রাজধানী ঢাকার গাবতলীতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) বীজ উৎপাদন খামারের প্রায় তিন বিঘা জমি বেদখল হয়ে গেছে। আন্তজেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে এই জমি দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

প্রথমে দখল করা হয় এক বিঘা জমি। এক মাসের ব্যবধানে এখন দখল করা জমির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে তিন বিঘা। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। যত সময় যাবে, জমি দখলের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিএডিসির কর্মকর্তারা।

বিএডিসি বলছে, যে জমি দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড করা হয়েছে, তার অবস্থান গাবতলীর মাজার রোডের বীজ উৎপাদন খামারের ভেতরে। এই জমি পাঁচ বছরের জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে মালামাল রাখার জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের জুনে ইজারার মেয়াদ শেষ হয়। তবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে জমিটি বিএডিসিকে হস্তান্তর করেনি। এর মধ্যেই তিন বিঘা জমি বেদখল হয়ে গেছে।

এক মাসের ব্যবধানে এখন দখল করা জমির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে তিন বিঘা। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

বিএডিসির কর্মকর্তারা বলেন, আন্তজেলা ট্রাকশ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে গত ২৩ মার্চ সরকারি দেয়াল ভেঙে এক বিঘা জমি দখল করা হয়। ওই সময় বিএডিসির পক্ষ থেকে দারুস সালাম থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। শুরুতে থানা-পুলিশ জমি দখলমুক্ত করার বিষয়ে আগ্রহী ছিল; কিন্তু পরে থানা-পুলিশ এ বিষয়ে বিএডিসিকে কোনো সহায়তা করেনি। এ কারণে আন্তজেলা ট্রাকশ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে খামারের আরও বেশি জমি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৬ এপ্রিল কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শনে দেখেন, এখন প্রায় তিন বিঘা জমি বেদখল হয়ে গেছে। বিষয়টি বিএডিসির চেয়ারম্যানকেও লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

সরেজমিন গত রোববার বীজ উৎপাদন খামারে দেখা যায়, মেট্রোরেল কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের মূল গেটের পশ্চিম পাশে মসজিদসংলগ্ন সরকারি দেয়াল ভেঙে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ওই রাস্তা দিয়েই দখল করা জমির ভেতরে সারি সারি ট্রাক রাখা হয়েছে। ভেতরে কয়েকজন পরিবহনশ্রমিককে দেখা গেছে। তাঁরা বলছেন, এই জমি কোনো কাজে লাগছে না। তাই এখানে মিনি ট্রাক রাখা হয়েছে।

মিরপুর বীজ উৎপাদন খামারের (গাবতলী) জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, কিছু লোক খামারের জমি দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করছেন। সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, শুরুতে যে পরিমাণ জমি দখল করা হয়েছিল, পরে আরও বেশি জমি দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড সম্প্রসারণ করা হয়েছে। পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়টি জানানো হয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।

ভেতরে কয়েকজন পরিবহনশ্রমিককে দেখা গেছে। তাঁরা বলছেন, এই জমি কোনো কাজে লাগছে না। তাই এখানে মিনি ট্রাক রাখা হয়েছে।পরিবহননেতাদের দৃষ্টি ছিল আগেই

মিরপুরের বীজ উৎপাদন খামারের আয়তন ১১৭ দশমিক ০৮ একর। মিরপুরের টেকনিক্যাল থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে তুরাগ নদ পর্যন্ত এই খামার বিস্তৃত। ১৯৫৭ সালে জমি অধিগ্রহণ করে বিএডিসিকে খামারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই খামারে মূলত উন্নতমানের বীজ উৎপাদন করে কৃষকের কাছে সরবরাহ করা হয়।

বিএডিসি সূত্র বলছে, এর আগেও এই বীজ খামারের জমি দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে ওই ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা হয়। এমনকি ২০১৮ সালে খামারের নার্সারির জন্য নির্ধারিত জমির সীমানাপ্রাচীর ভেঙে ট্রাকস্ট্যান্ড তৈরি করা হয়। পরে সেটিও উচ্ছেদ করা হয়। এই চক্র সুযোগ পেলেই খামারের জমি দখল করে। 

কিছু লোক খামারের জমি দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করছেন। সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, শুরুতে যে পরিমাণ জমি দখল করা হয়েছিল, পরে আরও বেশি জমি দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড সম্প্রসারণ করা হয়েছে। পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়টি জানানো হয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।মিরপুর বীজ উৎপাদন খামারের (গাবতলী) জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান খান

