নতুন বাংলাদেশে উগ্রবাদ উত্থানের শঙ্কা, প্রতিবেদনকে বিভ্রান্তিকর বলছে সরকার
Published: 1st, April 2025 GMT
বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উত্থানের শঙ্কা প্রকাশ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস। গতকাল সোমবার রাতে পত্রিকাটি অনলাইনে ওই সংবাদ প্রকাশ করেছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আজ মঙ্গলবার এই প্রতিবেদনকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছে। সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টসের ফেসবুক পেজে বলা হয়, ভুল চিত্র ও একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়, নারীর শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে উগ্রবাদীরা বিষয়টি শুরু করেছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী নেতাকে উৎখাতের পর একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতার মধ্যে একটি শহরের ধর্মীয় মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, তরুণীরা আর ফুটবল খেলতে পারবে না। আরেকটি শহরে এই মৌলবাদীরা এমন এক ব্যক্তিকে ছেড়ে দিতে পুলিশকে বাধ্য করেছে, যিনি হিজাব না পরায় প্রকাশ্যে এক নারীকে হেনস্তা করেছিলেন। পরে তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়।
এরপর আরও নির্লজ্জ আহ্বান জানানো হয়েছে। ঢাকায় এক সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, সরকার যদি ইসলাম অবমাননাকারীদের মৃত্যুদণ্ড না দেয়, তাহলে তাঁরাই তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবেন। এর কয়েক দিন পর একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত গোষ্ঠী ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে বড় মিছিল করেছে।
বাংলাদেশ যখন গণতন্ত্র পুনর্নির্মাণ ও সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের জন্য নতুন এক ভবিষ্যৎ তৈরির চেষ্টা করছে, তখন দীর্ঘ দিন ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইসলামি উগ্রপন্থীরা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে।
ইসলামপন্থী বেশ কয়েকটি দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা, যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি আগে নিষিদ্ধ ছিল—বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তাঁরা বাংলাদেশকে আরও মৌলবাদী পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছেন। এই পরিবর্তন দেশের বাইরে থেকে খুব সামান্যই নজরে এসেছে।
ইসলামপন্থী নেতারা জোর দিয়ে বলছেন, বাংলাদেশে এমন একটি ‘ইসলামি সরকার’ হোক, যে সরকার ইসলাম অবমাননাকারীদের শাস্তি দেবে এবং ‘শালীনতা’ প্রতিষ্ঠা করবে। এই অস্পষ্ট ধারণাগুলো অন্যান্য জায়গায় বেআইনি কর্তৃপক্ষের শাসন বা ধর্মতান্ত্রিক শাসনের পথ তৈরি করে দিয়েছে।
নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরির সঙ্গে জড়িত আছেন—এমন কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, এই খসড়ায় বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়টি বাদ দেওয়া হতে পারে। সেখানে বহুত্ববাদ প্রতিস্থাপন করা হবে এবং দেশকে আরও ধর্মীয় ভিত্তিতে পুনর্গঠন করা হবে।
দেশের নিপীড়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যেসব নারী শিক্ষার্থী পথে নেমেছিলেন, তাঁদের জন্য মৌলবাদীদের এই উত্থান বিশেষভাবে বেদনাদায়ক।
নারী শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনের পরিবর্তে বৈচিত্র্যপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের এখন ধর্মীয় লোকরঞ্জনের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। তাদের লড়াই করতে হচ্ছে এমন এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, যারা হিন্দু ও ইসলামের ছোট ছোট সম্প্রদায়ের অনুসারীসহ নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান থেকে স্নাতক ২৯ বছর বয়সী শেখ তাসনিম আফরোজ এমি বলেন, ‘আমরা বিক্ষোভের সামনের সারিতে ছিলাম। আমরা রাস্তায় আমাদের ভাইদের রক্ষা করেছি। এখন পাঁচ-ছয় মাস পর দেখছি, পুরো ব্যাপারটা উল্টে গেল।’
সমালোচকেরা বলছেন, ৮৪ বছর বয়সী নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি। তাঁরা অভিযোগ করছেন, অধ্যাপক ইউনূস অপেক্ষাকৃত নমনীয়, গণতান্ত্রিক সংস্কারের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া ও সংঘাতবিমুখ। তিনি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারেননি, ফলে চরমপন্থীরা আরও বেশি জনসাধারণের স্থান দখল করে নিয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূসের সহকারীরা একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপের কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন জারি ছিল। এখন অবশ্যই বাক্স্বাধীনতা ও প্রতিবাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। কিন্তু এটি করলে মূলত চরমপন্থী দাবির জন্য একটি দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়।
শেখ হাসিনার পতনের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছে। তারা আজ নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। সামরিক বাহিনী কিছু ‘পুলিশিং দায়িত্ব’ নিয়েছে বটে, তবে তারাও অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে ক্রমেই বিরোধে লিপ্ত হচ্ছে। কারণ, ছাত্ররা অতীতের নৃশংসতার জন্য কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে চায়।
