টানা চার বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ডিমের দাম ভোক্তার কাছে সহনীয় ছিল। কিন্তু প্রান্তিক খামারিদের এই সময়ে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ডিম বিক্রি করতে হয়েছে। এ বছর ঈদুল ফিতরের পর এক মাস পার হলেও ডিমের দাম খুব একটা বাড়েনি। ফলে লোকসানের সময় লম্বা হচ্ছে ছোট ও মাঝারি খামারিদের। একই অবস্থা মুরগির মাংসের ক্ষেত্রেও। 

সরকার বলছে, মুরগির খাবারের দাম বেশি হওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর খামারিরা বলছেন, ডিম সংরক্ষণের সুযোগ থাকলে তাদের লোকসান গুনতে হতো না।
সাইফুল ইসলাম ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালীতে তাঁর খামারে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হয় ১০ হাজার। ডিমপ্রতি উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ১৯ পয়সা। সরকার ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা নির্ধারণ করলেও সাইফুল গেল শীত ও রোজায় বিক্রি করেন সর্বোচ্চ সাড়ে সাত টাকা দরে। খামার পর্যায়ে দাম এখন একই রকম। হিমাগারে ডিম রাখায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় ক্ষুদ্র খামারিদের বিপদ আরও বেড়েছে।

ক্ষুব্ধ সাইফুল বললেন, ‘দাম বাড়লে খামারিরা হয়ে যান দাগি আসামি! দিনের পর দিন গচ্চা দিচ্ছি, এখন কেউ দেখছে না।’ বেশি দামে মুরগির বাচ্চা ও খাবার কিনে সাইফুলের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খামার  চালাতে লোকসান গুনছেন। ভোক্তার পাতে সস্তায় ডিম-মুরগি পৌঁছে দিয়ে এখন নিজেরাই পড়েছেন সংকটে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রান্তিক খামারিরা ন্যায্যমূল্য না পেলে ডিমের উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। লাখো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বেকার হবে। তাদের সুরক্ষায় সরকারকে এখনই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।

ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, রমজানের ২১ দিনে খামারিদের ১৫৯ থেকে ২০৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। বছরে তিন থেকে চারবার ডিম-মুরগির দর পতন হচ্ছে। এতে অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছেন।

মসিউর রহমান বলেন, খামারিদের সুরক্ষায় স্বল্প সুদে ঋণ নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারিভাবে ডিম-মুরগির সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ, কোল্ডস্টোরেজে ডিম সংরক্ষণের বাধা দূর করা দরকার। দর পতনের সময় প্রান্তিক খামারিদের ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে।

দাম বাড়লে হইচই, কমলে নীরব
রোজা শুরু হয়েছিল ২ মার্চ। তার আগের প্রায় এক মাস ডিমের হালি ছিল ৪৫-৫০ টাকা। ১৬ মার্চ ১৫ রোজায় তা নেমে আসে ৩৮-৪৫ টাকায়। ২০২৪ সালে রোজা শুরু হয়েছিল ১২ মার্চ। টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেবার রোজা শুরুর এক মাস আগে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি হালি ডিমের দাম ছিল ৪৪-৪৭ টাকা। ১৫ রোজা পার হতে না হতে দাম কমে হয় ৪০-৪৩ টাকা। রোজা শেষে আগের দামে ফেরে ডিম। একই প্রবণতা ২০২২ সাল থেকে চলে আসছে।

এবারের চিত্র ভিন্ন। ঈদুল ফিতরের এক মাস পরও খুচরা বাজারে ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা হালি। এতে ভোক্তা পর্যায়ে স্বস্তি থাকলেও বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। তাদের ভাষ্য, উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রতি পিস ডিমে আড়াই থেকে তিন টাকা লোকসান দিচ্ছেন।

গত বছর উৎপাদন খরচ বিবেচনায় খামারি পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা নির্ধারণ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। পরে মূল্য সমন্বয়ের কথা থাকলেও তা হয়নি। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) মহাসচিব খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে দিনে গড়ে ডিমের চাহিদা পাঁচ কোটি। রোজায় তা এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। ভারতে ৮ থেকে ১৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এক বছর পর্যন্ত ডিম সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশেও এমন হিমাগার তৈরির প্রস্তাব দিয়েছি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। এটি বাস্তবায়ন হলে সারাবছর একই দামে ভোক্তাকে ডিম খাওয়ানো যাবে; খামারিরাও লাভবান হবেন।’

খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘বর্তমানে প্রান্তিক খামারিরা প্রতি কেজি ব্রয়লার বিক্রি করছেন ১৫০-১৬০ টাকায়। অথচ তাদের উৎপাদন খরচ ১৭০-১৮০ টাকা। লোকসান দিয়ে কতদিন টিকবেন খামারিরা, সেটিই বড় প্রশ্ন।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য, দেশে ছোট-বড় পোলট্রি খামার প্রায় এক লাখ। এর ১০ শতাংশ বড় খামারি। সরাসরি ২৫ লাখসহ পরোক্ষভাবে এ শিল্পে শ্রম দিচ্ছেন ৬০ লাখের বেশি মানুষ। দৈনিক চার থেকে সাড়ে চার কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়। বছরে ১১ লাখ টন মাংস উৎপাদন হচ্ছে। শুধু ডিম-মাংস উৎপাদন নয়; বাচ্চা, খাদ্য, ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি মিলে এ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ।

উপকরণের দাম দ্বিগুণ
দুই বছর ব্যবধানে খাদ্য, ওষুধ, বাচ্চা, পোলট্রি উপকরণসহ আনুষঙ্গিক সবকিছুর দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিপরীতে ডিম-মাংসের দাম কমে যাওয়ায় ভাঁজ পড়েছে খামারিদের কপালে। কুমিল্লার দাউদকান্দির হাসানপুর গ্রামের খামারি আমানুল হক জানান, ২০২২ সালে ১৫-২০ টাকার লেয়ার বাচ্চা এখন কিনছেন ৭০-৭৫। ২০-২৫ টাকার ব্রয়লার বাচ্চায় লাগছে ৬৫-৭০। দ্বিগুণ বেড়ে সোনালি জাতের বাচ্চা কিনছেন ৫০ টাকায়। ২৫ টাকা কেজির বেডিফিট হয়েছে ৩৫-৪০; ১৫ টাকা কেজির ভুট্টা ৩৫। সয়াবিন ৩০ থেকে ৬০ টাকা, মিটবোন মিল ৩৫ থেকে হয়েছে ৭০ টাকা।

ঝালকাঠির নলছিটির সুবিদপুর ইউনিয়নের খামারি সেলিম খান বলেন, ‘গেল শীত ও রোজায় এক হাজার মুরগিতে বিনিয়োগ করে ৩০ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছি। এখন ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

কক্সবাজারের চকরিয়ার ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের প্রান্তিক খামারি ছমির উদ্দিন জানান, একটি বয়লার মুরগি এক কেজি ওজন করতে খরচ ১৬৫-১৭০ টাকা। অথচ পাইকারিতে ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

অ্যানিমেল হেলথ কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আহকাব) সাধারণ সম্পাদক আফতাব আলম বলেন, ‘ডিমের দাম বেশি ছিল বলে সরকার আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। চাহিদা কমের সময় সরকারের উচিত রপ্তানি করে খামারিদের সুরক্ষা দেওয়া।’

করপোরেটে ভিন্ন চিত্র
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মুরগি উৎপাদনের ১০ শতাংশ আসে দেশের ১০ বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে। বাকি ৯০ শতাংশের জোগান দেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। ক্ষুদ্র খামারিরা লোকসান গুনলেও মুনাফা করছেন করপোরেট খামারিরা।

গাজীপুরের ক্ষুদ্র খামারি আবদুর রহমান বলেন, বড় বড় কোম্পানি ডিম-মুরগির পাশাপাশি বাচ্চা, খাদ্য, ওষুধসহ সব রকম পোলট্রি উপকরণ উৎপাদন করে। এতে তাদের ডিম ও মুরগি উৎপাদনে খরচ কম হয়। বিপরীতে ক্ষুদ্র খামারিরা করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকেই বাচ্চা, খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনে। আবার সংরক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ না থাকায় ছোট খামারিরা কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসানের দাবি, প্রান্তিক খামারিরা কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে আশাতীত উপকৃত হচ্ছেন। জীবিত মুরগির জন্য খামারিরা গ্রোয়িং চার্জ পাচ্ছেন। ব্রয়লার মুরগির দর পতন হলে খামারি নন, ক্ষতি বহন করছে কোম্পানি। এর পরও কোনো কারণে সন্তুষ্ট না হলে পরবর্তী ব্যাচ থেকে খামারিদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ রয়েছে।