আন্তজেলা ট্রাকশ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক আলাউদ্দিন বলেন, আগেও এই জায়গা দীর্ঘদিন ট্রাকস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মেট্রোরেলকে ইজারা দেওয়ার পর ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা হয়। মেট্রোরেল জমিটি এখন পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়েছে। পরিবহনশ্রমিক ও মালিকেরা মিলে কেন্দ্রীয় কমিটির সহযোগিতায় এখানে ট্রাকস্ট্যান্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া এই জায়গা বিএডিসির কোনো কাজে লাগে না। আন্তজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতি কফিল উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেনসহ সবার সম্মতিতেই এই জমি দখলে নেওয়া হয়েছে।

কফিল উদ্দিন আন্তজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতির পাশাপাশি ঢাকা জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি এবং হানিফ পরিবহনের মালিক। ট্রাকস্ট্যান্ডের নামে বিএডিসির জমি দখলের বিষয়ে কফিল উদ্দিন বলেন, বিএডিসির জমি দখলে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। 

মেট্রোরেলের এমআরটি লাইন ৬-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইজারার মেয়াদ শেষ হলেও জমিটি কাউকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। অন্য একটি প্রকল্পের জন্য এই জমির আবার এমআরটির দরকার হবে। নতুন করে আবার ইজারা নেওয়া হবে। আর সরকারি জমি পরিবহননেতাদের কাছে হস্তান্তরের প্রশ্নই আসে না। আমরা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছি।’

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

দেয়াল ভেঙে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক বলে জানিয়েছেন বিএডিসির একাধিক কর্মকর্তা। তাঁরা বলেন, ২৩ মার্চ যখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দেয়াল ভেঙে জমি দখল করা হয়, তখন পুলিশকে জানানো হয়েছে। পরে থানায় লিখিতভাবে জানিয়ে সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছে। শুরুতে পুলিশ খুবই গুরুত্ব দিয়েছিল। পরে থানায় পরিবহননেতাদের সঙ্গে পুলিশ বৈঠক করে। ওই বৈঠকের পর পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তারা আর সরকারি জমি দখলদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। 

তবে দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিব-উল-হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জমি দখল করার বিষয়ে থানায় করা জিডির তদন্ত চলছে। দখলের বিষয়টি অধর্তব্য অপরাধ। এ কারণে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে বিএডিসিকে আদালতের অনুমতি নিতে বলা হয়েছে। অনুমতি পেলে পুলিশ সহায়তা করবে। এখন যাঁদের দখলে আছে, তাঁদের পুলিশ এভাবে সরিয়ে দিতে পারে না। 

ইজারার মেয়াদ শেষ হলেও জমিটি কাউকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। অন্য একটি প্রকল্পের জন্য এই জমির আবার এমআরটির দরকার হবে। নতুন করে আবার ইজারা নেওয়া হবে। আর সরকারি জমি পরিবহননেতাদের কাছে হস্তান্তরের প্রশ্নই আসে না। আমরা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছি।মেট্রোরেলের এমআরটি লাইন ৬-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

বিএডিসির কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের শতকোটি টাকার জমি দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড নির্মাণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে জানানো হয়েছে। তবে এই দখলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত র ব যবহ র কর র এমআরট র ব ষয়ট প রকল প র জন য হয় ছ ল পর ম ণ আরও ব প রথম সরক র দখল র গ বতল এখন প

এছাড়াও পড়ুন:

কোটার অধিনায়ক বাভুমা ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে করমর্দন

আর মাত্র এক রান!

লর্ডস তখন থমথমে উত্তেজনায় ঠাসা। গ্যালারির প্রায় সব দক্ষিণ আফ্রিকান দাঁড়িয়ে, যেন নিশ্বাস আটকে রেখেছেন। ব্যালকনিতে সবাই উঠে দাঁড়ালেও একজন তখনো বসে—টেম্বা বাভুমা। গালে হাত, চোখ মাঠের ভেতরে। ঠিক যেন একটা জীবন ধরে যে স্বপ্নটা দেখে এসেছেন, সেই মুহূর্তটা এখন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে।

মিচেল স্টার্কের ফুলটস বলটা কাইল ভেরেইনার ব্যাটে লেগে ফাঁকা জায়গায় ছুটতেই কী যেন হলো। কেউ চিৎকার দিলেন, কেউ দিলেন লাফ, কেউ পাশের জনকে জড়িয়ে ধরলেন, কারও–বা চোখে জল। সেই উন্মাদনার কেন্দ্রে, ঠিক মাঝখানে, বাভুমা মাথাটা নিচু করে ফেললেন। যেন আড়াল করতে চাইলেন কিছু। জয় এসেছে। অবশেষে। একের পর ‘কাছে তবু কত দূরের’ যন্ত্রণা, ‘চোকার্স’ তকমার গ্লানি, আর একজন কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়কের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া মৌন সংশয়—সবকিছুই যেন সেই নত মাথার আড়ালে লুকিয়ে। চারপাশের হইচইয়ের মধ্যে ওই নিঃশব্দতায় তখন দুনিয়া–কাঁপানো চিৎকারও যেন নগণ্য।

