এবারের বাজেটে যেভাবে জনতার স্বর শোনা যাবে
Published: 2nd, May 2025 GMT
কর ফাঁকি দিতে চান অনেকেই। কিন্তু করদাতাদের অর্থ দেশের কাজে ‘সহিহ কায়দায় নিজের এখতিয়ারে’ নিতেও জানেন না অনেক ভদ্রলোক। যেমনটা জানতেন না পতিত সরকারের অধিকাংশ সংসদ সদস্যরা। কারণ, ‘সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল’—এর ইতিহাস এ দেশে বেশ সমৃদ্ধ।
তাহলে দিনদুপুরে রাষ্ট্রীয় তহবিলের আশপাশে থাকা ‘ভূতের’ মেরে দেওয়া থেকে জনগণের টাকা রক্ষা ও দেশবাসীর সর্বোত্তম কল্যাণে ব্যবহারের উপায় কী?
আইন প্রণয়নের পর বাজেট তৈরি যাঁদের প্রধান দায়িত্ব, সেই এমপি সাহেবদের বাদ দিয়ে এ কাজ হওয়ার নয়। কেননা এই কর্তৃত্ব তাঁদেরই; যদি তাঁরা সত্যিই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন।
অথচ রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাব–নিকাশের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিতে বরাবরই ততটা আগ্রহী দেখা যায়নি তাঁদের, যেন নিজেদের জীবনেও তাঁদের কখনো সংসার চালাতে হয়নি।
আমরা আদিম যুগে নেই বলে আয়–ব্যয় ছাড়া আধুনিক বিশ্বের যেকোনো পরিবার অচল। তবু এই পরিবারের চেয়ে আরেকটু বড় পরিসরে ভাবতে গেলেই আমাদের কী যে সংগ্রাম, ন্যায়নিষ্ঠভাবে কাজ করতে কত যে জটিলতা!
১৮ কোটি মানুষের মধ্যে অনেকের পকেট থেকে আসা অর্থ এবং তাঁদের নামে ও পক্ষে ব্যয় করার প্রক্রিয়াও একটি বড় সংসার পরিচালনার মতো কাজ, যাকে কেতাবি ভাষায় বলে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
পরিবারে রোজগার ও ব্যয়ের কর্তৃত্ব সাধারণত একই অভিভাবকের হাতে থাকে। কিন্তু সরকারের অর্থ সংগ্রহকারী ও ব্যয়কারীরা এর মালিক নন, তাঁরা খাদেম। জাতীয় রাজস্বের জিম্মাদার প্রতিষ্ঠান অর্থ মন্ত্রণালয়কে সমাজের সাংঘর্ষিক গোষ্ঠী, শ্রেণির স্বার্থকে মেলাতে হয় অঙ্ক (বরাদ্দ) ও সাহিত্য (সুন্দর বক্তব্য) দিয়ে।
রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনে মানুষের কাছ থেকে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), শুল্ক ও অন্যান্য রাজস্ব হিসেবে অর্থ সংগ্রহ করেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা এবং এই কর আরোপ ও ব্যয়ের খতিয়ান নির্ধারণ এবং অনুমোদন দেওয়ার দায়িত্ব সংসদ সদস্যদের। রাষ্ট্রপতি সংসদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই মঞ্জুরি দাবি পেশ করে থাকেন।
পরিসংখ্যানভিত্তিক উন্নতির আরেক মানদণ্ড, মোট দেশজ আয় বা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে খুব বেশি লাভ হয় না, যদি না প্রবৃদ্ধির সুফল গণমানুষের কাছে পৌঁছায়। তাই পরিবর্তিত বাংলাদেশে সম্পদ বণ্টনের যে নতুন আয়োজন প্রয়োজন হবে, তার ইঙ্গিত থাকা উচিত ২০২৫-২৬-এর বাজেটেই।কিন্তু ধারাবাহিকভাবে আমাদের বাজেট হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি আমলাতান্ত্রিক কর্মযজ্ঞ, যা আসলে একটি রাজনৈতিক দলিল, নির্বাচনের আগে দেওয়া ইশতেহারের প্রতিফলন হওয়ার কথা ছিল। সেই প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কর্মচারীদের কর্তব্য দক্ষতার সঙ্গে করণিক সমর্থন জোগানো।
আগে প্রত্যেক সংসদ সদস্যের নিজের এলাকার উন্নয়ন ভাবনা থেকে কিছু কর্মসূচি ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও কৌশলগত, আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়ে জ্ঞান এবং ক্ষেত্রভেদে সরকারি ব্যবস্থায় সমর্থনের অভাবে তাঁদের ভূমিকা তুচ্ছই রয়ে যেত।
তাই জুন মাস–কেন্দ্রিক বাজেটের মৌসুম এলে নতুন বাজেটে কী অন্তর্ভুক্ত হবে এবং বিদায়ী অর্থ বছরের কর সংগ্রহ এবং বরাদ্দকৃত টাকাপয়সা ছাড় ও ব্যয় কত দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে, তা নিয়ে প্রশাসনিক তোড়জোড় শুরু হতো।
কীভাবে কত টাকার আয়–ব্যয়ের হিসাব মহান সংসদে উপস্থাপন করা হবে, এর সপক্ষে কীভাবে আলোচনা হবে এবং ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে’ বলে কীভাবে তা পাস করা হবে, তা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের খবরদারির মধ্যেই পড়ে থাকত।
