‘পরিবারতন্ত্র’ উচ্ছেদের রাজনীতি কতটা বাস্তবসম্মত
Published: 28th, April 2025 GMT
আমি যখন অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে গিয়েছিলাম, তখন মেলবোর্ন শহরের বাইরে একটু গ্রামীণ পরিবেশে একটি বাসায় ভাড়া থাকতাম। সেই বাসার মালিক ছিলেন বেশ ধনী একজন লোক; তাঁর সম্ভবত ৮ থেকে ১০টি বাড়ি ছিল। তাঁর একটাই মেয়ে ছিল, যাকে তিনি তখনই তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে একটি বাড়ি দিয়েছিলেন।
একদিন আমি ‘বাঙালি স্বভাব’ অনুযায়ী লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি কি আপনার সব সম্পত্তি মেয়েকে দিয়ে যাবেন?’ তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘না, সব দেব না। আমাদের দেশে এটা ঠিক নয়। এখানে সন্তানেরা নিজেরাই গড়ে ওঠে। সরকার আর সমাজ তাদের পাশে থাকে। তাই সবকিছু সন্তানের নামে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এরপরও কেউ যদি নিজের সব সম্পদ সন্তানদের দিতে চায়, তখন আমরা তাকে নেতিবাচকভাবে দেখি।’
এমন দৃষ্টিভঙ্গি শুধু অস্ট্রেলিয়ার নয়, আমেরিকা–ইউরোপেও দেখা যায়। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, ইলন মাস্কদের মতো ধনী ব্যক্তিরাও ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁদের সম্পদের বড় অংশ ‘জনকল্যাণে’ দান করবেন। কারণ, তাঁদের বিশ্বাস, বেশি সম্পত্তি সন্তানের দায়িত্ববোধ নষ্ট করে দেয়।
এসব দেশ বৃদ্ধদের পেনশন, চিকিৎসা দেয়; বেকারদের ভাতা দেয়। তাই বাবা-মায়েদের সন্তাননির্ভর হয়ে থাকতে হয় না। এই চিন্তাভাবনা এক দিনে আসেনি। সমাজকাঠামো আর রাষ্ট্রের ভূমিকা পাল্টে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এসব পরিবর্তন এসেছে।
এ অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবতে বাধ্য করল, বাংলাদেশে তো পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আমাদের সমাজে পরিবার মানে শুধু আত্মীয়তা নয়, এটি জীবনের নিরাপত্তা, আশ্রয় ও শেষ ভরসার জায়গা। বাবা-মায়েরা তাঁদের জমি, টাকাপয়সা, সঞ্চয়—সবকিছু সন্তানের হাতে তুলে দেন। তাঁরা মনে করেন, সন্তানই তাঁদের বার্ধক্যের শেষ ভরসা, চিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তা ও সামাজিক মর্যাদার ভিত্তি। ফলে সন্তানদের যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়া ও পরবর্তী সময়ে তাদেরই সব সম্পদ দিয়ে দেওয়া আমাদের সমাজে একধরনের ‘নিয়ম’ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুনরাজনৈতিক দলগুলোর কোনো অনুশোচনা নেই কেন২১ মার্চ ২০২৫পরিবার, অভ্যাস ও সামাজিক পুঁজিএই পরিবারনির্ভরতা কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নেই, এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাদের সমাজকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাসেও পড়েছে। বিষয়টি বুঝতে আমরা ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়েরে বোর্দিওর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ‘হেবিটাস’ ও ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ প্রসঙ্গিকভাবে ব্যবহার করতে পারি।
হ্যাবিটাস বলতে বোঝায় এমন একধরনের স্বভাব বা মানসিকতা, যা গড়ে ওঠে পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাবে। আমরা কীভাবে চিন্তা করি, স্বপ্ন দেখি বা সিদ্ধান্ত নিই, সবই এ অভ্যাসের অংশ। মাইক্রোফিনান্স অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্ট: উইমেন ডেবট ইন বাংলাদেশ বইয়ে লামিয়া করিম দেখিয়েছেন, কীভাবে গ্রামের নারীরা পরিবার ও সমাজের চাপে এমনভাবে গড়ে ওঠে, যেখানে তারা নিজের কথা বলার সুযোগই পায় না। এ অভ্যাসই তাদের আত্মবিশ্বাস বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে আটকে রাখে।
■ বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, সেখানে পরিবারই হয়ে ওঠে নিরাপত্তা, উপায় ও স্বীকৃতির প্রধান উৎস। ■ পরিবারতন্ত্র সামাজিক কাঠামোরই একটি বহিঃপ্রকাশ, যেখানে মানুষ পরিবারকে জীবনের ভরসা হিসেবে দেখে এবং সেই ভরসা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। ■ আমাদের সমাজে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার ধারণা এমনভাবে গঠিত হয়েছে, যেখানে পরিবার মানেই নেতৃত্বের বৈধতা; রক্তের সম্পর্ক মানেই অধিকার। এসব ধারণা এখনো আমাদের সমাজের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।