কয়েক সেকেন্ড পর বাভুমা মাথা তুললেন। হয়তো আরেকটু সময় নীরবেই কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু তাঁর চারপাশে তখন জড়ো হয়েছেন দলের অন্যরা। কেউ কাঁধে হাত রাখছেন, কেউ জড়িয়ে ধরছেন। লর্ডসের ব্যালকনিতে তখন দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের উদ্‌যাপন শুধু নয়, একটি জাতির আর একটি মানুষের জয়ের গল্পও লেখা হচ্ছিল।

বাভুমার গল্পে অনেক অধ্যায়। একটি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান পরিবারে এমন এক সময়ে তাঁর জন্ম, যখন বর্ণবাদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত দক্ষিণ আফ্রিকা। অন্ধকারে মানুষ আলো খোঁজে, হতাশায় খোঁজে আশা। সে কারণেই কি না দাদি তাঁর নাম রেখেছিলেন টেম্বা। সোজা বাংলায় বললে ‘আশা’ বা ‘বিশ্বাস’।

পরিবারের বাইরে, নিজের পাড়ার বাইরে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বাভুমাকে নিয়ে সবচেয়ে বড় আশাবাদের শুরুটা ২০১৪ সালে। সে বছরের ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টেস্ট অভিষেক তাঁর। দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট দলে সেটিই ছিল কোনো কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানের প্রথম ম্যাচ। তখন থেকেই বাভুমার বড় চ্যালেঞ্জটা হয়ে পড়ে দুটি।

প্রথমত, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো করা। খুব বিশেষ কিছু নয়, জাতীয় দলের হয়ে খেলা সব ক্রিকেটারের জন্যই এমন চ্যালেঞ্জ থাকে। কিন্তু বাভুমার জন্য এর চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরাও যে ক্রিকেট খেলতে পারে, ব্যাটিং করতে পারে, দলের জন্য কিছু এনে দিতে পারে, সেটি প্রমাণ করা। আরও স্পষ্ট করে বললে দক্ষিণ আফ্রিকার জটিল সমাজব্যবস্থায় সেই চ্যালেঞ্জ জেতা, যেখানে প্রতিনিয়ত অনুচ্চারে প্রশ্ন ওঠে—কে খেলতে পারে আর কে পারে না, কে ব্যাট করতে পারে আর কে পারে না, কে অধিনায়ক হতে পারে আর কে পারে না, কে জিততে পারে আর কে পারে না।

দক্ষিণ আফ্রিকা দলের চাপের মধ্যে ভেঙে পড়া, নকআউট ম্যাচে হেরে যাওয়ার ঘটনা ১৯৯২ বিশ্বকাপ থেকেই ঘটে আসছে। বিভিন্ন ম্যাচে বিভিন্ন ধরনের কারণ। কোথাও নিজেদের ভুল, কোথাও আবহাওয়া–দুর্ভাগ্য। এর মধ্যে ২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হার নিয়ে আলোচনা কিছুটা ব্যতিক্রম। বলা হয়ে থাকে, সেদিন কোটাপ্রথার কারণেই নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

ফাইনালে জায়গা করার ম্যাচটিতে কাইল অ্যাবোটকে বসিয়ে ভারনন ফিলান্ডারকে খেলিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। একাদশে অশ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়াতেই বোর্ড কর্তারা টিম ম্যানেজমেন্টকে চাপ দিয়ে তা করিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এটি অস্বীকার করলেও ২০১৬ সালে রীতিমতো ঘোষণা দিয়েই কোটাপ্রথা প্রবর্তনের ঘোষণা দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ড সিএসএ। দলের মধ্যে ন্যূনতম ৫৪ শতাংশ অশ্বেতাঙ্গ রাখতে হবে, যার মধ্যে ১৮ শতাংশ হবে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান (এ সিদ্ধান্ত পরে পর্যালোচনা করা হয়)।

