‘ঈদের মধ্যে কষ্ট আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে’
Published: 30th, March 2025 GMT
শাহরিয়ার বিন মতিনের ঈদ মানেই ছিল বাবার সঙ্গে ঈদগাহে যাওয়া। মায়ের হাতের চিকেন বিরিয়ানি খাওয়া, বোনকে নিয়ে আনন্দ করা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শাহরিয়ারের মৃত্যুতে এবারের ঈদে কোনো আনন্দ নেই তাঁর পরিবারে। আনন্দের বদলে সঙ্গী হয়েছে বেদনা। ঈদের আনন্দঘন দিন সামনে রেখে কান্না করে সময় কাটছে মা–বাবা ও দাদির।
শাহরিয়ার বিন মতিনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগ ইউনিয়নের কুমড়াশাসন উত্তরপাড়া গ্রামে। শেখ আবদুল মতিন ও মা মমতাজ বেগমের একমাত্র ছেলে তিনি। তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া শেখ মুনতাহিনা স্মাইল (৮) নামে শাহরিয়ারের এক ছোট বোন আছে।
স্বজনেরা জানান, বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকার কুড়িল কুড়াতলী বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে শাহরিয়ারের পরিবার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে এইচএসসি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার গত বছরের ১০ জুলাই ঢাকায় মায়ের কাছে চলে গিয়েছিলেন। পরে মিরপুর-২ নম্বরে খালার বাসায় বেড়াতে যান। সেখান থেকে আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৮ জুলাই বিকেলে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হন। গুলি ডান চোখের পাশ দিয়ে ঢুকে মাথা ভেদ করে বের হয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ জুলাই শাহরিয়ার মারা যান। পরে ময়নাতদন্তের পর লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। এইচএসসি পরীক্ষা অসম্পন্ন করে মারা গেলেও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে ঘোষিত ফলাফলে শাহরিয়ার জিপিএ-৪.
রোববার সকালে শাহরিয়ারদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে হাতে মেহেদি নিয়ে ঘুরছিল শেখ মুনতাহিনা। সে বলে, ‘হাতে মেহেদি দেওয়ার জন্য ঘুরছি। অন্য ঈদে আমার ভাই হাতে মেদেহি দিয়ে দিত। ঈদের দিন ঘুরতে নিয়ে যেত, খেলা করত আমার সঙ্গে। কিন্তু এবার ভাইয়া নাই।’
শাহরিয়ারকে বাড়ির সামনেই কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে কবরটি পরিষ্কার করা হয়েছে। ছেলের কবর দেখছিলেন বাবা আবদুল মতিন। ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছেন জানিয়ে আবদুল মতিন বলেন, ‘ছেলে হারানোর বেদনার কথা আর বলতে চাই না। ঈদের মধ্যে কষ্ট আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।’
নিজের মুঠোফোন থেকে গত রমজানের ঈদ ও কোরবানির ঈদের ছবি দেখিয়ে আবদুল মতিন বলেন, ‘ঈদের দিন সকালে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঈদগাহে যেতাম। বাড়িতে এসে একসঙ্গে খাবার খেতাম। প্রাইভেট চাকরি করায় সারা জীবন দেশের বিভিন্ন এলাকায় সন্তানদের নিয়ে থাকলেও ঈদে বাড়িতে আসতাম। পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দ হতো। স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ছবি তুলতাম। বেশি ছবি তুলতাম বলে সে (শাহরিয়ার) মাইন্ড করত। সে বলত, এত ছবি তুলো কেন? এখন সেই ছবিগুলোই স্মৃতি হিসেবে নিয়ে বেঁচে আছি।’