ঢাকার কেরানীগঞ্জের ক্ষুদ্র খামারিরা জানান, বাচ্চা পালন থেকে শুরু করে বাজারে মুরগি বিক্রি করা পর্যন্ত নানাভাবে তারা শোষণের শিকার হচ্ছেন। নিজস্ব বিনিয়োগ কম থাকায় স্থানীয় ডিলারের কাছ থেকে বাচ্চা, খাবার ও ওষুধ বাকিতে কেনেন বাড়তি দামে। শর্ত অনুযায়ী ডিলারের কাছে বিক্রি করতে হয় মুরগি। শর্তের বেড়াজালে ডিলাররা ইচ্ছামতো দাম দেন ও পাওনা কেটে রাখেন।

তাদের ভাষ্য, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান অফিস খুলে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’-এর নামে ডিলারের মতো বাচ্চা, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করছে। বাচ্চাগুলো মুরগি হয়ে উঠলে কোম্পানিগুলো বাজারদরে কিনে নিচ্ছে। এতে লাভের বড় অংশ কোম্পানি ও ডিলারের পকেটে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র খামারিরা শুধু ‘গ্রোয়িং চার্জ’ বা বাচ্চা বড় করার মজুরি পাচ্ছেন।

প্রান্তিক খামারিদের রক্ষায় করণীয়
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের সুফল হলো উৎপাদন খরচ কমছে। কিন্তু খামারিদের এ মুরগি বাজারজাতের স্বাধীনতা নেই। প্রান্তিক খামারিদের রক্ষায় খাদ্য ও বাচ্চার দাম প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে সার্বক্ষণিক মনিটর করতে হবে। বিদ্যুৎ বিল কৃষির হারে নিতে হবে। জটিল রোগের টিকা ও ওষুধ বিনামূল্যে দিতে হবে। খামারিদের সমিতির আওতায় এনে জামানত ছাড়া ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি।

প্রতিটি উপজেলার প্রধান বা বড় বাজারে সমিতির নামে দু-তিন শতক জায়গায় মুরগি ও ডিম বিক্রির দোকান নির্মাণ করে দিলে খামারিরা সরাসরি পণ্য বাজারজাত করার সুযোগ পাবেন বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘ফিডেই খামারিদের ব্যয় হচ্ছে ৭০ শতাংশ। তাই খাদ্য উৎপাদন খরচ কমাতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ পোলট্রি খাতের পণ্য আমদানিতে ট্যাক্স কমানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমদানি পণ্যে বেশি ট্যাক্স নেওয়া হচ্ছে। এটি কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।’

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ড ম ম রগ ব যবস থ করপ র ট ম রগ র ন বল ন এক ম স সরক র র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

আসল সংস্কার জনগণই করেছে

গণ-অভ্যুত্থানের আগের বছরটিতে বাংলা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটা বিদ্বেষের মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে সবাই সবাইকে ‘বাঙ্গু’ হিসেবে উপহাস করছেন। বাঙ্গু বাম, বাঙ্গু ডান, বাঙ্গু বুদ্ধিজীবী, বাঙ্গু বিপ্লবী, বাঙ্গু কী না!

জাতির অন্তরের গভীরে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছিল, যার বহিঃপ্রকাশ ছিল ওই প্রবল আত্মমর্যাদার, সবাইকে তুচ্ছজ্ঞান করার, হেয় করার ছোঁয়াচে উপসর্গ। সম্ভবত এর মধ্যেই ছিল সমকালীন রাষ্ট্রীয় অচলায়তনকেই যে নড়ানো যাচ্ছে না, তার কোনো সংস্কারই আর সম্ভব না; সেই রাজনৈতিক হতাশার একটা যৌথ মনস্তাত্ত্বিক প্রতিচ্ছবি। হাসিনার অপরাজেয়তার অসচেতন এক স্বীকৃতিও, হাসিনার সরকারকে কেউ নাড়াতে পারবে না—কাজেই সব তত্ত্ব, মতাদর্শ, রাজনীতিই বৃথা। সবাই হাস্যকরভাবে পর্যুদস্ত। অতএব, সবাই বাঙ্গু।

