শাহরিয়ার বিন মতিনের ঈদ মানেই ছিল বাবার সঙ্গে ঈদগাহে যাওয়া। মায়ের হাতের চিকেন বিরিয়ানি খাওয়া, বোনকে নিয়ে আনন্দ করা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শাহরিয়ারের মৃত্যুতে এবারের ঈদে কোনো আনন্দ নেই তাঁর পরিবারে। আনন্দের বদলে সঙ্গী হয়েছে বেদনা। ঈদের আনন্দঘন দিন সামনে রেখে কান্না করে সময় কাটছে মা–বাবা ও দাদির।

শাহরিয়ার বিন মতিনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগ ইউনিয়নের কুমড়াশাসন উত্তরপাড়া গ্রামে। শেখ আবদুল মতিন ও মা মমতাজ বেগমের একমাত্র ছেলে তিনি। তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া শেখ মুনতাহিনা স্মাইল (৮) নামে শাহরিয়ারের এক ছোট বোন আছে।

স্বজনেরা জানান, বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকার কুড়িল কুড়াতলী বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে শাহরিয়ারের পরিবার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে এইচএসসি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার গত বছরের ১০ জুলাই ঢাকায় মায়ের কাছে চলে গিয়েছিলেন। পরে মিরপুর-২ নম্বরে খালার বাসায় বেড়াতে যান। সেখান থেকে আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৮ জুলাই বিকেলে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হন। গুলি ডান চোখের পাশ দিয়ে ঢুকে মাথা ভেদ করে বের হয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ জুলাই শাহরিয়ার মারা যান। পরে ময়নাতদন্তের পর লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। এইচএসসি পরীক্ষা অসম্পন্ন করে মারা গেলেও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে ঘোষিত ফলাফলে শাহরিয়ার জিপিএ-৪.

৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

রোববার সকালে শাহরিয়ারদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে হাতে মেহেদি নিয়ে ঘুরছিল শেখ মুনতাহিনা। সে বলে, ‘হাতে মেহেদি দেওয়ার জন্য ঘুরছি। অন্য ঈদে আমার ভাই হাতে মেদেহি দিয়ে দিত। ঈদের দিন ঘুরতে নিয়ে যেত, খেলা করত আমার সঙ্গে। কিন্তু এবার ভাইয়া নাই।’

শাহরিয়ারকে বাড়ির সামনেই কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে কবরটি পরিষ্কার করা হয়েছে। ছেলের কবর দেখছিলেন বাবা আবদুল মতিন। ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছেন জানিয়ে আবদুল মতিন বলেন, ‘ছেলে হারানোর বেদনার কথা আর বলতে চাই না। ঈদের মধ্যে কষ্ট আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।’

নিজের মুঠোফোন থেকে গত রমজানের ঈদ ও কোরবানির ঈদের ছবি দেখিয়ে আবদুল মতিন বলেন, ‘ঈদের দিন সকালে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঈদগাহে যেতাম। বাড়িতে এসে একসঙ্গে খাবার খেতাম। প্রাইভেট চাকরি করায় সারা জীবন দেশের বিভিন্ন এলাকায় সন্তানদের নিয়ে থাকলেও ঈদে বাড়িতে আসতাম। পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দ হতো। স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ছবি তুলতাম। বেশি ছবি তুলতাম বলে সে (শাহরিয়ার) মাইন্ড করত। সে বলত, এত ছবি তুলো কেন? এখন সেই ছবিগুলোই স্মৃতি হিসেবে নিয়ে বেঁচে আছি।’

শাহরিয়ার হত্যার ঘটনায় ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন আবদুল মতিন। মামলার তদন্তকাজ চলছে। দ্রুত যেন বিচার নিষ্পত্তি হয়, এমন দাবি জানিয়ে আবদুল মতিন বলেন, ‘ছেলে হারানোর আমাদের সারা জীবনের কান্না, এ কান্না থামার না। আমরা আরও বেশি কষ্ট পাই, যখন দেখি দুর্নীতি-ঘুষ এখনো আছে। তখন মনে হয়, বাচ্চাদের জীবন বৃথা। যদি দেখতাম জীবনের বিনিময়ে দেশের পরিবর্তন এসেছে, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে, তাহলে শান্তি পেতাম। কিন্তু দেশ দুর্নীতিমুক্ত না দেখলে বাচ্চাদের আফসোস থাকবে, আক্ষেপ থাকবে কেন সন্তানেরা জীবন দিল।’

আবদুল মতিন বলেন, ‘আমি ২৯ বছরে বিয়ে করেছি। আমার বয়সী বন্ধুদের দেখি নাতি নিয়ে ঘুরে। তাই চিন্তা করেছিলাম, ছেলেকে ২১ বছরে বিয়ে করাব, তার মায়ের সঙ্গে সেই গল্প করতাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।’