বাংলাদেশে এখন যা ঘটতে শুরু করেছে, তা মৌলবাদের এক ঢেউকে প্রতিফলিত করে, যা এই অঞ্চলকে গ্রাস করে ফেলেছে।
আফগানিস্তান একটি চরম জাতিগত ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে নারীদের মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। পাকিস্তানে উগ্র ইসলামপন্থীরা বছরের পর বছর ধরে সহিংসতার মাধ্যমে তাদের চাওয়া-পাওয়া বাস্তবায়ন করে আসছে। ভারতে একটি প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ডানপন্থী দল দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ঐতিহ্যকে খাটো করেছে। বৌদ্ধ চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমারে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানো হচ্ছে।
নাহিদ ইসলাম বলেছেন, দেশ চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার ‘ভয় আছে’। নাহিদ ইসলাম বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন, যিনি নতুন একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সরকার থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
তবে নাহিদ ইসলাম আশাবাদী, সংবিধানে পরিবর্তন আনা হলেও গণতন্ত্র, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রতি ঘৃণা করার মতো মূল্যবোধগুলো টিকে থাকবে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, বাংলাদেশে এমন কোনো রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব, যা এই মৌলিক মূল্যবোধগুলোর বিরুদ্ধে যায়।’
কেউ কেউ শিল্প ও বুদ্ধিভিত্তিক বিতর্কের গভীর ঐতিহ্যের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সংযোগের দিকে ইঙ্গিত করেন। আবার কেউ কেউ দেশের অর্থনীতির আকার নিয়ে আশার আলো দেখতে পান।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে নারীরা গভীরভাবে জড়িত। নারীদের ৩৭ শতাংশ আনুষ্ঠানিক শ্রমশক্তিতে আছেন, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ হারের একটি। এই নারীদের জোর করে ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা এই চরমপন্থী শক্তিগুলোকে একই সঙ্গে দমন ও তুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আর এই দীর্ঘ সময়ে চরমপন্থী শক্তিগুলো তাদের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে।
শেখ হাসিনা একটি পুলিশ রাষ্ট্র চালিয়েছিলেন। তাঁর সরকার ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল, যার মধ্যে মূলধারার কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিরাও ছিলেন, যাঁরা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারেন। একই সঙ্গে তিনি হাজার হাজার অনিয়ন্ত্রিত ইসলামি ধর্মীয় মাদ্রাসা অনুমোদন দিয়েছিলেন এবং শত শত মসজিদ নির্মাণে ১০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি ইসলামি দলগুলোর ধর্মীয় রক্ষণশীল অংশকে জয় করার চেষ্টা করেছিলেন।
শেখ হাসিনার বিদায়ের পর ছোট ছোট চরমপন্থী দলগুলো যারা এই ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে উল্টে দিতে চায় এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করতে চাওয়া মূলধারার ইসলামপন্থী দলগুলো—উভয় অংশই আরও মৌলবাদী বাংলাদেশের একটি যৌথ লক্ষ্যে একত্র হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী এখন একটি বড় সুযোগ দেখছে। বিশ্লেষক ও কূটনীতিকেরা বলছেন, উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক বিনিয়োগের অধিকারী এই দল দীর্ঘমেয়াদি খেলা খেলছে। অবশ্য বছরের শেষের দিকে যে নির্বাচন প্রত্যাশা করা হচ্ছে, তাতে তাদের জয়ের সম্ভাবনা কম। তারপরও দলটি মূলধারার ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর প্রতি মানুষের মনে সৃষ্ট অসন্তোষকে পুঁজি হিসেবে দেখার আশা করছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার বলেন, দলটি একটি ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র চায়। তাদের কাছে ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণে তুরস্ক হলো সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
মিয়া গোলাম পারওয়ার বলেন, ‘ইসলামে নারী ও পুরুষের আচরণ ও নীতিশাস্ত্রের দিক থেকে নৈতিক দিকনির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশনাগুলোর মধ্যে নারীরা যেকোনো পেশায় অংশ নিতে পারেন। যেমন খেলাধুলা, গান, থিয়েটার, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র ইত্যাদিতে নারীর অংশগ্রহণে বাধা নেই।’
তবে বর্তমানে রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে পুরুষেরা ইসলামি শাসনব্যবস্থায় নিজস্ব ব্যাখ্যা নিয়ে আসছেন।
স্থানীয় মেয়েদের অনুপ্রাণিত করতে কৃষিনির্ভর শহর তারাগঞ্জে গত মাসে দুটি নারী দলের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আয়োজকেরা। মেয়েরা যখন খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন শহরের এক মসজিদের নেতা আশরাফ আলী ঘোষণা দেন, নারী ও মেয়েদের ফুটবল খেলতে দেওয়া উচিত নয়।
ক্রীড়া সংগঠকেরা সাধারণত শহরের বিভিন্ন স্থানে রিকশায় লাউডস্পিকার বেঁধে খেলার ঘোষণা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আশরাফ আলীও তাঁর নিজস্ব লোকদের পাঠিয়ে লাউডস্পিকার লাগিয়ে খেলা দেখতে না যেতে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করতে থাকেন।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি নারী খেলোয়াড়েরা যখন ড্রেসিংরুমে জার্সি পরছিলেন, তখন স্থানীয় কর্মকর্তারা খেলাটি নিয়ে একটি সভা করছিলেন। আয়োজকদের একজন সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করতে প্রয়োজনে আশরাফ আলী শহীদ হবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।’
