আগামী দিনের কর্মসূচি ও অঞ্চলভিত্তিক সাংগঠনিক নীতিমালা নির্ধারণ, সংস্কারের প্রস্তাব প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তৃতীয় সাধারণ সভায়। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনপরিসরে এনসিপির বেশ কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাংগঠনিক ‘শৃঙ্খলা ও তদন্ত’ কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। জেলা-উপজেলায় কমিটির আহ্বায়ক হতে বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

গতকাল শুক্রবার বেলা তিনটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ন ট্রেড সেন্টারে এনসিপির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সভা হয়। এনসিপির তৃতীয় সাধারণ সভায় দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন।

আরও পড়ুনঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এনসিপির বৈঠক চলছে১ ঘণ্টা আগে

পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনসিপি জানায়, দলের সাধারণ সভায় এনসিপির অঞ্চলভিত্তিক সাংগঠনিক নীতিমালা নির্ধারণ, সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাব প্রণয়ন, গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগের বিচার ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি নির্ধারণ, সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর নীতি গ্রহণে সরকারকে দাবি জানানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরায়েলি সহিংসতা ও ভারতে ওয়াক্‌ফ বিলের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে জনমনে স্বস্তি আনতে সরকারকে জোর দাবি জানানোর বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে।

সভায় দলের সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রস্তাব করেন মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম ও মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ।

নীতিমালায় সাংগঠনিক কাজের স্বার্থে ৬৪টি জেলাকে ১৯টি জোনে ভাগ করা হয়। এ ছাড়া কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ে সর্বনিম্ন ৩১ থেকে সর্বোচ্চ ৫১ সদস্যের এবং উপজেলা পর্যায়ে সর্বনিম্ন ২১ থেকে সর্বোচ্চ ৪১ সদস্যের কমিটি গঠিত হবে। উভয় কমিটির আহ্বায়ক পদে বয়স সর্বনিম্ন ৪০ বছর হতে হবে বলেও সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনপরিসরে এনসিপির বেশ কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত সাংগঠনিক শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রমের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সভায় সর্বসম্মতিক্রমে একটি সাংগঠনিক ‘শৃঙ্খলা ও তদন্ত’ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামীকাল রোববার এ কমিটি ঘোষণা করা হবে।

বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে চলতি সপ্তাহে এনসিপির ঢাকা মহানগর শাখা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে।

আরও পড়ুন‘মৌলিক সংস্কার’ বলতে কী বোঝাতে চাইছে জাতীয় নাগরিক পার্টি৪ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এনস প র গঠন ক

এছাড়াও পড়ুন:

অপারেশন সিঁদুর: নারীর নামে পুরুষের যুদ্ধ

যখন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর হিন্দু ও মুসলিম দুই নারী অফিসার ‘অপারেশন সিঁদুর’ ঘোষণা করার জন্য মঞ্চে হাজির হন, তখন সরকার এটি নারী-পুরুষ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত বলে উদযাপন করে। সামনের সারিতে থেকে গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্যকালে ইউনিফর্ম পরা নারীর ছবি, ২৬ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া এবং প্রতীকীভাবে বৈধব্যের সিঁদুর পুনরুদ্ধার জাতির সেবায় নারীবাদী প্রতীক হিসেবে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল।

এই মুহূর্ত ঐতিহাসিক ঘটনার সাদৃশ্যপূর্ণ প্রতিধ্বনি। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তার নির্ণায়ক ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হিন্দু যোদ্ধাদেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল, যিনি নারীশক্তি ও জাতীয়তাবাদী সংকল্পের প্রতীক। দুর্গার এই তুলনা কীভাবে ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধর্মীয় প্রতীকবাদের সঙ্গে মিশ্রিত করে প্রায়ই নারী-পুরুষ চিহ্নজ্ঞাপক ও পৌরাণিক দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করা হয়, তা আমাদের সামনে আনে।  

কিন্তু যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী নারীরা কি মজ্জাগতভাবে নারীবাদী হয়ে উঠতে পারে? নারীবাদী পণ্ডিতরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, জাতি গঠন কোনো লিঙ্গ-নিরপেক্ষ প্রকল্প নয়। এটি নারীদের এমন ভূমিকায় পুনর্গঠিত করে, যা তাদের লক্ষ্য হাসিল করে। যেমন ত্যাগী মা, শোকার্ত বিধবা অথবা জাতির সশস্ত্র কন্যাসন্তান। নীরা যুবাল-ডেভিসের মতো পণ্ডিতদের মতে, নারীদের জাতির সম্মান ও সাংস্কৃতিক খাঁটিত্বের প্রতীকী বাহক হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, কিন্তু খুব কমই তাদের রাজনৈতিক এজেন্ট হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সুমিতা সেন ও মৈত্রেয়ী চৌধুরীর মতো পণ্ডিতরা আমাদের মনে করিয়ে দেন, ঐতিহাসিকভাবে নারীর ভূমিকা জনপরিসরে স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসনের প্রেক্ষিতে নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি কর্তব্যের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। অতএব, জনপরিসর কিংবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই নারী-পুরুষের মধ্যে ন্যায্যতার তুলনা হয় না। উভয়ের প্রতিনিধিত্বের নিরপেক্ষতা কতটা কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন করা উচিত। 
আজকের সামরিক ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান, যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে নারীরা দৃশ্যমান থাকে, তবুও পথ বদলায়নি। সামরিকতন্ত্রের পুরুষপ্রধান ও পুরুষতান্ত্রিক ভিত্তি অক্ষত রাখার মানে নারীদের ‘পুরুষদের মতো হওয়া’র ক্ষমতা উদযাপন করার মতো। এটি অপারেশন সিঁদুরে লক্ষ্য করা যায়, যেখানে ইউনিফর্ম পরিহিত দুই নারীকে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে; যেখানে তারা যে চিত্রনাট্য পরিবেশন করেছেন, তা গভীরভাবে পুরুষতান্ত্রিক; যেখানে পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে নারীদের যোগ্যতা প্রমাণের দাবি করা হয়।