ওই কোটাব্যবস্থাই বাভুমার জন্য হয়ে ওঠে হিতে বিপরীত। দলে জায়গা করার মতো যথেষ্ট পারফরম্যান্স করলেও অনেকের চোখেই তিনি হয়ে ওঠেন ‘কোটার খেলোয়াড়’। ধারণাটা তীব্রতর হয়ে ওঠে ২০২১ সালের মার্চে বাভুমা অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর। শুরুতে ছিলেন টি–টোয়েন্টি ও ওয়ানডের অধিনায়ক, ২০২২ বিশ্বকাপের পর টি–টোয়েন্টি ছেড়ে দিয়ে টেস্টের দায়িত্ব নেন। বাভুমার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা

২০২১, ২০২২ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোনোটিতে ভালো করেনি। দুই আসরেই বাদ পড়ে সুপার টুয়েলভ থেকে। ভালো খেলেননি বাভুমা নিজেও। তবে এ ধরনের ঘটনায় অন্যদের সমালোচনাটা সামর্থ্যকেন্দ্রিক হলেও বাভুমার জন্য তা ‘কোটা’র দিকে মোড় নেয়। এত কিছুর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ড তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে ভালোমতোই। ‘কোটার অধিনায়ক’ নামে ফিসফাস থাকলেও বাভুমাই থাকেন দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট দলের নেতৃত্বে। বিশেষ করে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে কুইন্টন ডি ককের হাঁটু মুড়ে সংহতি না জানানোর ঘটনায় ভূমিকা এবং দলের মধ্যে ঐক্য রক্ষার জন্য প্রশংসা কুড়ান একজন নেতার মতোই।

এরপর ২০২৩ সালে রানের মধ্যে থেকেই ভারতে বিশ্বকাপে খেলতে যান বাভুমা। এই আসরে দক্ষিণ আফ্রিকা লিগ পর্বে ৯ ম্যাচের ৭টিতে জিতে সেমিফাইনালে ওঠে। তবে বাভুমা ব্যাট হাতে রান না পাওয়ায় আর টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন ‘ক্যাপ্টেনস ডে’ অনুষ্ঠানে ঘুমিয়ে পড়ার ছবি ছড়িয়ে পড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়ে ওঠেন ‘মিম ক্যারেক্টার’।

তবে সেসব ট্রল, ব্যর্থতা আর সংশয়—সব পেছনে ফেলে বাভুমা এখন দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গর্বিত মুহূর্তের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ২০২৪ সালের ১৪ জুন, লর্ডসের মাঠে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট—একটি মুহূর্ত, যা এনে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত আইসিসি ট্রফি। ১২টি সেমিফাইনাল ও ১টি ফাইনালে হারের পর শেষমেশ আইসিসির শিরোপা জিতল দক্ষিণ আফ্রিকা।

তবে বাভুমার জন্য মুহূর্তটি দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়িয়েও কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের জয়ে নিহিত। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর প্রথমবার যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, সেখানে বলেছিলেন, ‘প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান হিসেবে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার গভীর তাৎপর্য আমি বুঝি।’ সেদিন খেলার দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেকে একজন ‘লিগ্যাসি তৈরি করা’ অধিনায়ক হিসেবে পরিচিত করতে চাওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন বাভুমা। সেই লিগ্যাসিই তৈরি করেছেন লর্ডসে।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে কেপটাউনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন বাভুমা। এর কয়েক দিন পর নিউল্যান্ডসের এসএসি জুনিয়র স্কুলে বছরের প্রথম টার্মের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের জন্য একটা লেখা নিয়ে আসেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। লেখাটি এই স্কুলের পুরোনো এক ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া। ২০০১ সালে নিউল্যান্ডসের এসএসি জুনিয়র স্কুলে গ্রেড সিক্সের শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছিল, ১৫ বছর পর তুমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাও, লেখো। একটি ছেলে লিখেছে, ১৫ বছর পর আমি নিজেকে দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি গায়ে দেখি, এ জন্য মিস্টার এমবেকির (দক্ষিণ আফ্রিকার তখনকার প্রেসিডেন্ট) সঙ্গে করমর্দন করছি।’

দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখা সেই ছেলেটার নাম টেম্বা বাভুমা। সেই বাভুমা দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন এত দিন। এবার জিতেছেন ট্রফি, যে ট্রফির জন্য দেশের অপেক্ষা দশকের পর দশকের। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা নিশ্চয়ই করমর্দন করবেন তাঁর সঙ্গে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার দিনই প্রেসিডেন্ট একটা টুইট করেছেন। সেই টুইটে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের পাশাপাশি বিশেষভাবে আছে বাভুমার নামও, ‘আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় প্রোটিয়াদের অভিনন্দন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। এই জয় তোমার, এই জয় গোটা জাতির।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