পরে স্থানীয় প্রশাসন নতি স্বীকার করে, খেলা বাতিল ঘোষণা করে এবং এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
ওই ম্যাচে খেলতে বাসে চার ঘণ্টা ভ্রমণ করে এসেছিলেন ২২ বছর বয়সী তসলিমা আক্তার। তিনি বলেন, তিনি অনেক গাড়ি, সেনাবাহিনী ও পুলিশ দেখেছেন। তাঁরা খেলোয়াড়দের বলেছিলেন, ম্যাচটি বন্ধ।
তসলিমা আক্তার আরও বলেন, তাঁর এক দশকের ফুটবল খেলোয়াড়ি জীবনে এই প্রথম তিনি এমন বিরোধিতার মুখোমুখি হলেন।
তসলিমা বলেন, ‘কী হতে পারে, তা নিয়ে আমি এখন একটু ভীত।’
কয়েক সপ্তাহ পর নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েক ডজন সদস্যের উপস্থিতিতে আয়োজকেরা নারীদের একটি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করেন। তবে সতর্কতা হিসেবে তাঁরা তরুণীদের তাঁদের হাফপ্যান্টের নিচে স্টকিংস পরতে বলেছিলেন।
উগ্রপন্থীদের অবিরাম হুমকির মুখে আয়োজকেরা বলেছেন, তাঁরা নিশ্চিত নন, তাঁরা আবার ঝুঁকি নেবেন কিনা।
মসজিদের ইমাম আশরাফ আলী এক সাক্ষাৎকারে গর্বভরে বলেন, তারাগঞ্জের মতো গ্রামীণ এলাকায় নারীদের ফুটবল ‘অশ্লীলতা’ বাড়াবে।
নারীদের খেলাধুলা ছিল আশরাফের সর্বশেষ লক্ষ্য। বছরের পর বছর ধরে তিনি নির্যাতিত সংখ্যালঘু আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ৫০০ সদস্যকে ওই এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের রাতেই আহমদিয়াদের উপাসনালয়ে একদল জনতা হামলা চালায়। আহমদিয়া সম্প্রদায় এখনো ভয়ের মধ্যে আছে। তাদের প্রার্থনালয়ে উপস্থিতি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে।
আহমদিয়াদের উপাসনালয়ের ধ্বংস হওয়া সাইনবোর্ড পুনর্নির্মাণ বা লাউডস্পিকার থেকে আজান দিতে দেওয়া হচ্ছে না। আশরাফ আলী এসব সহিংসতার দায় এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর মতো প্রচারকেরা ‘আহমদিয়া ধর্মদ্রোহীদের’ বহিষ্কার করা প্রয়োজন বলে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে গেছেন।
স্থানীয় আহমদিয়া শাখার সভাপতি এ কে এম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু এই ধর্মীয় নেতারা আমাদের বিরোধিতা করে থাকেন।’
বিভ্রান্তিকর বলছে সরকার
সরকার নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটিকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছে।
সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টসের ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনে ধর্মীয় উত্তেজনা ও রক্ষণশীল আন্দোলনের কিছু ঘটনা তুলে ধরলেও এটি অগ্রগতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করেছে বলে মনে করে সরকার। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ‘উদ্বেগজনক ও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি’ তুলে ধরা হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় দেশটি ‘ধর্মীয় চরমপন্থার দ্বারপ্রান্তে’ রয়েছে। এই চিত্র কেবল দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে অতিসরলীকরণই করে নয়, বরং ১৮ কোটি মানুষের পুরো জাতিকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার ঝুঁকিও তৈরি করেছে বলে মনে করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ নারীদের অবস্থার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণে বিশেষভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটি এমন একটি সরকার, যা নারীর অধিকার ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু বাস্তব চিত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে, যা হতাশাজনক।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ নেননি’ বলে প্রতিবেদনের আরেকটি দাবি শুধু মিথ্যাই নয়, এটি নারীর ক্ষমতায়নে তার আজীবন অঙ্গীকারকেও উপেক্ষা করে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস নারী অধিকারের পক্ষে তাঁর অবস্থানে অবিচল ছিলেন। দুই মেয়ের বাবা অধ্যাপক ইউনূস পুরো কর্মজীবন এবং গ্রামীণ ব্যাংককে গড়ে তুলেছেন নারীর ক্ষমতায়নের গভীর বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে, যা তাঁকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে। নারীর অধিকারকে এগিয়ে নেওয়া ও তাঁদের স্বাধীনতা রক্ষায় আত্মোৎসর্গ তাঁর কাজ ও খ্যাতির মূল ভিত্তি।
এতে আরও বলা হয়, গত আট মাসে ৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস যে অবিশ্বাস্য কাজ করেছেন, তার স্বীকৃতি কোথায়? বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। গত সপ্তাহে তাঁর চীন সফরের সময় চীন সরকার ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে ২১০ কোটি ডলার ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আগামী সপ্তাহে ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলন হবে, যেখানে মেটা, উবার এবং স্যামসাংয়ের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ৫০টি দেশের ২ হাজার ৩০০ জন অংশ নেবেন। বাংলাদেশকে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্ববাসী ক্রমেই স্বীকৃতি দিচ্ছে।
