্যা হয়ে আছে জাতি হিসেবে বাঙালি– এই একক পরিচয়টি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি ও আদিবাসী অথবা গারো, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মণিপুরি, খাসিয়া প্রভৃতি জাতির নাম সংযুক্ত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে অনুচ্ছেদ ৯-এ জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যায়ও বাঙালির পাশাপাশি আদিবাসীর কথা উল্লেখ করাও সংগত। আদিবাসী জনগোষ্ঠীও অনুরূপ দাবি করে আসছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬.২ ও ৯ সংশোধনের মধ্য দিয়ে এ সমস্যার সুরাহা সম্ভব।
আমি মনে করি, দেশের সাংবিধানিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে রাজনীতির আলোচিত ইস্যুর দিকেই নজর দেওয়া প্রয়োজন। সরকার ও সংসদের মেয়াদ চার বছর করা; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা; দুই টার্মের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা; দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা করা; সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি; নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন; বিরোধী দল থেকে সংসদে ডেপুটি স্পিকার, সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান করা ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা সংগত। এসব বিধিবিধান সংযোজন জাতীয় সংসদই করতে পারে। এ জন্য গণপরিষদের প্রয়োজন নেই।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের অগ্রসৈনিক তরুণদের একাংশ সংবিধান বাতিল, নতুন সংবিধান প্রণয়ন, গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে। তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কারও প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই। তারা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশপ্রেমের যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে, তা অনন্য। এই তরুণ তুর্কিদের নিয়ে আমরা গর্ব করি। তবে একাত্তর তারা দেখেনি; তারা একাত্তরের পরাজিত শক্তির বর্বরোচিত ভূমিকাও প্রত্যক্ষ করেনি। তাই একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সতর্ক নয়। এ অপশক্তি একাত্তরের বদলা নিতে; মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন মুছে ফেলতে স্বাধীনতার পর থেকেই তৎপর। ১৯৭২ সালের সংবিধানসহ মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন, সব স্মারক ধ্বংস করা তাদের এজেন্ডা। তাই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী তরুণ বীরদের প্রতি আমার মিনতি– ‘তোমরা একাত্তরের ঘাতকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ো না; একাত্তরের আলোতে পথ চলো। এই পথেই তোমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।’
যে জাতি তার ইতিহাস-ঐতিহ্য-গৌরব গাথা ধারণ করতে পারে না, সে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। উজ্জ্বল আলোকিত ভবিষ্যতের জন্য আমাদের বারবার একাত্তরের কাছে ফিরে যেতে হবে; মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা ধারণ করেই পথ চলতে হবে; এর কোনো বিকল্প নেই।
আবু সাঈদ খান: মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক; উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ল ই আগস ট গণঅভ য ত থ ন ও গণতন ত র ১৯৭২ স ল র জন ত ক অন চ ছ দ স ব ধ নত প রস ত ব সরক র র উপদ ষ ট ট র পর হয় ছ ল ত হয় ছ র পর চ মন ত র কর ছ ল আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়
নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই কিছু পরিচিত দৃশ্য আবার চোখে পড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ অবস্থানকে একমাত্র ন্যায়সংগত দাবি হিসেবে তুলে ধরা, ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থতা এবং একে অপরের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা। রাজনৈতিক অচলাবস্থা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিকে শুধুই অচলাবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এটি বরং রাজনৈতিক চিন্তার দেউলিয়াত্বের প্রকাশ এবং রাজনীতি জনগণের চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার একটি সংকেত। এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি প্রশ্ন, যা আমরা এখনো করিনি: রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ আসলে কী?
২.