প্রাক্-বাজেট পরামর্শ সভা বা সংসদে উপস্থাপিত আর্থিক বিবৃতির প্রস্তাব নিয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আলোচনার অন্যতম দিক ছিল শ্রেণিস্বার্থে করারোপ বা প্রকল্প গ্রহণের জন্য দর-কষাকষি।
জন-আকাঙ্ক্ষাকে বাজেট প্রস্তাবে রূপান্তর, নানা গোষ্ঠী ও সেক্টরের প্রতিনিধিদের মধ্যে তর্কবিতর্ক এবং সংসদ সদস্যদের মধ্যে পুরোনো সংবিধানের ধারা ৭০-এর দলীয় নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে স্বাধীন, উন্মুক্ত আলোচনার কোনো আয়োজনও করা হয়নি। তাই বলে ভবিষ্যতে করা যাবে না, এমন তো নয়।
অন্তত এবারের পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। সংসদবিহীন সময়ে কিন্তু একটি সহনশীল, মুক্ত পরিবেশে বাজেট প্রণয়নের দায়িত্ব পড়েছে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসনের ওপর। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, নৈশকালীন ভোটে বা ডামি নির্বাচনে জয়ী সংসদ সদস্যদের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই এ জামানায়।
বাংলাদেশে দুই দফা প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনামলে (১৯৭৫-৭৯ ও ১৯৮২-৮৬) সাতটি; ১৯৯৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি, ২০০৭-২০০৮ সালে ‘ওয়ান ইলেভেন’ প্রশাসনের দুটি এবং এবারের বাজেটটি বাদে বাকি ৪২টি বাজেটই হয়েছে সংসদ কার্যকর থাকার সময়ে।
তাতেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাজেট প্রণয়ন, বৈধতা প্রদান ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করেনি।
বরং ফ্যাসিবাদী হাসিনা আমলে তাঁর আজ্ঞাবহ সংসদ যা খুশি তা-ই অর্থ বরাদ্দ ও আর্থিক নীতির পক্ষে আইন পাস করে। এতে বিচার বিভাগ সহযোগী ভূমিকা নেয় এবং নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কৈফিয়তের সংস্কৃতিকে জাদুঘরে পাঠিয়ে চুরিতন্ত্রকে স্বাভাবিক কার্যপ্রণালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
যাহোক, গণমুখী ও ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযোগী একটি দিকনির্দেশনামূলক বাজেট তৈরির ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সামনে।
অন্য তিনটি (১৯৯৬-৯৭, ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯) ব্যতিক্রমী বাজেটের চেয়ে এটি আরও আলাদা এ অর্থে যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের রয়েছে পরিবর্তন আনার বিপ্লবী ম্যান্ডেট।
সুতরাং একটি নতুন ধারার সূত্রপাত করতে পারে এই অন্তর্বর্তী বাজেট। এই উত্তরণে একটি সংসারের ধারণার বিস্তার ঘটতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রে এবং শক্তিশালী কিন্তু দরদি রাষ্ট্র কার্যকর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দাঁড়াতে পারে সহস্র পরিবারের পাশে।
নমুনা হিসেবে বলা যায়, স্বাস্থ্যঝুঁকি, দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের মতো যেসব কারণে মানুষ ঋণগ্রস্ত বা সম্পদহীন হয়ে পড়ে, সেগুলো মোকাবিলায় সুদমুক্ত ঋণ ও বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে সুরক্ষাবলয় তৈরি হলে নতুন দারিদ্র্য রোধ এবং সমাজে প্রতিশ্রুতিশীল মানুষদের সর্বস্বান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।
নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন কর্মসূচি ও প্রকল্পে (যেমন ট্যালেন্ট হান্ট, উদ্যোক্তা তৈরি এবং ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা) প্রসারে প্রণোদনা দেওয়া হলে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবের শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতিও যথাযথ সম্মান দেখানো হবে।
ছাত্র এবং সদ্য পাস করা তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণে দেশে বিশেষ অর্থনৈতিক ও কর সমীক্ষার মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ, সম্ভাবনা ও যৌক্তিক পরিমাণ রাজস্ব পাওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা থাকতে পারে আগামী বাজেটে।
এতে কম বয়সেই নাগরিকেরা কর প্রদান ও এর সর্বোত্তম ব্যবহার এবং উন্নয়ন ও নিজেদের দায়িত্বের বিষয়ে সচেতন হওয়ার সুযোগ পাবেন এবং নিজেদের পরার্থপরতায় নিয়োজিত করার তাগিদ অনুভব করবেন।
দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনে ছিন্নভিন্ন হওয়া সামাজিক আবরু বা ‘সোশ্যাল ফেব্রিক’ জোড়া দিতে হলে সমাজের সব শ্রেণি–পেশার মানুষের শান্তিতে বাঁচা ও জীবনযাপনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে রাষ্ট্রকে।
সেই উদ্দেশ্যে উচ্চশিক্ষিত নাগরিক, সামাজিক রোল মডেল বা প্রবাসী গুণীজনদের শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে।
জাতীয় কল্যাণে বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে মেধাবী তরুণদের দেশে বা বাইরে প্রণোদনা এবং অনেককে ঘরে ফেরাতে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
মানুষের মেধা-মনন, সম্ভাবনা ও ব্যক্তির অধিকার উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার আওয়ামী শাসনে জোর দেওয়া হয় ইট, কাঠ, বালু, সিমেন্ট এবং সংখ্যাতাত্ত্বিক কাগুজে উন্নয়নে, যার চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি জাতীয় সম্পদ লুটপাটে, আকাশছোঁয়া বৈষম্যে, অবশেষে গণরোষে তাঁর পতন ও পলায়নে।
পরিসংখ্যানভিত্তিক উন্নতির আরেক মানদণ্ড, মোট দেশজ আয় বা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে খুব বেশি লাভ হয় না, যদি না প্রবৃদ্ধির সুফল গণমানুষের কাছে পৌঁছায়। তাই পরিবর্তিত বাংলাদেশে সম্পদ বণ্টনের যে নতুন আয়োজন প্রয়োজন হবে, তার ইঙ্গিত থাকা উচিত ২০২৫-২৬-এর বাজেটেই।
একই সঙ্গে করদাতাদের অর্থ যাতে দুর্নীতির কারণে বেহাত না হয় এবং বাজেট বরাদ্দের অর্থকে পুঁজি করে কেউ যেন কমিশন বা ঘুষবাণিজ্য না করতে পারে, সে রকম পদক্ষেপ এ বাজেটে থাকা জরুরি।
আমরা হয়তো বিশ্বাস করছি না, দীর্ঘমেয়াদি, ন্যায়ভিত্তিক করনীতি, স্থিতিশীল অর্থনীতি, কল্যাণ রাষ্ট্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক সহযোগিতার সমাজ প্রতিষ্ঠা করেই কেবল মুদ্রাস্ফীতি বা কোনো অর্থনৈতিক আঘাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব। অধ্যাপক ইউনূসের বাজেট দর্শনে এর প্রতিফলন কাম্য।
খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রব দ ধ সরক র র প রণয়ন পর ব র আর থ ক বর দ দ ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
‘নো ওয়েজ বোর্ড, নো মিডিয়া’সহ ৩৯ দাবি সংবাদকর্মীদের
‘নো ওয়েজ বোর্ড, নো মিডিয়া’ নীতি কার্যকর করাসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের সুরক্ষায় ৩৯ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।
শনিবার (১ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের আয়োজনে বিক্ষোভ সমাবেশে এসব দাবি তুলে ধরা হয়।
আরো পড়ুন:
‘সাম্য, মর্যাদা ও আলোকিত সমাজের স্বপ্নে ৭১ ও ২৪ এর তরুণরা’
শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিলে কেউ যেন খুনের কনটেক্সট না ভুলে যান: প্রেস সচিব
বিএফইউজের দাবিগুলো হলো:
০১. ‘নো ওয়েজ বোর্ড নো মিডিয়া’ নীতি কার্যকর করতে হবে।
০২. অবিলম্বে স্বাধীন ও কার্যকর তথ্য কমিশন গঠন করতে হবে।
০৩. প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, রেডিও, সংবাদ সংস্থা, অনলাইন ও মাল্টিমিডিয়ার জন্য নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন ও দশম ওয়েজ বোর্ড গঠন করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকদের জন্য নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও কার্যত তা হচ্ছে না। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমে নবম ওয়েজ বোর্ড কার্যকর হয়নি। অথচ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। তাই, বর্তমান সরকারকে দ্রুত নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন এবং দশম ওয়েজ বোর্ড গঠনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
০৪. সাংবাদিক সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। একইভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেও যেকোনো মূল্যে সুরক্ষা দিতে হবে। আইনি কাঠামো দ্বারা সুরক্ষা না দিলে সাংবাদিক সমাজ প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা নিগৃহীত হতে থাকবে এবং বর্তমান সময়ে প্রতিনিয়ত তা-ই হচ্ছে।
