২ / ৮হাটে ঠেলায় করে লেবু আনা হয়েছে
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পুড়েছে আমদানি পণ্য, বড় বিপদে ছোট ব্যবসায়ীরা
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৩৫-৪০ লাখ টাকার প্রসাধনী আমদানি করেছিল মতিঝিলের বেলাফেস লিমিটেড। সেসব পণ্য বিমানবন্দর থেকে গতকাল রোববার খালাস করার কথা ছিল। কিন্তু আগের দিনের ভয়াবহ আগুনে এসব পুড়ে গেছে।
বেলাফেস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মুহিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শীতে কসমেটিকস পণ্য বিক্রির ভরা মৌসুম। এই মৌসুমের ব্যবসা দিয়েই ছয় মাস চলতে হয়। যেসব পণ্য পুড়েছে, সেগুলো বিমা সুবিধার আওতায় নেই।
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ (পণ্য রাখার স্থান) কমপ্লেক্সে গত শনিবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মুহিবুল ইসলামের মতো অনেক ছোট ব্যবসায়ী ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ ছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক, ওষুধসহ বিভিন্ন খাতের মাঝারি ও বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কাঁচামাল পুড়ে গেছে বা আগুনের তাপে নষ্ট হয়েছে।
এই আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো নিরূপণ করতে পারেনি সরকারের কোনো দপ্তর। ওষুধ খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান স্কয়ারের কাঁচামাল পুড়েছে আনুমানিক ১৫ লাখ ডলারের। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, ১০৮টি প্রতিষ্ঠানের ১২ লাখ ৫৮ হাজার ডলারের বা ১৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকার পণ্য ও কাঁচামাল পুড়ে গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সমুদ্র, বিমান ও স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ৬৫ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ৪১০ কোটি ডলারের পণ্য। তার মানে এই বিমানবন্দর দিয়ে দেশের মোট আমদানির ৬ শতাংশ পণ্য আসে।
আমদানি পণ্যের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল। এ ছাড়া রয়েছে ওষুধের কাঁচামাল, চিকিৎসা সরঞ্জাম, রাসায়নিক পণ্য, ইলেকট্রনিকস, কসমেটিকস বা প্রসাধন, অনলাইন ব্যবসার পণ্য ইত্যাদি।
শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্স ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। প্রায় সাত ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এর মধ্যে সেখানে থাকা পণ্য পুড়ে গেছে। কার্গো ভিলেজের যে অংশে আগুন লেগেছিল, সেখানে আমদানি করা পণ্য রাখা হয়।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আগুনে পোড়া কার্গো ভিলেজ পরিদর্শনের পর গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের ক্ষেত্রে নাশকতাসহ আমরা কোনো কিছুই উড়িয়ে দেব না, সবকিছুই আমলে নেব।’ তিনি জানান, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তারা পুরো ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ করবে। পরে গোয়েন্দা সংস্থাসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে এর রহস্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করা হবে।
সরেজমিন
গত সপ্তাহে চারটি শিপমেন্টের প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ডলারের চিকিৎসা সরঞ্জাম খালাসের কাজ করছিল প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড পয়েন্ট নামের একটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটি শিপমেন্টের জন্য ১৯ লাখ টাকা শুল্কও পরিশোধ করা হয়েছিল। গতকাল এসব পণ্য খালাসের কথা ছিল।
কার্গো ভিলেজের সামনে দাঁড়িয়ে গতকাল দুপুরে প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনালের ট্রেড পয়েন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালাসের আগেই সব পণ্য আগুনে পুড়েছে। কার্গো ভিলেজের ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগ ছিল না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুড়তে দেখলাম।’
জাকির হোসেনের মতো শতাধিক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা গতকাল সকাল থেকে কার্গো ভিলেজের গেটের বাইরে ভিড় করে ছিলেন। জানার চেষ্টা করছিলেন তাঁদের পণ্যের কিছু অক্ষত আছে কি না। তবে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