অন্যদিকে সোশ্যাল ক্যাপিটাল হলো এমন একধরনের শক্তি, যা আমরা সামাজিক সম্পর্ক, পরিচিতি ও যোগাযোগের মাধ্যমে অর্জন করি। ‘মাইগ্রেশন এজ আ লিভিংহুড স্ট্র্যাটেজি অব দ্য পুওর’ গবেষণায় এ ধারণা ব্যবহার করেছেন অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি দেখিয়েছেন, বিদেশে থাকা আত্মীয়ের মাধ্যমে অনেকেই সহজে অভিবাসন করতে পারে, যেটা অন্যদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে একটি পরিবার অভিবাসনের অভিজ্ঞতা, যোগাযোগ আর মানসিকতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তর করে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, পরিবারে কীভাবে হ্যাবিটাস ও সোশ্যাল ক্যাপিটাল একসঙ্গে কাজ করে।
‘ইয়ুথ, পভার্টি অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট’ গবেষণায় প্রায় একই রকমই ব্যাখ্যা দিয়েছেন ড.
বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, সেখানে পরিবারই হয়ে ওঠে নিরাপত্তা, উপায় ও স্বীকৃতির প্রধান উৎস। এই পারিবারিক অভ্যাস ও সম্পর্কের শক্তি যখন রাজনীতির ভেতর ঢুকে পড়ে, তখন সেটাকে অভিহিত করা হয় ‘পরিবারতন্ত্র’ বলে।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রকে শুধু কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমস্যা বললে ভুল হবে। এটি আমাদের সামাজিক কাঠামোরই একটি বহিঃপ্রকাশ, যেখানে মানুষ পরিবারকে জীবনের ভরসা হিসেবে দেখে এবং সেই ভরসা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
রাজনীতির বাইরেও পরিবারতন্ত্রপারিবারিক প্রভাব বা ‘আধিপত্য’ কেবল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ থাকে না; বাংলাদেশে ব্যবসা, শিক্ষা ও উন্নয়ন খাতেও এর স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। অনেক এনজিও (বেসরকারি সংস্থা), এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় পরিবারভিত্তিক বোর্ড দ্বারা, যেখানে সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের সদস্যরাই।
এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত দক্ষতার চেয়ে সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে যোগ্যতা নয়, আত্মীয়তাই হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মূল মাপকাঠি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও একই প্রবণতা লক্ষণীয়; পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোয় পেশাদার ব্যবস্থাপনার চেয়ে পরিবারভিত্তিক সিদ্ধান্ত বেশি গুরুত্ব পায়।
বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্রের গভীর শিকড় কেবল রাজনীতি বা অর্থনীতিতে নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চর্চার মধ্যেও গেঁথে আছে। উপমহাদেশের সুলতানি, মোগল বা নবাবি আমলে নেতৃত্ব ছিল সম্পূর্ণরূপে বংশানুক্রমিক ও পরিবারকেন্দ্রিক। সেই আমলে শাসকের সন্তান বা আত্মীয়রাই নেতৃত্বে আসার অধিকার দাবি করতেন।
এ ধরনের শাসনব্যবস্থা আমাদের সমাজে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার ধারণাকে এমনভাবে গঠন করেছে, যেখানে পরিবার মানেই নেতৃত্বের বৈধতা; রক্তের সম্পর্ক মানেই অধিকার। এসব ধারণা এখনো আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
এ মনস্তত্ত্ব ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চর্চার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশে বহু স্থানে পীর-মাজার সংস্কৃতি প্রচলিত। এসব ক্ষেত্রে একজন পীরের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে বা পরিবারের সদস্যরাই পীরের আসনে বসেন এবং অনুসারীরা তা মেনে নেন।
এগুলো কোনো ধর্মীয় বিধান নয়, বরং একটি সামাজিক রীতি বা সাংস্কৃতিক অনুশীলন যা আমাদের পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্বের মানসিকতা ও স্বীকৃতির দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। এমন রীতি বা চর্চা সমাজে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে সেটি সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা অবলম্বন করে। এটি প্রমাণ করে যে আমাদের মানসিক গঠন এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যেখানে নেতৃত্ব মানেই পারিবারিক উত্তরাধিকার।