০৫. সাংবাদিকদের সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন নির্ধারণ করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সপ্তাহে দুই দিন ছুটি ভোগ করে, অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও দুই দিন ছুটির ব্যবস্থা চালু আছে। সাংবাদিকদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন সাপ্তাহিক ছুটিও পান না। এতে তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ বাড়ছে।
০৬. সাংবাদিক হত্যা, হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিক হত্যার দ্রুত বিচার সম্পন্ন করতে হবে।
০৭. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী সব কালাকানুন বাতিল করতে হবে।
০৮. আইন অনুযায়ী সাংবাদিকদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য পৃথক শ্রম আদালত স্থাপন করতে হবে। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সাংবাদিকরা নানাভাবে হয়রানি ও হামলা-মামলার শিকার হন। এসব মামলা ঘাড়ে নিয়ে কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে হয়। থানা বা কোর্ট নয়, সংবাদসংক্রান্ত সব মামলা শ্রম আদালতে করতে হবে।
০৯. সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, রেডিও, টেলিভিশন, অনলাইন, মাল্টিমিডিয়ার জন্য একটি ‘সমন্বিত জাতীয় সংবাদমাধ্যম নীতিমালা’ প্রণয়ন করতে হবে। এই সমন্বিত নীতিমালার আওতায় প্রতিটি ভিন্ন গণমাধ্যমের জন্য ভিন্ন নীতিমালা থাকবে। অনেক নীতিমালা প্রণয়ন না করে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে সেটি প্রয়োগ করা ও মেনে চলা সহজ হবে।
১০. সংবাদপত্র, অনলাইন, টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদ সংস্থা ও মাল্টিমিডিয়ার জন্য অভিন্ন ওয়েজ বোর্ড করতে হবে। বর্তমানে প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য ওয়েজ বোর্ড থাকলেও টেলিভিশন ও অনলাইনের জন্য কোনো ওয়েজ বোর্ড নেই। তাই, টেলিভিশন সাংবাদিকদের চাকরি শেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। এটা অত্যন্ত অমানবিক।
১১. রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সব স্তরে এবং আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণে সাংবাদিক সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। যত দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সাংবাদিক সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হবে, তত দিন পর্যন্ত স্বাধীন সাংবাদিকতাও সম্ভব হবে না। বর্তমানে ব্যাপক হারে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব সম্পাদনে রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা নিগৃহীত হতে হচ্ছে কারণে-অকারণে। মামলা-গ্রেপ্তারেও পিষ্ট হচ্ছে।
১২. কথায় কথায় সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতি বন্ধ এবং ইতোমধ্যে চাকরিচ্যুত সাংবাদিকদের পুনর্বহাল করতে হবে।
১৩. চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়া অথবা অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের দেনা-পাওনা ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
১৪. কোনো গণমাধ্যম নিয়োগপত্র, ছবিসহ পরিচয়পত্র ছাড়া এবং বিনা বেতনে কোনো সাংবাদিককে অস্থায়ী, স্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারবে না।
১৫. মফস্বলের সাংবাদিকদের সম্মানজনক বেতন দিতে হবে। জেলা পর্যায়ে কিছু পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল বেতন দিলেও অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ উপজেলা প্রতিনিধিদের এক টাকাও বেতন দেয় না। উপন্তু, তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য চাপ দেওয়া হয়। সংবাদকে উপেক্ষা করে বিজ্ঞাপনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিতে না পারলে চাকরিচ্যুত করা হয়। এগুলো বন্ধ করতে হবে।
১৬. তিন বছর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার পর ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে পদোন্নতি দিতে হবে।
১৭. সরকার ও গণমাধ্যম কর্তৃক দ্রুত সাংবাদিক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