ধর্মীয় সহিংসতা সম্পর্কেও প্রতিবেদনে ‘ভুল ধারণা’ তুলে ধরা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে প্রেস উইং। তারা বলছে, বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মীয় সহিংসতার মধ্যে পার্থক্য করা জরুরি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদায়ের পর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের অনেকগুলোই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যদিও বাস্তবে সেগুলো ছিল মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই সমর্থন জোরদার করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে, যা বিষয়টিকে জটিল করে তোলে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ধর্মীয় নিপীড়নের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার ঝুঁকি তৈরি করে। পুরো পরিস্থিতিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হিসেবে দাঁড় করানো বিভ্রান্তিকর। কারণ, এতে প্রকৃত রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক কারণগুলোকে উপেক্ষা করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষায় তার প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করেছে এবং আইন প্রয়োগকারী ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টার সঙ্গে তার চলমান কাজ এই প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেয়। সামাজিক সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে উগ্রবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে চাপা দেওয়া উচিত নয়।
প্রেস উইং বলেছে, প্রবৃদ্ধির গতিপথ দিয়ে বাংলাদেশ নীরবে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউসে রূপান্তরিত হচ্ছে, যা বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রচুর সুযোগ সৃষ্টি করছে। সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়েছে, অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে। গত সাত মাসে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। রাজনৈতিক উত্থানের পরও ব্যাংকিং খাত অপরিবর্তিত রয়েছে এবং স্থানীয় মুদ্রা বিনিময় হার মার্কিন ডলার প্রায় ১২৩ টাকায় স্থির রয়েছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রেস উইংয়ের ভাষায়, উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়া একটি দেশের চিত্র তুলে ধরতে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে মুষ্টিমেয় কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। যেমন একজন নারীকে হেনস্তা করা একজন পুরুষ অভিযুক্তকে ছেড়ে দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটি শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, ক্ষতিকরও। ১৮ কোটি মানুষের দেশে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে গোটা দেশকে সংজ্ঞায়িত করা অযৌক্তিক। বাংলাদেশ স্থিতিস্থাপকতা, সংস্কৃতি এবং প্রগতিশীল চিন্তার সমৃদ্ধ ইতিহাসসহ একটি বৈচিত্র্যময় এবং গতিশীল সমাজ আছে।
প্রেস উইংয়ের বক্তব্যে বলা হয়, ‘ধর্মীয় উগ্রবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ একা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা অনেক দেশ নানাভাবে মোকাবিলা করে। তবে বাংলাদেশ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, সামাজিক সংস্কার ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী উদ্যোগের মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অব্যাহতভাবে কাজ করেছে। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান বা অন্য যেকোনো সম্প্রদায় তার বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে বাংলাদেশের অবিচল প্রতিশ্রুতি রয়েছে। মিছিলে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো কট্টরপন্থীরা সব সময়ই থাকবে। তবে তাঁদের ক্ষোভ মোকাবিলা করা আমাদের দায়িত্ব।’
এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস, গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রমাণ করে যে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দেশ অব্যাহতভাবে এগিয়ে যাবে। কয়েকটি নেতিবাচক উদাহরণের দিকে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে আমাদের অগ্রগতি, স্থিতিস্থাপকতা এবং দৃঢ়তার বৃহত্তর চিত্রটি স্বীকার করা উচিত, যা আজকের বাংলাদেশকে সংজ্ঞায়িত করে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন উইয়র ক ট ইমস ইসল মপন থ কর মকর ত গণতন ত র চরমপন থ র জন ত ক কর ছ ল ন র ইসল ম সরক র র পদক ষ প ইসল ম ব র ফ টবল মপন থ র ন সরক র উপদ ষ ট ব যবস থ এমন এক আহমদ য র পর ব ক র কর র র পর ক জ কর আম দ র র জন য করছ ন ক ষমত দলগ ল বলছ ন বছর র র একট ন একট আরও ব
এছাড়াও পড়ুন:
সাকিবের সঙ্গে দেখা হলে অবশ্যই বিষয়টি জানতে চাইব
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালকে সম্প্রতি বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা গেছে। অনেকে মনে করছেন, রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন বাঁহাতি এই ওপেনার। ক্রিকেটে নিজের সেকাল-একাল, রাজনীতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, বিসিবিতে যুক্ত হওয়ার গুঞ্জনসহ নানা বিষয়ে সমকালের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তামিম ইকবাল। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সেকান্দার আলী।
সমকাল : সম্প্রতি চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি তারুণ্য উৎসব মঞ্চে আপনাকে দেখা গেছে। এর পর অনেকে ভাবছেন, আপনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। আসলে কী?