আরও পড়ুনক্ষমতাপ্রত্যাশীরা নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে চায় না২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫পরিবারতন্ত্র: একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতাপরিবারতন্ত্র কেবল দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সমস্যা নয়; বরং এটি একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান। যদিও এর রূপ, পরিসর ও প্রভাব দেশের সামাজিক কাঠামো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে, তবু সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিবারগুলোর ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা অনেক দেশের রাজনৈতিক জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বুশ, কেনেডি ও ক্লিনটন পরিবারের মতো প্রভাবশালী পরিবারগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মূল স্রোতে সক্রিয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছেলে ব্যারন ট্রাম্পকে সম্প্রতি রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় সম্মেলনের জন্য প্রতিনিধি হিসেবে বাছাই করা হয়েছিল, যদিও পরে তিনি নিজেই সরে দাঁড়ান। অনেকের মতে, তাঁকে ভবিষ্যতে বড় কোনো রাজনৈতিক দায়িত্বের জন্য তৈরি করা হতে পারে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর বাবা পিয়েরে ট্রুডোর রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন। ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের রাজনীতিতেও পরিবারতন্ত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সংসদ সদস্যদের প্রায় ১০ শতাংশের বাবা বা মা আগে সংসদ সদস্য ছিলেন। এটা ‘রাজনৈতিক উত্তরাধিকার’ ধারণার প্রমাণ বহন করে। যদিও ইউরোপে এ ধরনের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম, তারপরও এটি একেবারে অনুপস্থিত নয় (দ্য ব্রাসেলস টাইমস, ২০২০)।
জাপানে পরিবারতন্ত্রের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ রয়েছে। এখানে রাজনৈতিক পরিবারগুলো ‘জিবান’ (স্থানীয় ভিত্তি), ‘কানবান’ (পরিবারের নাম ও খ্যাতি) এবং ‘কাবান’ (অর্থনৈতিক সহায়তা) নামের তিনটি মূলধনের ওপর নির্ভর করে। জাপানের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের প্রায় ৩০ শতাংশ সদস্যই উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনীতিতে এসেছেন; আর শাসক দল এলডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ সদস্যই কোনো না কোনো রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান (দ্য ডিপ্লোম্যাট, ২০১৭ এবং ইস্ট এশিয়া ফোরাম, ২০২৩)।
লক্ষণীয় হলো, এসব দেশ শক্তিশালী নির্বাচনব্যবস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ এ ধরনের পরিবারতান্ত্রিক প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে; পরিবারতন্ত্র থাকলেও সেটি একচ্ছত্র ক্ষমতায় রূপ নেয় না।
আমার এই লেখার মূল বক্তব্য হচ্ছে, পরিবারতন্ত্র শুধু একটা দলের সমস্যা নয়, এটা আমাদের সমাজের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার অংশ। প্রয়াত ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন একাধিক টক শো ও পত্রিকায় বলেছিলেন, পারিবারিক রাজনীতি আসলে আমাদের সমাজের রাজনৈতিক দলবদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। তাঁর মতে, যদি জনগণ একে মেনে নেয়, তাহলে সেটাও একধরণের গণতন্ত্রের প্রকাশ হতে পারে (চ্যানেল আই টক শো)।
অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ: আ পলিটিক্যাল হিস্ট্রি সিন্স ইনডিপেনডেন্স বইয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে ক্ষয় করে। তিনি এটাও বলেছেন, এ সমস্যা আসলে সমাজ থেকেই আসে; দলীয় আনুগত্য, পৃষ্ঠপোষকতা ও নেতাকে নিয়ে ‘নায়কতান্ত্রিক’ সংস্কৃতিই এর মূল শিকড়।
দ্য পলিটিকস অব দ্য গভর্নড বইয়ে ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক পার্থ চ্যাটার্জি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে জনগণ অনেক সময় নেতাকে পরিবারের একজন বড় মানুষের মতো ভাবেন, যিনি সুরক্ষা দেন, সিদ্ধান্ত নেন এবং যাঁর প্রতি ভক্তি তৈরি হয়। ফলে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যোগ্যতা নয়, সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় প্রধান মানদণ্ড।
এ রকম বাস্তবতায় ‘রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নিপাত যাক’ কেবল একটি স্লোগান হয়েই থাকবে, যদি না আমরা বুঝতে পারি এটি একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত বাস্তবতার প্রতিফলন। তবে এর মানে এই নয় যে কোনো রাজনৈতিক পরিবার থেকে কেউ রাজনীতিতে এলে তাঁকে অগ্রাহ্য করতে হবে।
বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত, সেই ব্যক্তি কি যোগ্য? তিনি কি সংগঠক হিসেবে দক্ষ? জনগণ কি তার ওপর আস্থা রাখে? যদি এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হয়, তবে তাঁকে বাধা না দিয়ে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে; যেখানে থাকবে জবাবদিহি, অংশগ্রহণ ও কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
পরিবারতন্ত্রকে শুধু ক্ষমতাধর পরিবারের সমস্যা হিসেবে না দেখে সমাজকাঠামোর অন্তর্নিহিত রূপ হিসেবে বোঝা জরুরি। কেবল স্লোগান, ক্ষোভ, আবেগ কিংবা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো পরিবর্তন আসবে না। পরিবর্তন আসতে পারে শিক্ষা, বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও নাগরিক সচেতনতার মধ্য দিয়ে; ধাপে ধাপে, ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এগুলো করতে হবে।
●মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ত ক পর ব র র ব রতন ত র র জন ত ক ব র র জন ত ক র জন ত ক দ র জন ত ক প আম দ র স ক র জন ত র জন ত ত পর ব র র প রজন ম ব স তবত ব যবস থ এমনভ ব প রবণত ন র ভর র জন য ও পর ব জ বন র র ওপর ক ষমত সমস য র একট সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলে আবার ইরানের হামলা, নাগরিকদের নেওয়া হলো সুরক্ষিত এলাকায়
ইসরায়েলের হাইফা ও তেল আবিব শহর লক্ষ্য করে ইরান নতুন করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের এক মুখপাত্রের বরাতে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, এ হামলা ভোর পর্যন্ত চলবে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম প্রেস টিভি ও আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা মেহের নিউজের প্রতিবেদনেও নতুন করে ইসরায়েলে ইরানের হামলা চালানোর কথা বলা হয়েছে। খবর-গার্ড়িয়ান
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলি শহর তেল আবিব ও হাইফা শহরে আঘাত করেছে। এতে চলতি সপ্তাহের জি-৭ বৈঠকে বিশ্ব নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে, এই দুই আঞ্চলিক শত্রুর মধ্যে সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যকে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ইরান থেকে ছোড়া নতুন ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত: ইসরায়েলি সেনাবাহিনী
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা ইরান থেকে ছোড়া নতুন ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আকাশে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
নাগরিকদের সুরক্ষিত এলাকায় আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান: ইসরায়েলি বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, ইরানের হামলার ব্যাপারে নাগরিকদের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সাধারণ জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করতে বলা হয়েছে।
পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার পর পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে বলেছে, দেশের সমস্ত অঞ্চলের সুরক্ষিত এলাকা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব। নাগরিকরা এখন দেশের সমস্ত অঞ্চলের সুরক্ষিত এলাকা ছেড়ে যেতে পারে।
এর আগে রোববার সোমবার ভোরে ইসরায়েলে ইরানের হামলায় চারজন নিহত ও ৮৭ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ান। এছাড়া বেশ কিছু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছে।
ইসরায়েলের ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম (এমডিএ) জরুরি পরিষেবা সোমবার জানিয়েছে, মধ্য ইসরায়েলের চারটি স্থানে হামলায় চারজন নিহত এবং ৮৭ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে দুজন মহিলা এবং দুজন পুরুষ, যাদের সকলের বয়স আনুমানিক ৭০ বছর।
নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪ জনে: ইরানের আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা মেহের নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের হাইফা ও তেল আবিব শহর লক্ষ্য করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। ইসরায়েলে ইরানের হামলায় শুক্রবার থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪ জনে।
তেল আবিবের কাছে মধ্য ইসরায়েলি শহর পেতাহ টিকভা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সেখানে একটি আবাসিক ভবনে আঘাত করেছে। কংক্রিটের দেয়াল পুড়ে গেছে। জানালা উড়ে গেছে। একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দেশটির জরুরি সেবা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উত্তরাঞ্চলীয় বন্দর শহর হাইফায় হামলায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে অনুসন্ধান চলছে। যেখানে প্রায় ৩০ জন আহত হয়েছেন। বন্দরের কাছে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
নতি স্বীকারের কোনোও ইচ্ছা নেই: ইরান
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, দেশটি ইসরায়েলে কমপক্ষে ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে উত্তেজনা কমানোর জন্য আন্তর্জাতিক আহ্বানের কাছে নতি স্বীকার করার কোনোও ইচ্ছা তাদের নেই। কারণ শুক্রবার তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং সামরিক নেতৃত্বের ওপর ইসরায়েলের আকস্মিক আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা জোর দিয়েছে।
এর আগে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে হামলা চালায় ইসরায়েল। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সংক্ষেপে প্রচারিত ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বর্তমানে ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু।’ এতে কিছুক্ষণের জন্য টেলিভিশনটির সম্প্রচার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক মিনিট পরে সেটি পুনরায় সম্প্রচারে আসে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের অধীনস্থ ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান নিউজ নেটওয়ার্ক (আইআরআইএনএন) জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের হামলার শিকার হয়েছে। গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলা চালানোর মাধ্যমে ইসরায়েল ‘সত্যের কণ্ঠস্বরকে থামিয়ে দেওয়ার’ চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান নিউজ নেটওয়ার্ক কর্তৃপক্ষ।
ইসরায়েলের হামলার পর আগুনে পুড়তে থাকা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন ইরানি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের এক সাংবাদিক। ভিডিওটিতে ওই সাংবাদিক বলেন, তিনি নিশ্চিত নন—এই হামলায় তার কতজন সহকর্মী নিহত হয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে ইসরায়েলি হামলায় সেখানকার বেশ কয়েকজন কর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে এবং তাদের পরিচয় কী, সে বিষয়ে এখনও বিস্তারিত কিছু জানাননি কর্মকর্তারা।
টেলিভিশনটির একজন সাংবাদিক বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, হামলার সময় তারা ভবনটিতে কাজ করছিলেন। তখন সরাসরি সম্প্রচার চলছিল। কিন্তু আকস্মিক হামলার পর কিছুক্ষণের জন্য সম্প্রচার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক মিনিট পর অবশ্য পুনরায় সম্প্রচার কাজ চালু করতে সক্ষম হন টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ।
একপর্যায়ে টেলিভিশনটির সম্প্রচার শাখার প্রধান পেমান জেবেলি রক্তমাখা একটি কাগজ নিয়ে পর্দায় হাজির হন। সেটি দেখিয়ে তিনি বলেন, তারা ‘শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাবেন’।
গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলা চালানোর মাধ্যমে ইসরায়েল ‘সত্যের কণ্ঠস্বরকে থামিয়ে দেওয়ার’ চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান নিউজ নেটওয়ার্ক কর্তৃপক্ষ। ইসরায়েলের হামলার আগ মুহূর্তে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পর্দায় উপস্থাপিকাকে দেখা যাচ্ছিল। হামলার সময় উপস্থাপিকাকে দ্রুত সরে যেতে দেখা যায়। অন্যদিকে, গণমাধ্যম কার্যালয়টি ইরান সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছে ইসরায়েল।
এই হামলার কিছুক্ষণ আগে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও রেডিও ‘অদৃশ্য হতে যাচ্ছে’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। কাৎজের বিবৃতির বরাত দিয়ে বিবিসির খবরে বলা হয়, ইরানের প্রচারণা ও উসকানির মেগাফোন ‘অদৃশ্য হতে যাচ্ছে’।
এদিকে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে হামলার কথা স্বীকার করেছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। হামলার পর এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, তেহরানের স্থানীয় বাসিন্দাদের সরে যেতে বলার পরে ওই হামলাটি চালানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ইরানের স্বৈরশাসক যেখানেই থাকুন না কেন, তাকে আঘাত করা হবে।