শিশুর মাথা ঘামা নিয়ে যেন মা-বাবার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সাধারণত শিশুর এ আচরণকে অসুখ-বিসুখ ভাবা ঠিক নয়। রাতের বেলায় ঘুমানোর সময় মাথা ঘেমে যাওয়া, হাতের পাতা ঘেমে জবজবে হওয়া শিশুর বেলায় প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়। শিশুর মাথা ঘেমে গেলে, মাথায় কোনো সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ না থাকলে এ নিয়ে দুশ্চিন্তার তেমন কোনো কারণ নেই। শারীরিক কার্যকলাপের সময় উষ্ণ পরিবেশে মাথায় ঘাম একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। শিশুর ঘামের গ্রন্থিগুলো শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো মাথার ঘামের গ্রন্থিও অপরিপক্ব; যার কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘামে মাথা। শিশুর মাথা ঘামার সুবিধা হলো, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ হয়। মাথায় প্রচুর ঘাম গ্রন্থি থাকে এবং এই ঘাম শরীরকে ঠান্ডা করতে সাহায্য করে।
কেন শিশুর মাথা ঘামে
l জন্মগত হৃদরোগের কারণে শিশুর মাথা অতিরিক্ত ঘামতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুর অন্যান্য লক্ষণ থাকে। যেমন– হাত-পা, ঠোঁট নীল হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন নিউমোনিয়া হওয়া, শরীরের ওজন না বাড়া ইত্যাদি।
l থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত হরমোন তৈরির কারণে শিশুর মাথার ঘাম বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুর ঘাম বাড়ার সঙ্গে ওজন কমে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, ঘুম কমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা থাকে।
l শিশুর রিকেটস রোগের জন্য ক্যালসিয়াম
এবং ভিটামিন ডি’র অভাব হলে মাথার ঘাম বেড়ে যেতে পারে।
l ইডিওপ্যাথিক হাইপারহাইড্রোসিস নামক রোগের কারণে শিশুর অতিরিক্ত ঘাম বেড়ে যেতে পারে।
l কিছু কিছু ওষুধ যেমন– অ্যামফিটামিন, পেথেডিন, থাইরোক্সিন অতিমাত্রায় এ ওষুধগুলো মা খেলে বুকের দুধ খায় এমন শিশুর মাথা ঘেমে যেতে পারে।
l ক্যাফেইনযুক্ত খাবার মাথার ঘাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
l অতিরিক্ত মোটা কাপড়ও শিশুর মাথার ঘাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
কখন চিকিৎসক দেখাবেন
শিশুর ঘামের সঙ্গে যদি অন্যান্য কিছু লক্ষণ দেখা যায়। তবে চিকিৎসা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যেমন–
l বয়স অনুযায়ী ওজন এবং উচ্চতা না বাড়া।
l পর্যাপ্ত বিশ্রাম সত্ত্বেও শিশুর ক্লান্তি দূর না হওয়া।
l শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা। শ্বাস নিতে অসুবিধা বা ঘন ঘন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া।
l হাত, পা, ঠোঁট নীল হয়ে যাওয়া।
l কবজি ফুলে যাওয়া, দেরিতে হাঁটতে শেখা। হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত সামনের দিকে অথবা হাঁটুর কাছ থেকে দুই পা দু’দিকে বেঁকে যাওয়া।
চিকিৎসা
l গরম আবহাওয়ায় পাতলা সুতি কাপড় পরিধান করাবেন।
l ঘরের পরিবেশ ঠান্ডা এবং আরামদায়ক করা।
l শিশুকে পরিমাণমতো পানি এবং তরল খাবার দেওয়া।
l যেসব খাবার শিশুদের ঘাম বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমন– চা, কফি, চকলেট জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। v
v শিশুকে প্রতিদিন গোসল করাবেন।
শিশুর মাথার ঘাম একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া, যা পরবর্তী সময়ে শিশুর বড় হওয়ার পর থাকবে না। তবে কখনও কখনও এটি একটি অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যার কারণও হতে পারে। কারণগুলো বোঝা এবং কখন চিকিৎসা নেওয়া উচিত, তা জানা অভিভাবকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
[অধ্যাপক, শিশু বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ]
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ রন থ
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’
এবারের বাবা দিবস আমার কাছে একটু অন্যরকম। চারপাশ যেন কিছুটা বেশি নিস্তব্ধ, হৃদয়ের ভেতর যেন একটু বেশি শূন্যতা। কারণ এবার প্রথমবারের মতো আমার আব্বাকে ছাড়াই কাটছে দিনটি। আব্বা চলে গেছেন গত জানুয়ারিতে। ফলে বাবা দিবস এখন আর কেবল উদযাপনের দিন নয়– এটি হয়ে উঠেছে স্মরণ, অনুধাবন ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উপলক্ষ। আব্বা না থেকেও আছেন, তবে এক ভিন্ন অনুভবে– আমার নীরব নিঃশব্দ অভিভাবক হয়ে।
