ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ১৬ এপ্রিল ইউরোপীয় কমিশনের তৈরি করা নিরাপদ উৎস দেশের তালিকা দেখিয়ে বলেন, ‘তথ্য প্রমাণ করে যে আমরা সঠিক ছিলাম।’ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেন তালিকাটিতে বাংলাদেশ ও মিসরের নাম রেখে মেলোনিকে ভালোই সুযোগ দিয়েছেন। কারণ, ইতালি যে বিতর্কিত পরিকল্পনার মাধ্যমে দ্রুত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আলবেনিয়ায় পাঠাতে চায়, বাংলাদেশ ও মিসর এর অন্যতম।

গত বুধবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এমন সাতটি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে, যাদের বর্তমানে তারা ‘নিরাপদ’ মনে করছে। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, মিসর, কসোভো, কলম্বিয়া, ভারত, মরক্কো ও তিউনিসিয়া। ইইউর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এই তালিকা পাস করলে অভিবাসী হিসেবে এসব দেশের নাগরিকদের ইইউভুক্ত দেশগুলোতে আশ্রয় পাওয়া কঠিন হবে।

প্রস্তাবিত তালিকা চূড়ান্ত করার বিষয়টি ইইউ আদালতের আদেশের অপেক্ষায় আছে। ইতিমধ্যে এসব দেশকে নিরাপদ মনে করার পক্ষে তথ্য ও মূল্যায়ন সরবরাহ করেছে ইউরোপীয় কমিশন। এতে এসব দেশকে নিরাপদ তকমা দেওয়ার যুক্তি পেয়েছে ইতালি। ইতালিতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রায় ৩০ শতাংশ আবেদন যায় বাংলাদেশ ও মিসরীয়দের কাছ থেকে।

শরণার্থীবিষয়ক ইইউ অ্যাসাইলাম এজেন্সির (ইইউএএ) তথ্য ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অভিবাসীদের জন্য নিজের দেশ কতটা নিরাপদ, সেই ভিত্তিতে ‘নিরাপদ দেশের’ তালিকা তৈরি করেছে ইউরোপীয় কমিশন। ইইউর পরামর্শ ছিল, যেসব দেশের নাগরিকেরা ইইউতে আশ্রয় চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আবেদন করেন, অথচ অনুমোদিত হয় ৫ শতাংশ বা তার চেয়ে কম, সেসব দেশকে নিরাপদ বলা যেতে পারে। তার ওপর ইইউভুক্ত দেশগুলোর নিজস্ব তালিকায় অভিবাসনপ্রত্যাশী যে দেশগুলোর নাম ছিল, সেসব দেশকেই বিবেচনায় নিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন।

নিরাপদ দেশের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে মূল্যায়নের জন্য ইইউতে যেসব তথ্য সরবরাহ করেছিল, তা ‘বিভিন্ন উৎস’ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ইইউর বিভিন্ন ইনস্টিটিউট, ইইউ মৌলিক অধিকার সংস্থা (এফআরএ) এবং জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) প্রতিবেদন অন্যতম। পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি সংস্থা, থিঙ্কট্যাংকের বিশ্লেষণ এবং যাচাই করা সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনও ছিল।

মিসর ও বাংলাদেশের নাম ইইউভুক্ত ছয়টি দেশের তালিকায় ছিল। ২০২৪ সালে এই উভয় দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ৪ শতাংশের আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। গত বছর ইইউজুড়ে প্রায় ৬৮ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশীর আবেদন গৃহীত হয়েছে, যাঁদের ৭ শতাংশ বাঙালি ও মিসরীয়। এঁদের দুই–তৃতীয়াংশের বেশি আবেদন করেছেন ইতালিতে। দেশটিতে গত বছর অভিবাসনের জন্য আবেদনকারীদের ২১ শতাংশ বা ৩৩ হাজার ৪৫৫ জন ছিলেন বাংলাদেশি। মিসরীয়রা ছিলেন ৮ শতাংশ, সংখ্যায় ১১ হাজার ৯৭৯।

বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিবর্তন

বাংলাদেশ নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের বক্তব্য হলো, দেশটি ‘রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা কিনা অতীতের মানবাধিকার হননকারী দমনমূলক ব্যবস্থা থেকে দেশটিকে বের করে এনেছে। বাংলাদেশ একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র। সেখানে গত আগস্টে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়। খবর বলছে, গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ ১১ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করে। ৬০০–এরর বেশি বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। কমিশন আশা করছে, অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নির্বাচন আয়োজন করবে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ শুরু করবে।

বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থিত ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ‘যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড, নির্যাতন, নিপীড়ন, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণের ঝুঁকি রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশি নাগরিকদের বহিষ্কার, বিতাড়িত বা প্রত্যর্পণের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।’ তবে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ‘মাঝেমধ্যে উত্তেজনা’ দেখা যায়। অন্যদিকে সেখানে রূপান্তরকামীসহ এলজিবিটিকিউআই জনগোষ্ঠীর লোকজন ‘বৈষম্য ও হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন’। দেশটিতে সমকামিতা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী কমিশন ‘ইস্তাম্বুল সনদ’ অনুমোদন করলেও বাংলাদেশে ‘লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা একটি ব্যাপক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। দেশটিতে কর্মক্ষেত্র এবং স্কুলে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে।’

