মডেল মেঘনা আলমকে আটক এবং তাঁকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একজন মন্তব্য করেছিলেন, এ ঘটনা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ‘পচা শামুকে পা কাটা’র মতো হতে পারে। ব্যক্তিপর্যায়ের একটি ‘সাধারণ’ বিষয়কে ‘জাতীয় ইস্যু’তে পরিণত করা এবং এর ফলে সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়া—এমন কিছু বোঝাতেই তিনি হয়তো মন্তব্যটি করেন। বাস্তবে তেমনটাই ঘটেছে আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং খোদ সরকারসংশ্লিষ্ট কারও কারও ‘অপরিণামদর্শিতা’ আবারও জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে।

২.

একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মডেল মেঘনা আলমের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের একটি শক্তিশালী দেশের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। পরে সেই সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। এর জেরেই মেঘনা আলমকে আটক করা হয়।

গত বুধবার রাতে মেঘনা আলমকে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করতে যায় ডিবি পুলিশ। এ সময় তিনি ফেসবুক লাইভে ছিলেন। সেই লাইভে তিনি বলছিলেন, তাঁর দরজার বাইরে পুলিশ পরিচয়ধারীরা তাকে নিতে এসেছে। মেঘনা আলমের ফেসবুক লাইভ চলার সময়ই তাঁর বাসায় পুলিশ প্রবেশ করে এবং তখন লাইভ বন্ধ হয়ে যায়।

আটক হওয়ার আগমুহূর্তে সেই লাইভে মেঘনা আলম বলছিলেন, ‘বাসায় কিছু মানুষ আক্রমণ করেছে। তারা নিজেদেরকে পুলিশ পরিচয় দিচ্ছে। আমি বলেছি থানায় এসে কথা বলব, তারা কথা শুনছে না।’ লাইভ ভিডিওতে মেঘনা আলমকে দরজার বাইরে থাকা লোকদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা আমার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছেন।...’ (বিবিসি বাংলা, ১১ এপ্রিল ২০২৫)

ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট, পুলিশ সদস্যরা জোরপূর্বক বাসায় প্রবেশ করে মেঘনা আলমকে তুলে নিয়ে যান। তাঁকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি থানা ও ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়নি। এর ফলে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে কি না, এমন একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।

বুধবার রাতে মেঘনা আলমকে তুলে নেওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় তাঁকে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এরপর বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়ে মেঘনা আলমকে কারাগারে পাঠানো হয়। আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারের পাঠানোর পরও পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কোনো কিছু জানানো হয়নি।

মেঘনা আলমকে যেভাবে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, সেই ঘটনাটি জানাজানি হলে দেশে-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। দেশের মানবাধিকারকর্মীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টি নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-নিন্দা জানায়। এতে সরকারের ওপর একরকম দৃশ্যমান চাপ তৈরি হয়।

মেঘনা আলমের গ্রেপ্তার নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিট্রন পুলিশ (ডিএমপি) শুক্রবার তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেয়। এতে মেঘনা আলমকে অপহরণ করার অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্ক মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টা করা এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মেঘনা আলমকে সকল আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে।...’

পুলিশের এ ‘বিবৃতি’টি ছিল অস্পষ্ট ও অসংগতিপূর্ণ । এতে একধরনের ঢালাও অভিযোগ করা হয়েছে, যেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়ে মেঘনা আলমকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টিকে তারা ‘নিরাপত্তা হেফাজত’ বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে; ‘সকল আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ’ করার দাবিটি ছিল অসত্য ও বানোয়াট।

লক্ষণীয় হলো, পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া ওই পোস্টটি শুক্রবার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এর ফলে মেঘনা আলমকে আটক ও কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্তে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সায় বা সম্মতি আছে, এমনটাই প্রতীয়মান হয়েছিল। তবে শফিকুল আলম পরে সেই পোস্টটি সরিয়ে নেন।

৩.

মেঘনা আলমকে যেভাবে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, সেই ঘটনাটি জানাজানি হলে দেশে-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। দেশের মানবাধিকারকর্মীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টি নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-নিন্দা জানায়। এতে সরকারের ওপর একরকম দৃশ্যমান চাপ তৈরি হয়।

এ রকম অবস্থায় রোববার (১৩ এপ্রিল) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া যায়। এরপর দুপুরের দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান, মেঘনা আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে যে প্রক্রিয়ায় আটক করা হয়েছে, সেটা সঠিক হয়নি। (প্রথম আলো অনলাইন, ১৩ এপ্রিল ২০২৫)

আইন উপদেষ্টার এ বক্তব্যের পর যে প্রশ্নগুলো সামনে আসে তা হলো, যে প্রক্রিয়ায় আটক করা হয়েছে, সেটা সঠিক না হলে মেঘনা আলমকে আটক রাখা হচ্ছে কেন? এ আটকাদেশ কি বেআইনি বা অবৈধ নয়? তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে সেই অভিযোগে কেন মামলা করা হয়নি?