শাহরিয়ার হত্যার ঘটনায় ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন আবদুল মতিন। মামলার তদন্তকাজ চলছে। দ্রুত যেন বিচার নিষ্পত্তি হয়, এমন দাবি জানিয়ে আবদুল মতিন বলেন, ‘ছেলে হারানোর আমাদের সারা জীবনের কান্না, এ কান্না থামার না। আমরা আরও বেশি কষ্ট পাই, যখন দেখি দুর্নীতি-ঘুষ এখনো আছে। তখন মনে হয়, বাচ্চাদের জীবন বৃথা। যদি দেখতাম জীবনের বিনিময়ে দেশের পরিবর্তন এসেছে, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে, তাহলে শান্তি পেতাম। কিন্তু দেশ দুর্নীতিমুক্ত না দেখলে বাচ্চাদের আফসোস থাকবে, আক্ষেপ থাকবে কেন সন্তানেরা জীবন দিল।’
আবদুল মতিন বলেন, ‘আমি ২৯ বছরে বিয়ে করেছি। আমার বয়সী বন্ধুদের দেখি নাতি নিয়ে ঘুরে। তাই চিন্তা করেছিলাম, ছেলেকে ২১ বছরে বিয়ে করাব, তার মায়ের সঙ্গে সেই গল্প করতাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।’
শাহরিয়ার তাঁর গ্রামে ‘রাজ’ নামে পরিচত ছিলেন। তাঁর দাদা মারা যান ২০২১ সালে। এরপর দাদি একা থাকায় এবং উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সুবাদে দাদির কাছে থাকতেন তিনি। আদরের নাতি হারিয়ে রওশন আরা বেগম বলেন, ‘হাসিনা আমার নাতিরে গুলি কইরা মারাইছে। আমি হাসিনার বিচার চাই। হাসিনার লাগি আমার নাতি কবরে, আমার বাড়িতে ঈদ নাই।’
শাহরিয়ার যে ঘরে থাকত, সেই ঘর গুছিয়ে রাখা হয়েছে। বইপত্র তাকে তুলে রাখা হয়েছে। ছেলে হারানোর বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছে পরিবারটি। শাহরিয়ার চিকেন বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করত জানিয়ে মা মমতাজ বেগম বলেন, ‘ছেলে চলে যাওয়ার পর আর রান্না করিনি বিরিয়ানি। আমার হাতে বিরিয়ানি রান্না হবে না। রোজায় আলুর চপ পছন্দ করত। ঈদের নামাজ পড়ে এসেই ছেলে জড়িয়ে ধরত সালামি নিতে। কিন্তু আমার ছেলে তো আর আসবে না।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা।
মমতাজ বেগম বলেন, ‘ঈদের কেনাকাটায় ছেলের কোনো চাহিদা ছিল না। আমার পছন্দমতো যা কিনে দিতাম, তাতেই আনন্দিত হতো। চাঁদ রাতে বাড়িতে কত আনন্দ করত। কিন্তু এবার আমাদের ঈদ নাই।’ ছেলে হত্যার বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি, তাতে সন্তান হত্যার বিচার পাব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ। তবে মরার আগে সন্তান হত্যার বিচার চাই।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ন বল ন পর ব র আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
দিনে ঢাকায় মিছিল, রাতে বাড়িতে ফিরতেই নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ৩ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার
রাজধানীর উত্তরায় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ জেলা শাখার ব্যানারে মিছিলে অংশ নেওয়ার পর রাতে বাড়িতে ফিরতেই তিন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার তিনজন হলেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি নূর হামীম রুশো (২০), ছাত্রলীগ কর্মী আলিফ জাহান ওরফে পার্থ (২০), মো. মারুফ মিয়া (২৫)। তাঁরা সবাই ঈশ্বরগঞ্জ পৌর শহরের বাসিন্দা।
আজ শনিবার বিকেলে গ্রেপ্তার তিনজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে আদালতে পাঠানো হয়। এর আগে গতকাল শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের ব্যানারে ঢাকায় মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা।
ঈশ্বরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, বিশেষ অভিযান চালিয়ে ছাত্রলীগের তিন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা রাজধানীর উত্তরার মিছিলে অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।