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের জাতীয়তাবাদের অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে—কখনো ‘বাংলাদেশি’ বনাম ‘বাঙালি’, কখনো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বনাম ‘ইসলামপন্থা’ পরিচয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই শব্দগুলো বাস্তবে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে; একদিকে জাতিসত্তার বৈচিত্র্যকে একরৈখিক করে তুলেছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘু এবং নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।
এই জাতিগত ও আদর্শগত পরিচয়ের সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও। রাজনৈতিক দলগুলো জনসেবার বাহন না হয়ে পরিণত হয়েছে আত্মরক্ষামূলক ক্ষমতার বাহনে। পুরোনো দলগুলো যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, গরিবের পক্ষে কথা বলার দাবি করা বিভিন্ন বামপন্থী দল, এমনকি নাগরিকদের সক্রিয়তা নিয়ে কথা বলা নতুন দল এনসিপিও একই ছকে চলছে; প্রকাশ্যে জনগণের নামে বৈধতা চাওয়া আর ভেতরে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে দল চালানো।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল আনুগত্যের বিনিময়ে সুযোগের এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। দলগুলো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে, পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণ করে এবং অনুগত একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখে। স্থানীয় সরকার, যেখানে গণতন্ত্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকার কথা, তা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্রের স্বল্প ইতিহাস বলে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা প্রায়ই জনগণের পক্ষে কথা বলা প্রতিনিধি নন, বরং তারা মধ্যস্থতাকারী মাত্র। এই ব্যবস্থায় নেতৃত্ব নয়, আনুগত্যই পুরস্কৃত হয়।
৩.
প্রায় সব রাজনৈতিক দলই অভ্যন্তরীণ দলীয় কার্যক্রমের দিক থেকে গণতান্ত্রিক নয়। নেতৃত্ব প্রায়ই বংশগত বা দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়াভাবে ধরে রাখা হয়। দলের মধ্যে ভিন্নমত দিলে শাস্তি হয়। কর্মীরা মিছিল-মিটিং বা গ্রেপ্তারে সামনে থাকলেও, নীতিনির্ধারণে তাঁদের কোনো অংশ থাকে না। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের এই অভাব বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। দলগুলো এখন প্রায় শূন্য খোলসে পরিণত হয়েছে।
সংসদেও এর প্রতিফলন স্পষ্ট। অনেক সংসদ সদস্যই তাঁদের নির্বাচিত এলাকার বাসিন্দা নন। তাঁরা সেসব এলাকায় বড় হননি, সেখানকার মানুষের সঙ্গে বসবাসও করেন না—সম্পর্ক থাকে কেবল প্রতীকী; বরং প্রাক্তন মন্ত্রী, নেতা কিংবা দলের উচ্চপদস্থ সদস্যদের সন্তান-স্বজনদেরই একপ্রকার উত্তরাধিকারসূত্রে সেখানে পাঠানো হয়। স্থানীয় নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রায়ই একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। রাজনীতির প্রতিটি স্তরে—থানা ইউনিট থেকে জাতীয় মনোনয়ন পর্যন্ত—ক্ষমতার প্রবেশাধিকার নির্ধারিত হয় বংশানুক্রম, আনুগত্য এবং আঞ্চলিকতার এক অঘোষিত নিয়মে; যেখানে কোনো নির্দিষ্ট এলাকা একটি নির্দিষ্ট পরিবার বা গোষ্ঠীর সম্পত্তির মতো গণ্য হয়।
নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয়বহুল এবং মনোনয়ন একটি লেনদেনভিত্তিক প্রক্রিয়া—সম্পদ, সম্পর্ক এবং আনুগত্যই এখানে মুখ্য। নির্বাচন মানে পোস্টার, মাইকিং আর আগেভাগে অর্থ ব্যয় করে মিছিল-মিটিংয়ের মৌসুম। সাধারণ নাগরিকের জন্য রাজনীতিতে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব—যতক্ষণ না তিনি একই স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও সুবিধাবাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করেন। এমনকি যাঁরা সাম্প্রতিক সময়ে বিপ্লবী ভাষায় কথা বলছিলেন, তাঁরাও দ্রুত এই একই ছকে ঢুকে পড়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলো যখন তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখন অন্যরা সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসে। সুশীল সমাজ নিজেদের গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষক মনে করতে শুরু করে। আমলারা ও বিচারপতিরা নিজেদের সাংবিধানিক সীমার বাইরে গিয়ে হস্তক্ষেপ করেন। সেনাবাহিনী নিজেদের একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু এটি গণতন্ত্রের সুস্থ বিকাশ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক বিকৃতি ও শাসনক্ষমতার দায়িত্বহীন পুনর্দখল।
৪.