১৮. বছরের শুরুতে আগের বছরের গড় মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাংবাদিকদের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যান্য ভাতার ক্ষেত্রে অন্তত দুই বছর পর পর মুদ্রাস্ফীতি সামঞ্জস্য করে বিবেচনা করতে হবে।
১৯. পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্টে ক্যামেরা, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল, গাড়ি, মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। শারীরিক ক্ষতির জন্য দুর্ঘটনা বীমা থাকতে হবে। চিকিৎসার ব্যবস্থা মালিকপক্ষকেই নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট কাভারের জন্য প্রতিষ্ঠানকে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। সংবাদকর্মীদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা সরঞ্জাম এবং দুর্ঘটনা ভাতার ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্থায়ী সংবাদকর্মীদের জন্য দুর্ঘটনা বীমা ও চিকিৎসা বীমার ব্যবস্থা, জীবন বীমা, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির ব্যবস্থা করতে হবে। সংবাদকর্মীদের আইনি সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠানে আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হবে। নারী সংবাদকর্মীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, বিশেষ করে তাদের জন্য আলাদা রেস্ট রুম রাখতে হবে।
২০. সাংবাদিকদের তৈরি প্রতিবেদনের কারণে যেসব ফৌজদারি মামলা আছে, তা প্রত্যাহার ও বাতিল করতে হবে।
২১. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে।
২২. কোনো গণমাধ্যমকে গোয়েন্দা সংস্থা কোনো ধরনের নির্দেশনা দিতে পারবে না।
২৩. প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা কোনো সংবাদমাধ্যম/গণমাধ্যম পরিচালিত হতে পারবে না।
২৪. সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের রিপোর্ট প্রতি তিন মাস অন্তর সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে জমা দিতে হবে। এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, মনিটরিং করতে হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতন পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সত্যিকার অর্থে ওয়েজ বোর্ড কার্যকর করেছে কি না, সেটা সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
২৫. সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক হতে হবে। সাংবাদিকদের শুরুতে বেতন ন্যূনতম ৩৫ হাজার টাকা হতে হবে এবং প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট দিতে হবে।
২৬. রেডিও, টেলিভিশনের লাইসেন্স প্রদানে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিটিআরসিকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে। দলীয় বিবেচনায় নয়, যোগ্যতায় হতে হবে লাইসেন্সপ্রাপ্তির মূল ভিত্তি।
২৭. কোনো সাংবাদিক যত দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার মতো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন, তার বিরুদ্ধে যদি আর্থিক দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো প্রমাণিত অভিযোগ না থাকে, তা হলে তাকে অবসর দেওয়া যাবে না।
২৮. সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন পরশোধ করতে হবে।
২৯. দেশে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন প্রক্রিয়া এখনো সেকেলে রয়েছে গেছে। কেউ যদি যথাযথভাবে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য হয়, সেক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে। আবেদন প্রক্রিয়াও অনলাইনভিত্তিক করতে হবে। নিবন্ধন পেতে হয়রানি, ঘুষ দাবিসহ সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে সংবাদমাধ্যমের অবমূল্যায়ন ও হয়রানি বন্ধ করে যেকোনো এক জায়গায় সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন-সংক্রান্ত বিশেষ সেল রাখা যেতে পারে। ভেরিফিকেশন থেকে শুরু করে নিবন্ধনসহ সব কিছু বিশেষ সেলের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা করবেন।