নারীবাদী সংস্থা দাবি করে, নারীরা তাদের কর্মজীবনের শর্তাবলি নির্ধারণ করুক। এখানে এই পরিভাষাগুলো আরএসএস মতাদর্শের পিতৃতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ দ্বারা নির্ধারিত। দুই অফিসার লিঙ্গগত মানদণ্ড চ্যালেঞ্জ করেননি; তারা একটি পূর্বলিখিত স্ক্রিপ্টে পা রেখেছিলেন, যা নারীত্বকে জাতির প্রতি স্ত্রীত্বের কর্তব্যের সঙ্গে সমান করে দেখে। শীর্ষ পর্যায়ে তাদের সামরিক ভূমিকা সামরিকবাদকে স্বাভাবিক করে তোলে, যদিও এগুলো লিঙ্গ অগ্রগতি হিসেবে তুলে ধরা হয়। একজন মুসলিম অফিসারের অন্তর্ভুক্তি আকস্মিক নয়। দুর্গা বাহিনীর আদর্শিক জগতে অ-হিন্দু নারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যতক্ষণ না তারা হিন্দু ‘পরিবার’-কে রক্ষা করে। এই প্রতীকী অন্তর্ভুক্তি বহুত্ববাদের একটি বিভ্রমকে সমর্থন করে, অন্যদিকে মুসলিম নাগরিকদের পদ্ধতিগত প্রান্তিকীকরণ অবিরামভাবে অব্যাহত।
নারীবাদী আন্দোলনগুলো ঐতিহাসিকভাবে যুদ্ধের যুক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করেছে; কেবল কে যুদ্ধ পরিচালনা করে, তা নয়। যদি আমরা স্বীকার করি– জাতি গঠন স্বভাবতই পুরুষতান্ত্রিক, তাহলে সমাধান কেবল পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে আরও বেশি নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যেই নিহিত থাকতে পারে না। পরিবর্তে আমাদের জাতীয় সম্মানের সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে, যা নারীর মূল্যকে স্ত্রীর প্রতীক এবং যুদ্ধে ত্যাগের সঙ্গে সমান করে দেখে।

যুদ্ধক্ষেত্রে নারীবাদী রাজনীতি কেন্দ্র থেকে সামরিকতন্ত্রকে সরিয়ে দিতে হবে, বেসামরিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা, পুনর্বাসন ও নীতিনির্ধারণে নারী নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে হবে– এটি এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে বোমা বা সাহসিকতার মাধ্যমে সিঁদুরের অনুপস্থিতি দূর করা যায় না। জাতীয় নিরাপত্তায় প্রকৃত নারী-পুরুষ ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ভিন্নমতাবলম্বী নারী নেত্রীদের এগিয়ে নিয়ে যাবে, যারা পিতৃতান্ত্রিক রূপকগুলো মেনে নিতে অস্বীকার; বিধবাদের বৈষয়িক সাহায্য এবং রাষ্ট্রীয় গুণাবলির প্রতীক হিসেবে বৈবাহিক প্রতীকবাদ প্রত্যাখ্যান করে।
অপারেশন সিঁদুর শক্তিশালী শিরোনাম হতে পারে। কিন্তু এতে নারীবাদী বিজয়ের মায়ার আড়ালে একটি পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক লিপি লুকিয়ে আছে। যেমন নারীরা মাতৃভূমির রূপক হিসেবে শুধু তখনই মূল্যবান যখন তারা যুদ্ধকালীন চাহিদা পূরণ করে। মুক্তি সামরিকীকরণের মধ্যে নয়, বরং নারীদের জাতীয়তাবাদী রীতিনীতির সঙ্গে আবদ্ধ করে এমন লিঙ্গভিত্তিক রূপকগুলো ভেঙে ফেলার মধ্যে এবং যুদ্ধের মঞ্চের বাইরেও কর্তৃত্বের অর্থ প্রসারিত করার মধ্যে নিহিত।

nঅমৃতা দত্ত ও অরণী বসু যথাক্রমে বিলেফেল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বিলেফেল্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুলের প্রভাষক এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইডেলবার্গ সেন্টার ফর ট্রান্সকালচারাল স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক; আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘শত শত বাস আসছে, পা ফেলানোর জায়গা নাই’
  • অপারেশন সিঁদুর: নারীর নামে পুরুষের যুদ্ধ