এমন পরিস্থিতিতে মানুষের প্রকৃত চাহিদাগুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়। ত্রাণ বিতরণ হয় দলের পতাকা লাগিয়ে, ছবি তোলা হয় এবং বিনিময়ে ভোট চাওয়া হয়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ভোটার, যাঁদের বেশির ভাগই গ্রামীণ ও দরিদ্র, তাঁদের দয়া নয়, অধিকার প্রয়োজন। তাঁরা একটি বৈষম্যমূলক ও বিকৃত ব্যবস্থার শিকার—যেখানে সুবিধা, সম্পদ ও সুযোগ বণ্টিত হয় ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছেমতো। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই এমন কোনো কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলে না, যা এই বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। কারণ, এমন সংস্কার বাস্তবায়ন করলে যে ব্যবস্থা থেকে তাঁরা লাভবান হচ্ছেন, সেটাই বদলে দিতে হবে।
কেউ ভূমি সংস্কার, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কিংবা পুলিশের নিয়োগপদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে চায় না। যেখানে সংস্কার থেমে যায়, সেখানে ক্ষমতা শুরু হয়। কাঠামোগত সংস্কার কোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা কৌশল নয়। স্পষ্ট করে বললে, এ ধরনের পরিবর্তন নির্বাচনের আগে সমীচীন নয় আর এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এর বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। এমন সংস্কার সফল হতে হলে একটি এমন সরকার প্রয়োজন, যারা সংবিধানকে শুধু ভাষণে নয়, বরং বাজেট, প্রাতিষ্ঠানিক নকশা এবং নীতিনির্ধারণে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।
বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত আদর্শগত মতপার্থক্য নয়—এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াই। অতীতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত প্রভাবশালীদের রক্ষা করতে এবং ভিন্নমত দমন করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি নাগরিক সমাজের আন্দোলনগুলোকেও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বা অভিজাত গোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। জনতার আন্দোলন প্রচার পায়; কিন্তু পরে তা দমন করা হয় অথবা নিস্তেজ হয়ে যায়। এনজিওগুলোর গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে আশার কথা শোনা যায়, কিন্তু সেখান থেকে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলায় না।
৫.
এ রকম প্রেক্ষাপটে অনেকেই শুদু সংবিধানকেই দোষারোপ করছে, যেন এর দায় শুধু কাগজের শব্দগুলোর, যারা বছরের পর বছর সংবিধান উপেক্ষা করেছে, তাদের নয়। বাংলাদেশের সংবিধান ছিল একটি প্রতিশ্রুতি—কেবল সার্বভৌমত্বের নয়, বরং ন্যায়বিচারের। এই সংবিধান রাষ্ট্রকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সমতা, বৈষম্যহীনতা, মর্যাদা, ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের। এটি এমন এক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতিসত্তার ছবি এঁকেছিল, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, বরং প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মর্যাদা স্বীকৃত।
সংবিধানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরিণতি বাস্তব এবং গভীর। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা, পুলিশি নির্যাতন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি—এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো একটি কাঠামোগত চিত্রের অংশ, যা বারবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এই চক্রে কোনো একক দল বা সরকার সম্পূর্ণভাবে দায়ী নয়। ঠিক এই কারণেই প্রয়োজন একটি সামগ্রিক জবাবদিহি, কেবল একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি।
যদি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি না থাকে, আর যদি নির্বাচন কেবল ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, তবে এটি শুধু শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়—এটি একটি প্রজন্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ১৯৯১ সালের পর যারা বড় হয়েছে, তাদেরকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা পেয়েছে ক্ষমতাবানদের মধ্যে বোঝাপড়া, যেখানে জনতার কণ্ঠ নেই; বিপ্লবের বুলি আছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তন নেই।
এর ফলে আবারও সেই প্রশ্ন ফিরে আসে—রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ আসলে কী? তারা কার কাছে জবাবদিহি করবে? তাদের কাজ কি শাসন, দখল নাকি জনগণের সেবা? যদি রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সেবা না করে, তাহলে সেটা করবে কে?
ড. সিনথিয়া ফরিদ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, শিক্ষক ও গবেষক