তামিম ইকবাল : আমার একদমই রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা নেই। তাই বলে আমি রাজনীতিকে খারাপভাবে দেখি না। একজন সংগঠক বা ক্রিকেটারকে যেমন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষ হতে হয়, তেমনি একজন রাজনীতিবিদকেও রাজনীতিতে প্রজ্ঞাবান হতে হয়। আমার রাজনীতিতে আসার সুযোগ ছিল, কিন্তু সম্পৃক্ত হওয়ার তাগিদ বোধ করিনি। আমার ওই রাজনৈতিক যোগ্যতা নেই। হ্যাঁ, চট্টগ্রামে বিএনপির তারুণ্য উৎসবে গিয়েছিলাম, তবে রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়। আমাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে, চট্টগ্রামের স্পোর্টস নিয়ে কথা বলার জন্য। আমি বক্তব্য দেওয়ার শুরুতেই বলেছিলাম, আমি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না। আমার বক্তব্যের পুরোটা জুড়ে তাই ছিল খেলা। ২০ বছর পরে গিয়ে কী হবে, কেউ বলতে পারে না। তবে এ মুহূর্তে রাজনীতি নিয়ে ভাবছি না।
সমকাল : বিএনপি ঘরানার ক্রীড়া সংগঠকদের অনুষ্ঠানেও আপনাকে দেখা গেছে।
তামিম : ওখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের চেয়ে খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠকরা বেশি ছিলেন। যে কমিটি হয়েছে, দেখবেন সেখানে আমার নাম নেই। ক্লাব ক্রিকেট নিয়ে একটা কমিটি হতে পারে, সেখানে আমি থাকতেও পারি, নাও পারি।
সমকাল : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্রীড়া সংগঠক হতেও তো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকতে হয়।
তামিম : আমি আশা করব, এমন একজন রাজনৈতিক নেতা আসবেন, যিনি দেশের স্পোর্টসের স্বার্থে ক্রীড়াবিদদের বেছে নেবেন। স্পোর্টসের উন্নয়নে সঠিক মানুষ খুঁজে বের করবেন। আমি বলব না, আমিই সেই সঠিক মানুষ। তারা যাঁকে সঠিক মনে করবেন, তাঁকে খুঁজে নেবেন। আমি ওটার জন্য অপেক্ষা করব।
সমকাল : আপনি যে ধরনের নেতার কথা চিন্তা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে কি তাঁকে দেখা যাবে?
তামিম : এটি বলা কঠিন। আমি যেহেতু রাজনীতি করি না, তাই সব দলের কথাই বলব। নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের কথা কখনোই বলব না। নির্বাচন হলে কে জিতবে জানি না; তবে ধারণা করতে পারি। আমার কাছে মনে হয়, যারাই আসুক, তারা স্পোর্টসের লোকদের দিয়ে স্পোর্টস পরিচালনা করবেন।
সমকাল : এত আগে আন্তর্জাতিক খেলা ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার কারণ কী?
তামিম : ২০২৩ সালে আমি যখন অবসরের ঘোষণা দিই তখন অনেক মিডিয়ার ধারণা ছিল, আবেগে ছেড়েছি। আসলে আমি ছয় থেকে আট মাস ধরে সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে কোনোরকম সহযোগিতা করা হচ্ছিল না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় অবসরের ঘোষণা দিই। হ্যাঁ, যেদিন ঘোষণা দিয়েছি, সেদিন আবেগাপ্লুত ছিলাম। পরিবারের সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
সমকাল : তাহলে দলে কি আপনি একা হয়ে গিয়েছিলেন?
তামিম : আমি সব সময় সবাইকে নিয়ে গল্প করতে পছন্দ করি। আড্ডা দিতে ভালোবাসি। এসব থেকে আমাকে একা করে দেওয়া হলে ভেঙে পড়া স্বাভাবিক। এর থেকে বেশি কিছু বলতে চাই না।
সমকাল : ২০২৩ সালের বিশ্বকাপের আগে সাকিবের একটি সাক্ষাৎকারে আপনার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ তোলা হয়। সে বিষয়ে কিছু বলবেন?
তামিম : যা কিছু হয়েছে বা বলেছে, তা বলা কতটা উচিত ছিল, তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমার কাছে মনে হয়, জিনিসটা কেউই ভালোভাবে নেয়নি। ওই সময়ে যা কিছু হয়েছে, তা না হলে এখন আমরা আরও ভালো জায়গায় থাকতাম।
সমকাল : সাকিবের মন্তব্যে কষ্ট পেয়েছিলেন?
