নারীবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদন ও নারীবিরোধী প্রতিক্রিয়া
Published: 22nd, April 2025 GMT
গত ১৯ এপ্রিল ‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শিরোনামে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু বিষয় বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে– বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিয়ে-তালাক ও উত্তরাধিকারে নারীর সমানাধিকার; বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্তকরণ; ধর্ষণের শিকার লিঙ্গ বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতে আইনে ধর্ষণের ধারায় সংস্কার; যে কোনো উপস্থাপনায় সংগতিহীনভাবে নারীকে যুক্ত করে নারীবিদ্বেষী বয়ান; বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত রাখা; নারীর প্রতি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও সংবেদনশীল আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতাবিষয়ক কর্মসূচি গ্রহণ; সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি দেওয়া এবং পূর্ণ বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটি।
এসব সুপারিশ নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক নানা মহল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা অনেক সুপারিশকেই ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের অস্তিত্বের বিপরীত বলে মনে করে। হেফাজতে ইসলাম আরেকটু এগিয়ে। একই কারণে সুপারিশ বাতিলের পাশাপাশি পুরো কমিশনই বাতিলের দাবি তুলেছে তারা।
বলে রাখা প্রয়োজন, নারী অধিকার বিষয়ে জামায়াত ও হেফাজতের এই অবস্থা নতুন নয়। জামায়াত একটা সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। নানা বিষয়ে তাদের লিখিত বক্তব্য ও বই-পুস্তিকা কম নেই। বরাবরই তারা নারীকে পুরুষের অধীন মনে করেছে। এমনকি একসময় তারা নারী নেতৃত্ব ইসলামসম্মত নয় বক্তব্য দিলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মেনে ২০০১-০৬ সালে সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণে দ্বিধা করেনি।
হেফাজতে ইসলাম ২০১০ সালে শিক্ষানীতির বিরোধিতা, ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা এবং ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধিতায় মাঠে নেমেছিল। বিভিন্ন ইসলামবাদী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এ মঞ্চকে খুশি রাখতে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকার শেষ পর্যন্ত নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করেনি। বরং তখন থেকেই হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ‘প্রেম’ শুরু হয়, যদিও আজকে হেফাজতে ইসলাম আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিচ্ছে। গত ১৫ বছরের ইতিহাস দেখলে সহজেই বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের কতৃর্ত্ববাদী শাসনে এই গোষ্ঠীর অবদান কম ছিল না।
প্রশ্ন হলো, সরকার হেফাজত ও জামায়াতের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের ক্ষেত্রে কী অবস্থান নেবে? বলে রাখা দরকার, অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত নারীর বিরুদ্ধে যত মব সন্ত্রাস হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শিল্পী, মাজারপন্থি ও বাউলেরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে মব সহিংসতায়। এ বছরের জানুয়ারি মাসেই হেফাজতে ইসলামের হুমকির মুখে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় প্রসাধন ও অন্যান্য সামগ্রীর একটি কোম্পানির বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছিল, যা উদ্বোধন করার কথা ছিল চিত্রনায়িকা পরীমণির। এর আগে তাদেরই দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনা কমিটির দুই সদস্যকে বাদ দিতে গিয়ে পুরো কমিটিই বাতিল করে দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগও ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে রাজনীতি করেছে, বর্তমান সরকারও করছে। মজার বিষয় হলো, যখন জুলাই আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল, রাজপথে ছিল, তখন কিন্তু ছাত্রীদের ভূমিকা নিয়ে জামায়াত ও হেফাজত কোনো প্রশ্ন তোলেনি। বর্তমানে যখন রাজনীতিতে নারীদের কদর বাড়ছে তখন তারা আবার নারী অধিকারের বিরোধিতা শুরু করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি নারী কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে জামায়াত-হেফাজতের মতকে প্রাধান্য দেয়, তাহলে বাংলাদেশের নারীরা আবারও বঞ্চিত ও প্রতারিত হবে, সন্দেহ নেই। তবে এতে যে শেষ রক্ষা হবে, তা ভাবা ঠিক নয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে– রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই। হেফাজতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেও কিন্তু আওয়ামী সরকারের শেষ রক্ষা হয়নি।
বাংলাদেশে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়; এটি যেমন সত্যি; তেমনি ভোটের রাজনীতিতে মানুষ খুব বেশি ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোকে নির্বাচিত করেছে– ইতিহাসে এমন নজির নেই। বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলো কখনও এককভাবে নির্বাচন করে খুব বেশি আসনে জয়ী হতে পারেনি।
এ দেশে অর্ধেকের বেশি সংখ্যক নারী। সাম্প্রতিক আন্দোলনে তারা তাদের বক্তব্য জানিয়ে দিয়েছে, যা দেয়ালে দেয়ালে লিখিত গ্রাফিতিতেও পরিষ্কার। যদি বলা হয়, নারী কমিশন মূলত সেই বক্তব্যই অনেকাংশে তুলে আনতে চেয়েছে, তাহলে ভুল হবে না। আর জুলাই আন্দোলনের ধারক-বাহক হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার জামায়াত-হেফাজত কেন; কারও কথাতেই নারীবিরোধী অবস্থান নিতে পারে না।