৩০. চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর বর্তমানে প্রিন্ট পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ও বিজ্ঞাপন হার নির্ধারণ করে থাকে। এখানে অনেক শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যেসব পত্রিকা দৈনিক ৫০০ কপিও ছাপা হয় না, সেসব পত্রিকা লাখ লাখ কপি ছাপানোর ভুয়া তথ্য দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে বেশি বিজ্ঞাপন রেট নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে রেট আপ-ডাউন বন্ধ করতে হবে।
৩১. সংবাদমাধ্যমের বিজ্ঞাপন রেট বাড়াতে হবে। ৯০০ টাকা রেট দিয়ে এখনকার সংবাদমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। এখনকার মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় রেট আরো অন্তত ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে। একই কথা রেডিও, টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমের জন্যও প্রযোজ্য। সব মিডিয়ার জন্যও বাস্তবসম্মত বিজ্ঞাপন নীতিমালা করতে হবে;
৩২. রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে। ঠিক তেমনই করপোরেট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিমালিকানাধীন টিভি-রেডিও ও সংবাদপত্রকে মালিকের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত করার একটা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৩৩. কথায় কথায় সংবাদমাধ্যম ডিক্লারেশন বাতিল বন্ধ করতে হবে। সরকার কোনো সংবাদমাধ্যম বন্ধ করলে সরকারকে অন্তত ৬ মাস ওই মিডিয়ার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বহন করতে হবে।
৩৪. নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক/গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিকের নির্বাচনী তথ্য জানার অধিকারকে সংকুচিত করবে। বিশেষ করে, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংবাদ সংগ্রহে গণমাধ্যমকর্মীদের অবাধ চলাচল, পর্যবেক্ষণ ও তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। আমরা অবিলম্বে এই নীতিমালা সংশোধনের দাবি জানাচ্ছি।
৩৫. নিউজ প্রিন্টের আমদানি শুল্ক ২ শতাংশ (বর্তমানে প্রযোজ্য ৫ শতাংশ), ভ্যাট ১৫ শতাংশের স্থলে ৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ৫ শতাংশ ও অগ্রিম কর (এটি) ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ন্যূনতম ১ শতাংশ করতে হবে। সংবাদপত্র শিল্পকে সেবামূলক শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে করপোরেট ট্যাক্স সর্বনিম্ন নির্ধারণ অথবা অবলোপন করতে হবে।
৩৬. সামগ্রিক মিডিয়াকে শিল্প ঘোষণা করে এই শিল্পের বিকাশে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিগত দিনে আমরা দেখেছি, সরকারের পছন্দমতো সংবাদ না করলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হুমকি দিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়েছে। সংবাদের কারণে কোনো গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন বন্ধ করাকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৩৭. সাংবাদিকতাকে বাধাহীন করতে হবে। সাংবাদিকদের জন্য ভয়হীন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩৮. রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচনী ইশতেহারে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।
দাবিগুলো উপস্থাপন করে সাংবাদিক নেতা কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, “আমরা এমন একটি পরিবর্তিত সংবাদমাধ্যম চাই, যেখানে একজন সাংবাদিক কোনো পক্ষের চাপ ছাড়াই ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্য তুলে ধরতে পারবেন। যেখানে অনুসন্ধানই হবে সত্যের সমাহার আর দায়িত্ববোধ হবে সাংবাদিকতার মূলশক্তি।”
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ, বিএফইউজের সিনিয়র সহ-সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, সহ-সভাপতি খায়রুল বাশার, এ কে এম মহসিন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি মুরসালিন নোমানী, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, বাছির জামাল, এরফানুল হক নাহিদ, রফিক মুহাম্মদ, রাশেদুল হক, দিদারুল আলম, সাঈদ খান, আবু বকর, অপর্ণা রায়, মোদাব্বের হোসেন, খন্দকার আলমগীর, ডিএম অমর, আল আমিন প্রমুখ।
ঢাকা/রায়হান/রফিক