তামিম : কষ্ট পাওয়ার চেয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম বেশি। সে তার মতামত দিয়েছে। কিছু ভুল তথ্য দিয়েছে। ওখানে সাকিব একটা কথা বলেছে– আমি বেছে বেছে ম্যাচ খেলতে চেয়েছি। এটা সে কোথায় পেয়েছে? ফিজিও বলেননি, নির্বাচকরা বলেননি, আমিও বলিনি। কোনো দিন সাকিবের সঙ্গে দেখা হলে, আমরা আড্ডায় বসলে অবশ্যই বিষয়টি জানতে চাইব তাঁর কাছে।
সমকাল : গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে নিউজ হয়েছে, আপনি সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে গালি দিয়েছিলেন। এটা কি সত্য?
তামিম : না, না। একদম মিথ্যা কথা। তাঁর সঙ্গে খুবই ক্রুদ্ধ আচরণ করেছি। আমি বেশি আক্রমণাত্মক ছিলাম। তাঁর দিক থেকে কোনো খারাপ কথা বা খারাপ জবাব আসেনি। আমি শতভাগ নিশ্চিত করতে চাই– কোনো বাজে শব্দ বা গালাগাল যাকে বলা হয়, ও রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, অনেক শক্ত কথা বলেছি। যেভাবে বলেছি, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। হয়তো আরও ভালোভাবে বলতে পারতাম। তবে যা বলেছি, তার জন্য আমি দুঃখিত না। যেভাবে বলেছি, ওটার জন্য দুঃখিত হতে পারি।
সমকাল : সাকিব-তামিমের সম্পর্কে বিভেদ তৈরি করে রাখা হয়েছিল। বিষয়টা কি এমন?
তামিম : যে মানুষগুলো এখন তাদের পদে নেই, তাদের নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না। কোনো দিন মুখোমুখি হলে অবশ্যই বলব। তবে সাকিব আর আমার ঝামেলার কথা মিডিয়া অনেক আগে থেকে জানত। খেলায় প্রভাব না পড়ায় মিডিয়া কিছু লিখেনি। বিসিবি সভাপতি (নাজমুল হাসান পাপন) প্রকাশ্যে বলে দেওয়ার পর থেকে মিডিয়া লেখা শুরু করে। ২০২৩ সালে কেন বিষয়টি সামনে এনে বিভেদ তৈরি করতে হলো? এ প্রশ্নের উত্তর তারা (পাপন) ভালো দিতে পারবেন।
সমকাল : আপনাদের সম্পর্কের অবনতির কারণ কী ছিল? তারকা খ্যাতি?
তামিম : না। একদমই না। অনেকে বলে, কে কার চেয়ে সেরা। কার এনডোর্সমেন্ট বেশি। এগুলো কিছুই আমাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারেনি। আমি সব সময় বলেছি, বাংলাদেশের স্পোর্টসে সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব। আমি নিজেই যখন এটা বলি, তখন তারকা খ্যাতি সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে না। আমার মনে হয় না, সাকিবও কখনও এভাবে চিন্তা করেছে। বন্ধুত্বের মধ্যে দূরত্ব অনেক কারণেই হতে পারে। তবে আমাদের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব ঘোচাতে বিসিবি থেকে কেউ চেষ্টা করেননি। তারা আলাদাভাবে কথা বলেছেন, দু’জনকে একসঙ্গে বসিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেননি।
সমকাল : আপনি নিজে উদ্যোগ নিয়েছেন?
তামিম : অধিনায়ক হিসেবে আমি সম্পর্ক উন্নয়নে চেষ্টা করেছি। কয়েকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়নি। তবে ভবিষ্যতে হবে না, তা মনে করি না।
সমকাল : আপনার অসুস্থতার সময়ে সাকিব তাঁর ফেসবুক পেজে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। তাঁর বাবা-মা আপনাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন।
তামিম : আমরা দু’জনই পরিণত। আমাদের দু’জনের প্রতি দু’জনের কিছু রাগ-ক্ষোভ থাকতে পারে। তবে আমরা কখনও সামনাসামনি হলে এবং নিজেরা কথা বলা শুরু করলে সম্পর্কের উন্নতি হতে পারে।
সমকাল : ভারতে শেষ টেস্ট খেলেছেন সাকিব। ওই সিরিজে আপনি ছিলেন ধারাভাষ্যকার। তখন কি কথা হয়েছে?
তামিম : ওই সফরে ওর শেষ ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। তবে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না, ওটাই ওর শেষ ম্যাচ কিনা। ওটা শেষ ম্যাচ হলে আমি বক্তব্য দিতাম সাকিবের ক্যারিয়ার নিয়ে। আমি ম্যানেজারকে সেভাবে বলে রেখেছিলাম। ওকে যতটা কাছ থেকে আমি দেখেছি বা সে আমাকে যতটা দেখেছে, তা অনেকে দেখেনি। আমার মনে হয়, সবাই ‘ডিজার্ভ’ করে, সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কী করেছে– সেটা আমার মুখ থেকে শোনার। আমি খেলোয়াড় সাকিবকে নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলছি। আমার অন্য কোনো মতামত দেওয়ারও প্রয়োজন নেই, নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। খেলোয়াড় সাকিব আমার কাছে অনেক বড়।
সমকাল : বিদেশে সাকিবের সঙ্গে দেখা হলে কী করবেন?
