সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান গাজা
Published: 2nd, May 2025 GMT
২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’ প্রকাশ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)। সদ্য প্রকাশিত এই রিপোর্টে উঠে এসেছে বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাওয়ার চিত্র। সংগঠনটি জানিয়েছে, সাংবাদিকদের জন্য বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা।
শুক্রবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম ১৮ মাসেই ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে প্রায় ২০০ সাংবাদিক নিহত হন। এর মধ্যে অন্তত ৪২ জন পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সরাসরি আক্রমণের শিকার হন। গাজায় সাংবাদিকরা বেশির ভাগই আশ্রয়হীন, এমনকি জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানিরও অভাব রয়েছে উপত্যকাটিতে।
পশ্চিম তীরেও গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। সেখানে সাংবাদিকরা নিয়মিতভাবে ইসরায়েলি বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে অতর্কিত হামলার পর সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়ন এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসরায়েলিদের এসব অপরাধের কোনো বিচার হয় না।
বিপদ শুধু বাইরের দিক থেকে নয়। ইসরায়েলের সঙ্গে যোগসাজশের সন্দেহে হামাস ও ইসলামিক জিহাদও সাংবাদিকদের কাজে বাধা দিচ্ছে। আর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের গৃহীত নতুন ‘সাইবার অপরাধ আইন’ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সীমিত করছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স।
সব মিলিয়ে সর্বশেষ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ফিলিস্তিনের অবস্থান ২০২৪ সালের তুলনায় ছয় ধাপ পিছিয়ে গিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৩তম স্থানে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে ১১২টি দেশের অবস্থান আরও খারাপ হয়েছে এবং গড় স্কোর সর্বনিম্ন ৫৫ পয়েন্টে নেমে গেছে।
চলতি বছর গাজায় প্রাণ হারানো আলোচিত সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন ফিলিস্তিনি ফটোসাংবাদিক ফাতিমা হাসসুনা। তাঁর ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র কান চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত হওয়ার খবর জানার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন তিনি। এ ছাড়া সম্প্রতি গুলিবিদ্ধ হয়ে কোমায় চলে গেছেন আলজাজিরার এক সাংবাদিক।
গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) জানিয়েছে, গাজায় নিহত সাংবাদিকদের সংখ্যা আধুনিক ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিক নিহতের সবচেয়ে বড় রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জাতিসংঘ ‘বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা দিবস’-এ দেওয়া বার্তায় জানিয়েছে, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজা সাংবাদিকদের জন্য ‘মৃত্যুকূপ’ হয়ে উঠেছে। তারা বলেছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, সংবাদ কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জাতিসংঘ এবং সাংবাদিক অধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাংবাদিক হত্যার আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে পিছিয়েছে ইসরায়েলও। ১১ ধাপ পিছিয়ে নতুন প্রকাশিত তালিকার ১১২তম অবস্থানে নেমেছে তারা। রিপোর্টে বলা হয়, গাজা যুদ্ধ শুরুর পর দেশটিতে সংবাদমাধ্যমের বহুমত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সম্পাদকীয় নিরপেক্ষতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ২০২১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু শুধু তাঁকে সমর্থন করে যাওয়া চ্যানেল ফোরটিনকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন এবং ইসরায়েলি মূলধারার অন্যান্য সংবাদমাধ্যমকে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বলে দোষারোপ করছেন।
২০২৪ সালে দেশটির তথ্যমন্ত্রী খোলাখুলিভাবে সমালোচনামূলক দৈনিক পত্রিকা হারেৎজ বর্জনের আহ্বান জানান, কারণ পত্রিকাটি তখন গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বেসামরিক নাগরিক হত্যার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তথ্যসূত্র : আলজাজিরা।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস
স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’
সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
অনাহারে মৃত্যু ১৫৪গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।
গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।
ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।
বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।
গাজায় স্টিভ উইটকফশুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।