শাহরিয়ার তাঁর গ্রামে ‘রাজ’ নামে পরিচত ছিলেন। তাঁর দাদা মারা যান ২০২১ সালে। এরপর দাদি একা থাকায় এবং উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সুবাদে দাদির কাছে থাকতেন তিনি। আদরের নাতি হারিয়ে রওশন আরা বেগম বলেন, ‘হাসিনা আমার নাতিরে গুলি কইরা মারাইছে। আমি হাসিনার বিচার চাই। হাসিনার লাগি আমার নাতি কবরে, আমার বাড়িতে ঈদ নাই।’

শাহরিয়ার যে ঘরে থাকত, সেই ঘর গুছিয়ে রাখা হয়েছে। বইপত্র তাকে তুলে রাখা হয়েছে। ছেলে হারানোর বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছে পরিবারটি। শাহরিয়ার চিকেন বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করত জানিয়ে মা মমতাজ বেগম বলেন, ‘ছেলে চলে যাওয়ার পর আর রান্না করিনি বিরিয়ানি। আমার হাতে বিরিয়ানি রান্না হবে না। রোজায় আলুর চপ পছন্দ করত। ঈদের নামাজ পড়ে এসেই ছেলে জড়িয়ে ধরত সালামি নিতে। কিন্তু আমার ছেলে তো আর আসবে না।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা।

মমতাজ বেগম বলেন, ‘ঈদের কেনাকাটায় ছেলের কোনো চাহিদা ছিল না। আমার পছন্দমতো যা কিনে দিতাম, তাতেই আনন্দিত হতো। চাঁদ রাতে বাড়িতে কত আনন্দ করত। কিন্তু এবার আমাদের ঈদ নাই।’ ছেলে হত্যার বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি, তাতে সন্তান হত্যার বিচার পাব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ। তবে মরার আগে সন্তান হত্যার বিচার চাই।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত ন বল ন পর ব র আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

গণঅভ্যুত্থানে আহত সামিউলের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখা বাগেরহাটের ছাত্র সামিউল ইসলাম এখন চরম অসহায়ত্ব ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছেন। হামলায় গুরুতর আহত হওয়ায় তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। এমনকি, ঠিকভাবে বসতেও পারেন না সামিউল।

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বাগেরহাট কোর্ট চত্বরে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলার শিকার হন সামিউল ইসলাম। এতে তার হাতের পেশি কেটে যায় এবং মাথা ও পিঠে গুরুতর আঘাত লাগে। নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরও পুরোপুরি সুস্থ হননি তিনি। 

এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা সামিউল ইসলামের। ২৬ জুন শুরু হতে যাওয়া পরীক্ষায় অংশ নেওয়া নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। তার পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা দাবি জানিয়েছেন, অসুস্থ শিক্ষার্থীদের জন্য যেমন পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, সেরকম ব্যবস্থা করা হোক সামিউলের জন্যও।

সামিউলের প্রতিবেশী শামসুদ্দোহা বলেছেন, “সামিউল হামলায় আহত হওয়ার পর থেকেই নানা সমস্যায় ভুগছে। সরকারিভাবে যেভাবে অসুস্থদের সহায়তা দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেভাবে তাকেও সুযোগ দেওয়া হোক।”

সামিউলের বাবা আইয়ুব আলী শেখ বলেছেন, “আমার একমাত্র ছেলে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। এখনো তার পিঠ ও হাতে ব্যথা আছে। অনেক খরচ করে চিকিৎসা করালেও উন্নতি হয়নি। সরকার যেন উন্নত চিকিৎসা ও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়।”

সামিউলের মা রুবিয়া বেগম বলেছেন, “ছাত্রলীগের হামলায় ওর যা অবস্থা হয়েছে, তা বলার মতো না। আমরা ওকে ভয়ে কোথাও নিতে পারিনি। এখন সে কিছুই করতে পারে না। পরীক্ষা দিতে পারলে হয়ত ভবিষ্যতের একটা রাস্তায় পৌঁছাতে পারত।”

সামিউল ইসলাম বলেছেন, “আমি এখনো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারি না। খেতেও কষ্ট হয়। লেখালেখি করতে পারি না। এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এখনো সুস্থ না হওয়ায় সব অনিশ্চিত হয়ে গেছে। আমি চাই, সরকার যেন আমাকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেয় এবং উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।”

আন্দোলনের সহযোদ্ধা মো. রেজুয়ান শেখ বলেন, “ছাত্রলীগ রামদা ও হকিস্টিক দিয়ে সামিউলের ওপর হামলা চালায়। সে এখন পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে কি না, তা নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাগেরহাট জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক নাঈম শেখ বলেছেন, “সামিউলের চিকিৎসা এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। সে আমাদের আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তার বর্তমান অবস্থা আমাদের ব্যথিত করে।”

রাংদিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক জাকির হোসেন বলেছেন, “সামিউল মেধাবী শিক্ষার্থী। সরকার যদি তাকে বিশেষ সুবিধা দেয়, তাহলে সে ভালো ফল করতে পারবে।”

ঢাকা/শহিদুল/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • করোনা বাড়ায় এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে বিকল্প চিন্তা
  • গণঅভ্যুত্থানে আহত সামিউলের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়
  • যথাসময়ে এইচএসসি পরীক্ষা আছে বিকল্প চিন্তাও