পাঁচ দিন আগে মেট্রনিক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানির একটি চালান এসেছিল। তাতে প্রায় ১৫ লাখ ডলারের চিকিৎসা সরঞ্জাম ছিল, যা শনিবারের আগুনে পুড়ে গেছে।
ডার্ট গ্লোবাল নামে লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানের আমদানি তত্ত্বাবধায়ক মো. আনোয়ার সাদাত কার্গো ভিলেজের সামনে ঘোরাফেরা করছিলেন। জানতে চাইলে বললেন, ‘আগুন লাগার পর এসেছিলাম, রাত পর্যন্ত ছিলাম। আজ (গতকাল) আবার সকাল আটটায় এসেছি। ভেতরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আর কী করব; চেয়ে চেয়ে দেখেছি।’ তিনি জানান, কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাপড়, সরঞ্জাম ও চিকিৎসা উপকরণ আমদানি তদারকি করছেন তাঁরা। তবে কোনো পণ্য অক্ষত পাওয়ার আশা নেই।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেইড ফরোয়ার্ড অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএফএফএ) সাবেক পরিচালক নাসির আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি পণ্য খালাস করতে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দু-তিন দিন লাগে। শুক্র ও শনিবার আমদানি পণ্য খুবই কম পরিমাণে খালাস হয়। সে জন্য ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। তিনি জানান, বিএএফএফএর সদস্য ১ হাজার ১০০ প্রতিষ্ঠান। তাদের কার কী ক্ষতি হয়েছে জানতে সমিতি থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
ওষুধের কাঁচামাল পুড়েছে
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানি স্কয়ারের প্রায় ১৫ লাখ ডলারের বা ১৮ কোটি টাকার ওষুধের কাঁচামাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে পুড়ে গেছে। এ ছাড়া স্কয়ার গ্রুপের ৫ কোটি টাকার কাপড় পুড়ে গেছে। এ তথ্য জানিয়েছেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী।
এদিকে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধের কাঁচামালও পুড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির সভাপতি আবদুল মুক্তাদির। গত রাতে তিনি বলেন, ‘কার্গো ভিলেজের আগুনে ওষুধশিল্পে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণে আমরা কাজ করছি।’
রপ্তানিকারকেরা বিপদে
উইকিটেক্স-বিডি নামে একটি বায়িং হাউসের ৮৬ লাখ ডলারের কাপড় গত শুক্রবার রাতে চীন থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে আসে। এই কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি হবে, যার রপ্তানিমূল্য ২ লাখ ডলার। উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে এই পণ্য খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়। শনিবারের অগ্নিকাণ্ডে এই কাপড়ের একটা অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এই প্রতিষ্ঠানের আরও ১২ হাজার ডলারের কাপড় ও ৪৪ হাজার ডলারের আরএফআইডি ট্যাগও পুড়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে উইকিটেক্স-বিডির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ কে এম সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগুনে শেডের পণ্য বেশি পুড়েছে। তবে বাইরে থাকা পণ্য আগুনের তাপে নষ্ট হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিমা সুবিধার আওতায় থাকলেও ক্ষতিপূরণ পেতে সময় লাগবে। কিন্তু কাপড় সরবরাহকারীদের তো ৯০ দিনের মধ্যে টাকা দিতে হবে।
বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইনামুল হক খানের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএর পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘আমরা ভেতরে গিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখেছি। পুরো ইমপোর্ট সেকশন পুড়ে গেছে।’
ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে গত রাতে ইনামুল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সদস্য ১০৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আজকে (রোববার) পর্যন্ত ১২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের ক্ষতির তথ্য পেয়েছি। আমাদের ধারণা, ২৫০-৩০০ প্রতিষ্ঠানের মালামাল পুড়েছে। তাতে শেষ পর্যন্ত ক্ষতি ৩-৪ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, আগুনের ঘটনায় পরোক্ষ ক্ষতি অনেক। অনেকের সরঞ্জাম ও নমুনা পোশাক পুড়ে গেছে।