তামিম : আমি জিজ্ঞেস করব, তুমি কেমন আছ। সব ঠিকঠাক আছে তো (হাসি)। আমি নিশ্চিত ও আমাকে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছি। পরিবার ভালো আছে কিনা। আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি– ও আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেবে না, আমি তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেব না। এটা সম্ভব না।
সমকাল : তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেগুলো দেখা যায়?
তামিম : যেগুলো দেখেন, সেগুলো নোংরামি। তার সঙ্গে বিমানবন্দর, প্লেন বা কোনো জায়গায় দেখা হলে অবশ্যই আমরা কুশল বিনিময় করব। ওই আত্মসম্মান বোধটুকু আমাদের আছে।
সমকাল : মাশরাফির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বা হয়?
তামিম : মাশরাফি ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে এবং যোগাযোগ আছে। আমি হাসপাতালে থাকার সময় তিনি ফোন করেছিলেন। আমার জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলেন। দোয়া করেছেন। ক্রিকেটার হিসেবে একটা সম্পর্ক তো থাকেই। এই সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়।
সমকাল : মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ এখনও ক্রিকেটে আছেন। আপনার পরিকল্পনা কী?
তামিম : আগামী মাসে সিঙ্গাপুরে আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা আছে। ৪ জুলাই ওখানে যাব। ৫ ও ৬ জুলাই টেস্টগুলো হবে। রিপোর্ট ভালো হলে আশা করছি, চিকিৎসক খেলার অনুমতি দেবেন। যেহেতু একটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে, তাই বুঝেশুনে কাজকর্ম করতে হবে আমাকে। আল্লাহ সুস্থ রাখলে বিপিএল খেলার ইচ্ছা আছে। প্রিমিয়ার লিগের ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। সবকিছুই নির্ভর করছে সিঙ্গাপুরের রিপোর্টের ওপর।
সমকাল : আলোচনা আছে, আপনার ফোকাস এখন ক্রিকেট বোর্ড। আপনি কি বিসিবিতে যুক্ত হতে চান?
তামিম : আমি যেভাবে চিন্তা করছি, সেটা একটু ভিন্ন। আমরা বোর্ডে গেলে ক্রিকেটের ভালো করার জন্যই যাওয়া উচিত। এখন যেভাবে বিসিবি চলছে, ওইভাবে যেতে হলে না যাওয়াই ভালো। এ ব্যাপারে আমি খুবই পরিষ্কার। অনেকে প্রতিশ্রুতি দেন এই করবেন, ওই করবেন। আমার কাছে মনে হয়, কেউ বলে পরিবর্তন করতে পারে না, চেষ্টা করতে পারে। আমিও তাই বলব, আমি গেলে ভালো করার চেষ্টা করব। তবে শুধু শুধু বোর্ডের পরিচালক হওয়া বা কোনো পদ নেওয়ার শখ আমার নেই। কারণ আল্লাহ খেলার মাধ্যমে আমাকে অনেক দিয়েছে।
সমকাল : বড় পরিবর্তন আনতে হলে তো বিসিবির নির্বাচিত সভাপতি হতে হবে। সেটা কি সহজ?
তামিম : একদম সত্যি কথাই বলেছেন। নির্বাচনটা কীভাবে হয়, তা আমরা জানি। আমি যে সুন্দর একটা বোর্ডের চিন্তা করছি, বাস্তবে সে সুযোগ কম। পরিবর্তন করা না গেলে আমাদের মতো লোকজনের দরকার কী? যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলুক।
সমকাল : কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে কি নির্বাচিত পরিচালক হবেন?
তামিম : অবশ্যই চিন্তা করব। বলেছিলেন ভালো কাজ করতে হলে বোর্ডের শীর্ষ কর্তা হতে হবে। বিসিবিতে ২৫ জন পরিচালক থাকে। সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক ভালো থাকবে না। সবার সঙ্গে সবার বোঝাপড়া ভালো থাকবে না। তবে সবাইকে একটি দল হিসেবে কাজ করতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা। ২৫ জনের ১০ জনের উদ্দেশ্য ব্যক্তিস্বার্থ দেখা হলে তা আমার কাজে বাধা সৃষ্টি করবে। ওই রকম পরিবেশে কাজ করা কঠিন।
সমকাল : দেশের ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন?
তামিম : বর্তমানে জাতীয় দলের তিন সংস্করণে তিনজন অধিনায়ক। আমার কাছে জিনিসটা কার্যকর মনে হয় না। আমরা এমনিতেই ধুঁকছি। সেখানে যেভাবে শান্তকে সরানো হলো, তা দুঃখজনক। বিসিবি যে কাউকে অধিনায়ক করতে পারে। মিরাজ খুবই ভালো প্রার্থী। কিন্তু শান্তকে সম্মান দিয়ে সরাতে পারত। উচিত ছিল আগে শান্তর সঙ্গে কথা বলা, পরে নতুন অধিনায়কের সঙ্গে। সবকিছু চূড়ান্ত করে মিডিয়ায় জানাতে পারত। হয়েছে উল্টোটা।
সমকাল : পঞ্চপাণ্ডবের শূন্যতা পূরণে বিসিবির কী করা উচিত?