আমাদের সমাজে কিংবা বলা যায় পারিবারিক সংস্কৃতির বাবারা সবসময় প্রকাশের ভাষায় ভালোবাসা বোঝান না। তাদের স্নেহ, দায়িত্ববোধ ও নিবেদন অনেক সময়েই নীরব থাকে, তবে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আমার আব্বাও ছিলেন তেমনই একজন। আব্বা ছিলেন আমার দিকনির্দেশক, আমার রক্ষাকবচ, আমার জীবনপথের চুপচাপ ভরসা।
আব্বার অ্যাজমা ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতেন, আমাদের প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমি কিংবা আমার মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর যখন ৭৯ বছর বয়স, তখনও আমি ডাক্তারের কাছে একা যেতে গেলে বলতেন, ‘তুমি একা যাবে কেন? আমি যাচ্ছি।’ এই কথা বলার মানুষটাকে প্রতি পদে পদে আমার মনে পড়ে, যেন দূর থেকে দেখছেন সবই। আর আমিও তাঁর কনুই-আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছি জীবনের পথে।
আব্বা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ধার্মিক মানুষ। শৈশব থেকে নামাজের গুরুত্ব তিনি আমার মধ্যে গভীরভাবে বপন করার চেষ্টা করে গেছেন। কখনও নরম সুরে, আবার কখনও খুব জোর গলায়। তখন মনে হতো তিনি চাপ দিচ্ছেন; কিন্তু এখন তাঁর অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতায় আমি সেই কণ্ঠস্বরের জন্য আকুল হই।
অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে কিংবা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বাসায় গেলে বাবার ফোন আসত, ‘কোথায়? কখন ফিরবি?’ সেসব ফোন একসময় মনে হতো আব্বার বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, একটাবার হলেও যদি ফোনে তাঁর নামটা দেখতাম! ছোট ছোট এসব প্রশ্ন– এই উদ্বেগই তো ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। এগুলোই ছিল বাবার নিজের মতো করে যত্ন নেওয়ার ভাষা। সেই ভাষাটাই আজ আর শোনা যায় না। আব্বা নেই, এখন জীবনযাপনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।
আব্বা ছিলেন একজন ব্যাংকার। হয়তো চেয়েছিলেন আমি তাঁর পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। কিন্তু কোনোদিন চাপ দেননি। বরং নিজের ইচ্ছেমতো পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আব্বাই আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি, নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়েছি– তবুও বাবার সেই গাইডেন্স কখনও ফুরায়নি। আব্বা কখনও অর্থ বা অন্য কোনো সহায়তার কথা বলেননি; বরং সবসময় নিজে থেকেই পাশে থেকেছেন। মনে পড়ে, একবার মেয়ের অসুস্থতার সময় আমি অর্থকষ্টে ছিলাম, কিছু বলিনি তাঁকে। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পাশে থেকেছেন।
এখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে হয়, ‘বাবা হলে কী করতেন?’ তাঁর শিক্ষা, অভ্যাস, স্নেহ– সবকিছু এখন আমার আচরণে, আমার সিদ্ধান্তে, আমার ভালোবাসায় প্রতিফলিত হয়। তাঁকে ছুঁতে না পারলেও আমি প্রতিদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি– স্মৃতিতে, নৈঃশব্দ্যে, নানা রকম ছোট ছোট মুহূর্তে।
এই বাবা দিবসে আব্বার কোনো ফোন আসবে না, থাকবে না কোনো উপহার বা আলিঙ্গনের মুহূর্ত; যা আছে সেটি হলো আব্বার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানদের শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি কখনোই। তাঁর জীবনদর্শন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি– এগুলোই নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো পুরোপুরি পারছি না; কিন্তু আমার মনে হয় এ চেষ্টাটাই আমার জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে।
বাবাকে হারানোর শোক যেমন গভীর, তেমনি গভীর তাঁর রেখে যাওয়া ভালোবাসা। নিজের অনুভবকে চাপা না দিয়ে, বরং বাবাকে নিজের ভেতরে জায়গা দিন। বাবার কথা বলুন, তাঁর শেখানো পথে হাঁটুন। কারণ প্রিয় মানুষরা চলে যান বটে, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা থেকে যায় সবসময়।
লেখক: কমিউনিকেশনস প্রফেশনাল