শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্যিক অংশীদারদের বড় চাপের মধ্যে রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একবার শুল্ক আরোপ করছেন তো আরেকবার স্থগিত করছেন। ফলে বিশ্ববাজারে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই অনিশ্চয়তার অবসান না হলে মন্দার চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে।

চলতি মাসের শুরুতেই বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। পরে সেই শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করলেও ফাঁড়া কাটেনি চীনের। দেশটির ওপর শুল্ক বাড়িয়ে বরং ১৪৫ শতাংশ করা হয়। তবে শুক্রবার চীনের ওপর আরোপ করা ওই শুল্ক থেকে কিছু প্রযুক্তিপণ্যকে ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দেয় হোয়াইট হাউস। লক্ষ্য—এই পণ্যগুলো ভোক্তাপর্যায়ে কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে পৌঁছানো।

পরে রোববার ট্রাম্প আবার বলেছেন, আগামী সপ্তাহে আমদানি করা সেমিকন্ডাক্টরের ওপর নতুন শুল্ক ঘোষণা করা হবে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা থাকবে। এ ঘোষণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, চীন থেকে আমদানি করা স্মার্টফোন ও কম্পিউটারের ওপর শুল্ক ছাড় দেওয়ার আগের সিদ্ধান্ত বেশি দিন টিকছে না। কারণ, এই প্রযুক্তিপণ্য তৈরির অন্যতম উপাদান সেমিকন্ডাক্টর।

শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের এই দোলাচলে থাকাকে আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ব্রিজওয়াটার অ্যাসোসিয়েটের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রে ডালিও।

রোববার ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচ থেকে ওয়াশিংটনে ফেরার পথে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা অন্যান্য কোম্পানি যারা প্রযুক্তিপণ্য তৈরি করে, তাদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাই। কারণ, আমরা চাই আমাদের চিপ, সেমিকন্ডাক্টরসহ অন্যান্য প্রযুক্তিপণ্য দেশেই তৈরি হোক।’ এদিনই সেমিকন্ডাক্টর খাতে জাতীয় নিরাপত্তাভিত্তিক বাণিজ্য নিয়ে তদন্তের ঘোষণা দেন তিনি।

স্মার্টফোনের মতো পণ্যগুলো আদৌ শুল্কমুক্ত থাকবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুধু এটুকু বলেছেন, ‘কেউ যেন অতিরিক্ত কঠোর না হয়, তাই একটু নমনীয়তা দেখাতে হয়।’ তবে ট্রাম্পের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক রোববার বলেছেন, চীনা প্রযুক্তিপণ্যের ওপর শুল্ক ছাড়ের বিষয়টি নতুনভাবে নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের এই দোলাচলে থাকাকে আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ব্রিজওয়াটার অ্যাসোসিয়েটের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রে ডালিও। সংবাদমাধ্যম এনবিসির ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। আমি আরও ভয় পাচ্ছি, যদি শুল্কনীতি নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, মন্দার চেয়েও খারাপ কিছু ঘটতে পারে।’

ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের মুখে চীন হার না মানলেও বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। আজ মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্টের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে স্পেনের প্রতিনিধিদলের।‘শুল্কনীতি নেই, আছে দুর্নীতি’

শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত বদল এবং তার জেরে বাজারে অস্থিতিশীলতা নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন বিশ্লেষকেরা। ডেমোক্র্যাট সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন সংবাদমাধ্যম এবিসিকে বলেন, অর্থনীতিবিদেরা বারবার বলছেন, এ ধরনের শুল্কনীতির কারণে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত এবং মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। এখানে শুল্কনীতি নেই; আছে কেবল বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি।

বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান নর্থম্যান ট্রেডারের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান বাজার বিশ্লেষক স্বেন হেনরিচ রোববার ট্রাম্পের শুল্কনীতির কড়া সমালোচনা করে সামাজিক মাধ্যম এক্সে লেখেন, ‘যেদিন লুটনিক (মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী) বরখাস্ত হবেন, সেদিনই বাজারে বছরের সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন হবে। প্রশাসন কী বলতে চায়, তা আগে ঠিক করুক—প্রতিদিনই সিদ্ধান্ত পাল্টাচ্ছে। মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এই অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগ করতে পারছে না।’

ভিয়েতনামের পণ্যের ওপরও ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। তা আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত থাকলেও দেশটির সঙ্গে পছন্দসই চুক্তি না হলে শুল্ক আবার ফিরিয়ে আনার হুমকি দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।

তবে বিশ্বজুড়ে এই অনিশ্চয়তার জন্য চীনকেই দায়ী করেছেন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। সিবিএসের ‘ফেস দ্য নেশন’ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, চীনই পাল্টা শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্য উত্তেজনা তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো ৯০ দিনের মধ্যেই অর্থবহ চুক্তিতে পৌঁছানো। মার্কিন প্রশাসন কয়েকটি দেশের সঙ্গে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অর্থবহ চুক্তি করবে।

ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের মুখে চীন হার না মানলেও বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। আজ মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্টের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে স্পেনের প্রতিনিধিদলের। এ ছাড়া মার্কিন শুল্ক আরোপের জেরে বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতার মধ্যে গতকাল সোমবার কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে। গতকাল লন্ডনের এফটিএসই ১০০ সূচকে ১ দশমিক ৮ শতাংশ, ফ্রাঙ্কফুর্টের ডাক্স সূচকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ, প্যারিসের সিএসি ৪০ সূচকে ২ দশমিক ২২ শতাংশ, ইউরোপের এসটিওএক্সএক্স সূচকে ২ দশমিক ৮ শতাংশ উত্থান হয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে সি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পর বসে নেই চীনও। এরই মধ্যে মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করেছে। এ ছাড়া নিজেদের বাণিজ্যের ওপর শুল্কের খড়্গ এড়াতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে রয়েছেন তিনি। এর অংশ হিসেবে গতকাল তিনি ভিয়েতনাম সফর করেছেন।

সির এই সফরে বেইজিং ও হ্যানয়ের মধ্যে কয়েক ডজন সহযোগিতা চুক্তি সই হয়েছে। সফরের আগে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদমাধ্যম নেনজাতে এক নিবন্ধে সি লেখেন, ‘উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় দুই পক্ষের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে তিনি আরও লেখেন, বাণিজ্য ও শুল্কযুদ্ধে কেউই জয় পাবে না।

ভিয়েতনামের পণ্যের ওপরও ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। তা আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত থাকলেও দেশটির সঙ্গে পছন্দসই চুক্তি না হলে শুল্ক আবার ফিরিয়ে আনার হুমকি দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। আজ মঙ্গলবার ভিয়েতনাম ত্যাগ করে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্টের। এরপর সেখান থেকে যাবেন এ অঞ্চলের আরেক দেশ কম্বোডিয়ায়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র শ ল ক আর প শ ল ক আর প র র ওপর শ ল ক ৯০ দ ন র কর ছ ন র জন য ব যবস দশম ক করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

মাঝরাতে সরকারি কর্মকাণ্ড কতটা স্বাভাবিক

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে বোধকরি একটা মহাকাব্য লিখে ফেলা সম্ভব। তাঁরা যেভাবে গভীর কিংবা শেষ রাতে নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছেন; তাতে তো মনে হচ্ছে সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা দিনে কাজ না করে রাতেই মনে হয় বেশি কাজ করেন! কয়েকটা উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।

মাস কয়েক আগে যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ভাবে খারাপ হয়ে গেল, আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা  মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাত তিনটার সময় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে রাত তিনটার সময় আর কোনো মন্ত্রী এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করেছেন কি না, আমার অন্তত জানা নেই। আমরা সবাই ভাবলাম, তিনি হয়তো বড় কোনো ঘোষণা দেবেন। এরপর কী দেখলাম?

তিনি খুব সাধারণভাবে বললেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার নিজেদের উদ্যোগকে কঠিন ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে।

সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ আকাশ থেকে একটি  যুদ্ধবিমান ঢাকা শহরের উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল বিল্ডিংয়ে ভেঙে পড়ল। আগুনে দগ্ধ শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে নিজেরা উঠে এসে হাঁটছে; এমন দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে। যে দৃশ্য দেখলে যে কেউ হয়তো ট্রমায় চলে যাবে। ওই স্কুলের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা হয়তো সরাসরি সেই দৃশ্য দেখেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে—এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া সময়ের দাবি ছিল। এ সিদ্ধান্ত সরকার দিনের বেলাতেই নিতে পারত। অথচ আমরা কী দেখলাম?

সরকারের পক্ষ থেকে  রাত তিনটার দিকে ফেসবুকে এসে ঘোষণা করা হলো, পরের দিনের এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে।

যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।

দিন দু-এক আগে এ সরকারকেই যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, এ কথা বলছি কারণ, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা আমার নিয়োগকর্তা’—সেই ছাত্রদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গভীর রাতে ফেসবুক এসে লাইভ করেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা।

এই আড়াই ঘণ্টার লাইভে মূল যে বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন,  সারমর্ম করলে দাঁড়ায়: বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম মানি মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে এবং অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। তিনি এটাও বলেছেন, এই সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত হেয়ার রোড থেকে আসে। অর্থাৎ উপদেষ্টারা যেখানে থাকেন।

এদিকে সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটা ফেসবুক পোস্ট করেছেন। যদিও ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তিনি বেশ কয়েকবার এডিট করেছেন। তবে প্রথমে যা লিখেছেন, সেটা হচ্ছে, নতুন একটি দলের মহারথীদের কয়েকজন দুর্নীতিতে জড়িত। এ ছাড়া তিনি এটাও বলেছেন, একটা সার্কেলের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তাঁদের কেন প্রশ্রয় দেওয়া হলো? আপনারা যদি জানেনই কিছু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত। তাহলে সরকারের অংশ হিসেবে আপনাদের তো দায়িত্ব তাঁদের আইনের আওতায় আনা। সেটা না করে ফেসবুকে পোস্ট করতে হচ্ছে কেন? তা–ও আবার রাত তিনটায়!

এই সরকার কি মাঝরাতের ফেসবুকীয় সরকারে পরিণত হয়েছে? পরীক্ষা পেছানোর মতো সিদ্ধান্ত যখন মাঝরাতে নিতে হয়, সংবাদ সম্মেলন যখন রাত তিনটায় করতে হয়, তখন তো প্রশ্ন জাগতেই পারে। কারণ এটা তো স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।

যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।
রাষ্ট্র যদি ভালো না থাকে তবে তার মাত্রা কতটুকু, সেটা নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