মেঘনা আলমকে আটকের প্রক্রিয়া ও আটকাদেশের বৈধতা নিয়ে তাঁর বাবা বদরুল আলম হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মেঘনা আলমকে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার, কারণ উল্লেখ না করে গ্রেপ্তার, ২৪ ঘণ্টার বেশি গোয়েন্দা কার্যালয়ে হেফাজতে রাখা এবং তাঁর মুক্তি প্রশ্নে রুল দেন হাইকোর্ট। বিশেষ ক্ষমতা আইনে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে মেঘনা আলমকে দেওয়া আটকাদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়। (মডেল মেঘনা আলমের আটকাদেশ কেন অবৈধ নয়: হাইকোর্ট, প্রথম আলো অনলাইন, ১৩ এপ্রিল ২০২৫)

৪.

মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ থাকলে সুনির্দিষ্ট সেই অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা যেত এবং ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণ করে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু তাঁকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক করে কারাগারে পাঠানোর ফলে এটি ‘জাতীয় ইস্যু’তে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত আইনগুলোর একটি হলো বিশেষ ক্ষমতা আইন।

একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৭৪ সালে এ আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ আইনের বড় সমস্যা হলো, এ আইনে আটক ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান না; আইনের পরিধি এতটাই বিস্তৃত, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই যে কাউকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটকে রাখা যায়। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমনের জন্য বিভিন্ন সময়ে এ আইনটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, এ রকম বহু অভিযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুনগণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধ১৩ এপ্রিল ২০২৫

অতীতে বিশেষ ক্ষমতা আইন রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে; সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ছিল বিরল। তা ছাড়া নানা রকম সমালোচনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এ আইন প্রায় ‘অব্যবহৃত’ ছিল। এ রকম অবস্থায় একজন নারীর বিরুদ্ধে এ আইনের প্রয়োগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে মেঘনা আলমকে আটকের পর কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অফিস নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বলেছে, ‘এ কালো আইন ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে অভিযোগ ও বিচারিক তত্ত্বাবধান ছাড়াই নির্বিচার আটকের জন্য ব্যবহার করা হয়ে আসছে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াগত সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান ও প্রয়োগ গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ১২ এপ্রিল ২০২৫)

মেঘনা আলমকে যেভাবে বা যে প্রক্রিয়ায় আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, তা নাগরিক অধিকার হরণে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চরম অভাবকে স্পষ্ট করেছে। একই সঙ্গে তা আমাদের আইনি কাঠামোর বিশ্বাসযোগ্যতা, মানবিকতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতিকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমের আটকাদেশকে ফ্যাসিবাদী তৎপরতা ও স্বৈরাচারী আচরণের প্রকাশ বলে অভিহিত করেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। তারা বলেছে, বিশেষ ক্ষমতা আইন একটি ফ্যাসিবাদী আইন। গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রে বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ নিপীড়নমূলক কোনো আইন থাকতে পারে না। জুলাইয়ে ছাত্র–জনতার বিপুল রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যখন জনগণের আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠেছে, তখন এ রকম আইনের ব্যবহার আবার ফ্যাসিবাদী তৎপরতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। (প্রথম আলো অনলাইন, ১২ এপ্রিল ২০২৫)

৫.

বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমকে আটক করা নিয়ে মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী বলেন, ‘মেঘনা আলমের সঙ্গে এই আইন প্রথম ব্যবহৃত হচ্ছে, বিষয়টা তা নয়।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ১৫ এপ্রিল ২০২৫)। তাঁর এ বক্তব্যের পর প্রশ্ন ওঠে, একটি বিতর্কিত আইন আগে ব্যবহৃত হয়েছে, শুধু এই যুক্তিতেই কি সেটা বৈধ বা গ্রহণযোগ্য হতে পারে? এ রকম হলে বিগত স্বৈরাচারী আমলের অনেক কিছুই এখন বৈধ বা গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিতে হবে!

গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে আট মাসের বেশি সময় আগে দায়িত্ব নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা হলো, তারা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর বা সংস্কার করবে। এ রকম অবস্থায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো একটি ‘স্বৈরাচারী’ আইনের প্রয়োগ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আইন–আদালতসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সংস্কৃতি যে এখনো বহাল রয়েছে, এটা খুবই স্পষ্ট।

লক্ষণীয় হলো, বেশ কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের এ রকম প্রয়োগ খুবই হতাশাজনক।

এ আইন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি হুমকিস্বরূপ, এটা তাঁদের অজানা নয়। এই আইন বাতিল না করলে মানবাধিকার নিয়ে তাঁদের অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে এমন ধারণাই পোক্ত হবে, ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’।

মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ব শ ষ ক ষমত ব যবহ র কর ন উপদ ষ ট র আটক দ শ প রথম আল ব যবহ ত সরক র র অবস থ য় র জন য ত হয় ছ ফ সব ক আটক ক এ আইন আইন র আলম র এ রকম ব ষয়ট আটক র

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস

স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।

মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’

সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

অনাহারে মৃত্যু ১৫৪

গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।

গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।

ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।

বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।

গাজায় স্টিভ উইটকফ

শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