যদিও বর্তমান সরকার অন্তর্বর্তীকালীন; একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের পথরেখা দেখিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তাদেরই। নারীবিদ্বেষী কোনো সরকার কোনোভাবেই জনবান্ধব সরকার হবে না– এ বিষয়টি আজকে মান্যতা পেলে তা ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকারের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। তাই নারীবিরোধীদের বিরোধিতায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন র ব ষয়ক র জন ত ক ইসল ম সরক র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে
দেশে রোগমুক্ত সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ড্রামে খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ একটি বড় বাধা। একইসাথে ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ ও গুণগত প্যাকেজিং অত্যন্ত জরুরি।
রাজধানীর বিআইপি কনফারেন্স রুমে সোমবার (২৮ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত “সবার জন্য ভিটামিন সমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল: অগ্রগতি, বাধা ও করণীয়” শীর্ষক সাংবাদিক কর্মশালায় এসব বিষয় তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত এই কর্মশালায় প্রিন্ট, টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়ায় কর্মরত ২৬ জন সাংবাদিক অংশ নেন।
কর্মশালায় জানানো হয়, জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপ ২০১১-১২ অনুযায়ী, প্রাক্-বিদ্যালয়গামী প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন ভিটামিন ‘এ’ এবং দুইজন শিশু ভিটামিন ডি-এর ঘাটতিতে ভুগছে। ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ ব্যতীত ভোজ্যতেল বাজারজাত করা নিষিদ্ধ। আইসিডিডিআর,বি-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে মোট ভোজ্যতেলের ৬৫ শতাংশই ড্রামে বিক্রি হয়। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ তেলে কোনো ভিটামিন ‘এ’ নেই, আর ৩৪ শতাংশ তেলে রয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে কম মাত্রায়। মাত্র ৭ শতাংশ ড্রামের খোলা তেলে আইন অনুসারে ভিটামিন ‘এ’–এর নির্ধারিত পরিমাণ পাওয়া গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ আইনটির সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কর্মশালায় জানানো হয়, নন-ফুড গ্রেড উপকরণে তৈরি ড্রাম দিয়ে ভোজ্যতেল পরিবহন করা হয়-যেগুলো আগে কেমিক্যাল, লুব্রিকেন্ট/মবিল বা অন্যান্য শিল্পপণ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ধরনের ড্রামে সংরক্ষিত খোলা ভোজ্যতেল জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, পাশাপাশি এতে ভেজাল মেশানোর আশঙ্কাও থাকে। এই পুরোনো ড্রামগুলোতে কোনো লেবেল বা উৎস সম্পর্কিত তথ্য না থাকায় তেলের উৎপত্তিস্থল বা সরবরাহকারীকে শনাক্ত করা যায় না। তাই খোলা ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ আইন বাস্তবায়নে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কর্মশালায় জানানো হয়, জুলাই ২০২২ এর পর থেকে ড্রামে খোলা সয়াবিন তেল এবং ডিসেম্বর ২০২২ এর পর থেকে খোলা পাম তেল বাজারজাতকরণ বন্ধে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। তাই নিরাপদ ভোজ্যতেল ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে শিল্প মন্ত্রণালয়, বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।
ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতি অন্ধত্ব, গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যুসহ নানা শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাব রিকেটস ও হাড় ক্ষয়ের পাশাপাশি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ প্রেক্ষাপটে, ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের খাবারের মাধ্যমে সহজেই এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন পেতে পারে।
এছাড়াও কর্মশালায় ভোজ্যতেলে গুণগতমানের প্যাকেজিং নিশ্চিতের উপরও জোর দেওয়া হয়। সাধারণত সূর্যরশ্মিসহ যেকোন আলোর সংস্পর্শে ভিটামিন ‘এ’ নষ্ট হতে থাকে এবং একপর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ভোজ্যতেল বাজারজাত হয় যেসব বোতলে সেগুলোর অধিকাংশই আলো প্রতিরোধী না হওয়ায় ভোজ্যতেলের গুণগত ও পুষ্টিমান হ্রাস পায়। সে কারণে ভোজ্যতেলের প্যাকেজিংয়ের জন্য আলো প্রতিরোধী অস্বচ্ছ উপাদান ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কর্মশালায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এর কার্যক্রম ও গবেষণাগার বিভাগের পরিচালক (উপসচিব) ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন; ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের কনসালটেন্ট সাবেক অতিরিক্ত সচিব মুশতাক হাসান মুহ. ইফতিখার; ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট আবু আহমেদ শামীম; দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর ডেপুটি এডিটর সাজ্জাদুর রহমান এবং প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।
কর্মশালায় গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা তুলে ধরেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন কান্ট্রি এডভোকেসি বাংলাদেশ-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. রীনা রাণী পাল এবং প্রজ্ঞা'র কর্মসূচি প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
ঢাকা/হাসান/সাইফ