ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা আমদানি বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি আমদানি হচ্ছে চাল ও ডাল। যদিও বাজারে চালের দর না কমে বরং বেড়েছে। ডলার পরিস্থিতির উন্নতি, আমদানির ওপর থেকে বিভিন্ন বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া, শুল্ক কমানো এবং যে কোনো ব্যবসায়ীর জন্য পণ্য আমদানির সুযোগ তৈরিসহ বিভিন্ন কারণে গত ডিসেম্বর থেকে আমদানি বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে দেশে মোট ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছর যেখানে আমদানি কমেছিল প্রায় ১১ শতাংশ। আর গত নভেম্বর পর্যন্ত আমদানি কম ছিল ১ শতাংশের বেশি।
চরম ডলার সংকটের কারণে ২০২২ সালের জুলাই থেকে আমদানি ব্যয় কমাতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেয় সরকার। ওই সময় বিভিন্ন পণ্যে শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়। এই মার্জিনের পুরোটাই নিজস্ব উৎস থেকে দিতে বলা হয়। বাড়ানো হয় শুল্ক। এসব উদ্যোগের প্রভাবে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে আমদানি কমতে শুরু করে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এলসি মার্জিনের বিষয়টি ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি গ্রুপের সিন্ডিকেট ভেঙে এখন চাইলেই যে কেউ পণ্য আমদানির সুযোগ পাচ্ছে। এসব কারণে বর্তমানে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি আছে ২৪ শতাংশের মতো। রপ্তানি আয় বেড়েছে ১০ শতাংশ। একদিকে অর্থ পাচার কমে যাওয়া, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে ২০ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার। দর ১২২ থেকে ১২৩ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ব্যবসায়ীরা এখন চাইলেই আমদানির ডলার পাচ্ছেন। এরই মধ্যে আমদানির ওপর বেশির ভাগ বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থ পাচার ঠেকাতে কড়াকড়ি করা হয়েছে। আগে যারা পাচার করেছে, তাদের অর্থ দেশে আনতে উদ্যোগ নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পণ্য ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চালের আমদানি। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৮ কোটি ৬১ লাখ ডলার সমমূল্যের চাল আমদানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ২০৫ গুণ বেশি। অবশ্য গমের আমদানি ৭ শতাংশ কমে ১০৬ কোটি ডলারে নেমেছে। শতাংশ বিবেচনায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ডালের। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার সমমূল্যের ডাল আমদানি হয়েছে। আগের একই সময়ের চেয়ে যা ১২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
চালের আমদানি সবচেয়ে বেশি হলেও দামে তেমন প্রভাব নেই। সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে সরু চালের দর ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়ে এখন প্রতি কেজি ৭২ থেকে ৮৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের চালে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা। আর মোটা চালে ৩ শতাংশের মতো বেড়ে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। চাল ছাড়া অবশ্য বেশির ভাগ পণ্যের দর কমেছে। দেশের বাজারে পেঁয়াজ, রসুন, আলু, আটা, চিনি, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অধিকংশ পণ্যের দর অনেক কমেছে। কমেছে ডালের দরও। এসব কারণে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। মার্চের হিসাব এখনও পাওয়া
যায়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশে নেমেছে। গত ২৩ মাসের মধ্যে যা সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের আট মাসে ভোজ্যতেল ১৬ শতাংশের বেশি বেড়ে ১৬৪ কোটি ডলারের আমদানি হয়েছে। মসলা প্রায় ৯ শতাংশ বেড়ে এসেছে ৩০ কোটি ৬২ লাখ ডলারের। আর চিনির আমদানি ২ দশমিক ৬০ শতাংশ কমে ৭৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলারে নেমেছে। তৈরি পোশাক সম্পর্কিত পণ্য প্রায় ১৬ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ২৬৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি ৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেড়েছে। কমেছে মূলধনি পণ্যের আমদানি ১১ শতাংশের বেশি কমেছে। অন্যান্য আমদানি ১১ শতাংশ বেড়ে ৬৫০ কোটি ডলার সমমূল্যের পণ্য দেশে এসেছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আমদ ন র আমদ ন আমদ ন র সবচ য় দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
গ্যাস অপচয়ে বছরে ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি: পেট্রোবাংলা
কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) নামে গ্যাস অপচয় বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে অপচয় হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ গ্যাস। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মার্চ পর্যন্ত অপচয় হয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এতে আর্থিক ক্ষতি ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনে অপচয় হয়েছে ২ শতাংশ।
‘দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়; গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে বলা হয়, ২ শতাংশ অপচয় গ্রহণযোগ্য, তাই ওইটুকু সমন্বয় করেই আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় রোধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা।
পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাস অপচয়ের জন্য দায়ী হচ্ছে পুরোনো, জরাজীর্ণ পাইপলাইন; গ্যাস সরবরাহ লাইনের গ্যাসস্টেশন রাইজারে লিকেজ (ছিদ্র); তৃতীয় পক্ষের উন্নয়নকাজে পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া এবং আবাসিক খাতে প্রচুর অবৈধ সংযোগ। তবে এসব অপচয় রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় মিটারিং/ মনিটরিং ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা; লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কারিগরি ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা; অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদ কার্যক্রম জোরদার করা এবং আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা।
দেশের গ্যাস খাতের চিত্র তুলে ধরে সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমতে কমতে ১৫ বছর আগের জায়গায় চলে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। গ্যাস চুরি ও অপচয় কমাতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কোনোভাবেই ২ শতাংশ হওয়ার কথা নয়। এটা ভালো করে দেখা উচিত।
শিল্পে নতুন সংযোগে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গভীরভাবে দেখা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা তৎপর আছে, খোঁজ পেলেই বিচ্ছিন্ন করা হবে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যেহেতু তারা বেশি দাম দেবে। তাই অগ্রাধিকার বিবেচনা করে তিনটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের তালিকায় থাকছে, যেসব কারখানায় এখনই সংযোগ দেওয়া যাবে। এগুলো পরিদর্শন প্রায় শেষের দিকে, আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে নতুন টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রাধিকার পাচ্ছে স্থলভাগের টার্মিনাল। মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় এটি করা হবে। এটি হলে কম দামের সময় বাড়তি এলএনজি কিনে মজুত করা যাবে। তবে এগুলো রাতারাতি করা যায় না, পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব। তিনি বলেন, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৈরি পিএসসির খসড়া জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫০টি কূপ সংস্কার, উন্নয়ন ও খননের প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ৪টি কূপের কাজ চলমান। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী।
সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে
পেট্রোবাংলার আর্থিক দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব আয় ৫৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে অর্ধেক বকেয়া। গত মে পর্যন্ত গ্যাস বিল বকেয়া ২৭ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। ১৩–১৫ হাজার কোটিতে বকেয়া নেমে এলে সন্তোষজনক। সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এরপর সার কারখানায় বকেয়া আছে ৯৬৪ কোটি টাকা। তবে বিদেশি কোনো কোম্পানির কাছে বিল বকেয়া নেই পেট্রোবাংলার। সব বিল শোধ করা হয়ে গেছে।
গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা
পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা মোট ভর্তুকি নিয়েছে ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার হিসাবে গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে ২৭ টাকা ৫৩ পয়সা। তারা বিক্রি করেছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সায়। এর মানে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সা।