জাতিসংঘের নির্যাতন ও নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণবিরোধী কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চার অ্যান্ড ক্রুয়েল, ইনহিউম্যান অ্যান্ড ডিগ্রেডিং ট্রিটমেন্টে সই করলেও ঢাকা সব সময় তা মেনে চলে না। অন্তত গত সরকারের আমল পর্যন্ত দেশটিতে ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সামরিক বাহিনী কর্তৃক আটক ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে।’ দেশটিতে এখনো মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু ‘মৃত্যুদণ্ড খুব কমই কার্যকর করা হয়।’

সুতরাং ইউরোপীয় কমিশন বলছে, বাংলাদেশে ‘কোনো সশস্ত্র সংঘাত চলছে না। তাই আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যেমনটা ঘটে, সেখানে তেমন নির্বিচার সহিংসতারও কোনো হুমকি নেই।’

মিসরে জরুরি অবস্থার অবসান

২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ২০২১ সালে জরুরি অবস্থা বাতিল করেছেন। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিরতি বাদে দেশটি ৪০ বছর ধরে জরুরি অবস্থার মধ্যে ছিল।

মিসর সম্পর্কে ইউরোপীয় কমিশনের মূল্যায়নে বলা হয়, কর্তৃপক্ষ জরুরি ও সামরিক আদালতগুলো ব্যবহার করে সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং অন্যান্য আইনে মানুষের বিচার করছে। দেশটির সংবিধানে ধর্মীয় ও লিঙ্গপরিচয় সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে বৈষম্য এবং উসকানিমূলকভাবে ঘৃণা সৃষ্টির মতো অপরাধের শাস্তি দেওয়ার আইন রয়েছে। তা সত্ত্বেও ‘কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায় সেখানে বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ আর ‘মানবাধিকার ও রাজনৈতিক কর্মী এবং বিরোধীরা নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। তাঁরা ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা এবং সম্পদ জব্দের মতো ব্যবস্থার শিকার হতে পারেন।’

ইউরোপীয় কমিশন মনে করছে যে মিসরে এখনো ‘গুরুতর’ মানবাধিকার চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। তবে কমিশন গত কয়েক বছরে দেশটিতে কিছু উৎসাহব্যঞ্জক পদক্ষেপকে গুরুত্ব দিচ্ছে। নিজেদের জাতীয় মানবাধিকার কৌশলে বিচারপূর্ব আটক–সংক্রান্ত নিয়মের সংস্কার এবং আটকাবস্থা সুযোগ–সুবিধার উন্নতির অঙ্গীকার করা হয়েছে। পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধের সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং ‘সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে মানবাধিকার সংস্কৃতি শক্তিশালী করার’ বিষয় কর্মসূচিতে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ ও মিসরের আইনসভার প্রস্তাব এবং বাস্তবতার মধ্যে ফারাক থাকা সত্ত্বেও উভয় দেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি তুলে ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত হলো, ‘বিশ্লেষণের আলোকে এবং ইইউতে আবেদন গৃহীত হওয়ার নিচু হারের ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশ ও মিসরের জনগণ সাধারণত নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন না বা তাঁরা গুরুতর ক্ষতির ঝুঁকিতে নেই।’

আরও পড়ুনইইউর ‘নিরাপদ’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশসহ ৭ দেশ, কঠিন হবে আশ্রয় পাওয়া১৬ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য ন র পদ সব দ শ অবস থ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

করিডোরের জন্য দু’দেশের সম্মতি লাগবে: জাতিসংঘ 

রাখাইন রাজ্যের বেসামরিক নাগরিকের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠাতে করিডোরের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্মতি প্রয়োজন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। 

ঢাকার জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় সমকালকে এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশে জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা।

জাতিসংঘ অন্য অংশীদারকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন জোরদার করবে। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে যে কোনো মানবিক সহায়তা বা সরবরাহের জন্য প্রথমে দুই সরকারের মধ্যে সম্মতি প্রয়োজন। সীমান্ত অতিক্রম করে সহায়তা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর অনুমতি নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটি ছাড়া জাতিসংঘের সরাসরি ভূমিকা সীমিত।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত রোববার এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোরের ব্যাপারে সম্মত। কারণ এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ 

এ খবর চাউর হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নের শঙ্কা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সরকার কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তথাকথিত মানবিক করিডোর স্থাপন নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা হয়নি বলে দাবি করছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

গত অক্টোবরে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে ১২ পাতার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে রাখাইনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়। রাখাইনের পণ্য প্রবেশের জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সীমান্ত বন্ধ রয়েছে, আয়ের কোনো উৎস নেই। ভয়াবহ মূল্যস্থিতি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে ধস, জরুরি সেবা এবং সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা করছে জাতিসংঘ। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