তামিম : পাঁচজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড় সরে গেছে, যাদের ১৫ থেকে ১৭ বছরের অভিজ্ঞতা। তারা হাজারের মতো ম্যাচ খেলেছে। তারা শীর্ষ পারফরমার ছিল। এই মানের ক্রিকেটার সরে গেলে যে কোনো দলে শূন্যতা তৈরি হবেই। কথা হচ্ছে বিসিবি কি ক্রান্তিকালের জন্য প্রস্তুত ছিল? বোর্ড সচেতন থাকলে এত সমস্যা হতো না। এখন যারা আছে, তাদের বেশির ভাগই ৭ থেকে ১০ বছর ধরে খেলছে। আমি বলব, জাতীয় দলকে সব সুবিধা দেন, সিরিজ বা টুর্নামেন্ট খেলতে থাক। কিন্তু ফোকাস দেন এইচপি, টাইগার্স এবং ‘এ’ দলে। এই জায়গাগুলোতে বেশি বিনিয়োগ না করলে, ভালো খেলোয়াড় তৈরি করা সম্ভব না হলে জাতীয় দল সব সময় ধুঁকতে থাকবে।
সমকাল : আগামী বছর টি২০ বিশ্বকাপ, ২০২৭ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। এই দুই টুর্নামেন্ট নিয়ে বিসিবির পরিকল্পনা কেমন হলে ভালো হয়?
তামিম : আমার কাছে মনে হয় ক্রিকেটারদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বেশি। দল হিসেবে ভালো করতে পারছে না। বোর্ডের ভেতরে অস্থিরতা। অধিনায়ক পরিবর্তন হলো। জিনিসগুলো খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলেছে হয়তো। বিসিবির জন্য এ মুহূর্তে করণীয় হলো– দলের ভেতরে আস্থা ফিরিয় আনা। খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস দেওয়া যে– যা কিছুই ঘটুকু বোর্ড তোমাদের সঙ্গে আছে। এই খেলোয়াড়রাই কিন্তু ২০২৬ ও ২০২৭ সালের বিশ্বকাপে খেলবে।
সমকাল : তাহলে কি ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ ঠিকভাবে চলছে না?
তামিম : আমার কাছে মনে হয়, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যানের সিলেকশন মিটিংয়ে বসা উচিত না। একাদশ নিয়ে নাক গলানো উচিত না। তাঁর অধীনে তিনজন নির্বাচক আছেন; কোচ, সহকারী কোচ আছেন। সবাইকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। এর পর দল ফেল করলে জবাবদিহি চাইবেন। নিজেই সবকিছুতে জড়িয়ে গেলে নির্বাচক, কোচিং স্টাফকে প্রশ্ন করবে কে?
সমকাল : আপনি ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান হলে কী করবেন?
তামিম : আমি চেষ্টা করব খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে। নির্বাচক প্যানেল, কোচিং স্টাফকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে তাদের কাছ থেকে পারফরম্যান্স আদায় করতে। অফ সিজনে এক-দু’জন ক্রিকেটারকে হলেও কাউন্টিতে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া। কাউন্টি দলের সঙ্গে নিজেদের টাকায় হলেও দু’জন কোচকে প্রতিবছর জুড়ে দেওয়া, যাতে তারা উন্নত কোচিংটা শিখতে পারেন। তারা শিখলে তাদের কাছ থেকে দেশের অনেক কোচ শিখতে পারবেন।
সমকাল : আপনার চোখে দেশের ভবিষ্যৎ তারকা কে বা কারা?
তামিম : বর্তমান দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটারই আমাদের সঙ্গে খেলেছে। অনেকের ভালো পারফরম্যান্স আছে। পেস বোলিং বিভাগে তাসকিন আহমেদ আছে, নতুন এসেছে নাহিদ রানা। বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল খুবই ভালো একজন বোলার। তাওহীদ হৃদয়, জাকের আলীরা ভালো করছে। তাদের ভেতর থেকেই কেউ কেউ বড় তারকা হয়ে উঠতে পারে।
সমকাল : শেষ প্রশ্ন– বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
তামিম : আমি খুবই আশাবাদী। আমরা হয়তো সাময়িকভাবে ভালো করছি না। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলে ফল দেখতে পাব। আমরা আসলে তিন সংস্করণে একসঙ্গে কখনোই ভালো খেলিনি। এই দলটাকেও এক বছর সময় দিলে ঘুরে দাঁড়াবে। আমি চাইব, বিসিবি ক্রিকেটারদের সর্বাত্মক সাপোর্ট দেবে, তারা যেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারে।
সমকাল : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
তামিম : সমকালকেও ধন্যবাদ।