অদ্ভুত একটা বিষয়, গণ-অভ্যুত্থানের পুরো সময়টায় কাউকে বাঙ্গু বলতে দেখিনি। গত বছরের ১৬ জুলাই আমার এই বিস্ময়ের প্রকাশটা ছিল এমন: ‘জাতি শ্রদ্ধা অর্জন করে। দেখো, গত এক সপ্তাহে কেউ কাউকে বাঙ্গু বলেনি। কারণ, ওইটা ছিল আমাদের নিজেদের ভেতর নিজেদের অসম্মান। আমরা নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলাম, তাই আমরা নিজেদের কাছে বাঙ্গু হয়েছিলাম। একজন আরেকজনের দিকে আঙুল তুলে নিজের প্রতি ওই তিক্ততাকেই ঘৃণা আকারে ছড়িয়ে দিচ্ছিলাম। কিছুটা বিশ্বাস জন্মাচ্ছে, অনেকটা ভালোবাসতে পারছি একজন আরেকজনকে।’

একটা গণ-অভ্যুত্থান যে শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে নিজেদের প্রতি, বিপ্লবে পরিণত হতে পারলে তা বহু ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় দেশকে। একেকটা সংস্কার ক্লেদের, অমর্যাদার একেকটা নাগপাশ ছিঁড়ে ফেলে, একেকটা সংস্কার আশাবাদ আর আত্মবিশ্বাস তৈরি করে।

ঠিক এক বছরের মাথায় সংস্কার নিয়ে লিখতে বসে দেখলাম, চব্বিশ বিপ্লব নাকি অভ্যুত্থান—সেই বিতর্ক চলেছে বহুদিন। আর এখন আলাপ দাঁড়িয়েছে ন্যূনতম কতটা সংস্কার হলে আমরা খুশি!

জাতি কি আবার আত্মগ্লানির বিষাক্ত বাঙ্গুযুগে প্রবেশ করবে?

২.

গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ের বিবেচনায় সংস্কার দুই ধরনের হতে পারত—

ক. যেসব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই সম্পন্ন করতে সক্ষম।

খ. সংবিধান সংস্কারের মতো বিষয়গুলো, যা নির্বাচিত সংসদ ছাড়া সম্ভব নয়।

দুই ধরনের সংস্কারের গুরুত্বের তুলনা চলে না। উভয়ই অপরিহার্য।

গণ-অভ্যুত্থানের যদি একটি নির্ধারক শক্তি থাকত, তাহলে অন্তর্নিহিত শক্তির গুণেই নিজস্ব রাষ্ট্রদর্শন অনুযায়ী দুই ধরনের সংস্কারই শুরু হতে পারত। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান যতটা ছিল বিগত সরকারের প্রতি জনতার ক্রোধের প্রকাশ, এর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি ততটা ছিল না। সে কারণেই সংস্কারের ভাগ্য ঝুলেছে দোদুল্যমান ও আত্মবিশ্বাসহীন এবং ভাগ্যক্রমে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপের ওপর।

নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সজাগ থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারও প্রথম ক্রমিকে উল্লেখ করা সেসব সংস্কার অনায়াসেই করে ফেলতে পারত, যার চাপে ভবিষ্যতে জনরায়ের বৈধতা নিয়ে নির্বাচিত সরকার এলেও সংবিধান সংস্কারের মতো মৌলিক প্রশ্নগুলো অনিবার্য হয়ে উঠত।

অচিরেই আমরা একটি বিপুল অক্ষম বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠীকে পাব, ‘জনসংখ্যার ডিভিডেন্ড’ ব্যবহার করতে না পেরে কোনো সঞ্চয় ছাড়াই যারা বুড়ো হবে। কয়েক বছর ধরে ট্রাফিক সিগন্যালে হাত পাততে থাকা বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমানতা তারই ইঙ্গিতবহ।

যেমন বেশ কটি গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও অপচয়ের মহামারির একটা বড় কারণ আমলাতান্ত্রিকতা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেরই একটা দৃষ্টান্ত দেখানো যাক। বিশ্বব্যাংকের ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রকল্পের খরচ কীভাবে করা হবে, তার উদ্বেগজনক চিত্র মিলবে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘বিশ্বব্যাংকের সিটা প্রকল্পের ব্যর্থতা ও অপচয়ের আশঙ্কা কেন’ শীর্ষক নিবন্ধটিতে। এই প্রকল্পের ১০ শতাংশের সামান্য বেশি ব্যবহার করা হবে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য, ১৩ শতাংশের কাছাকাছি ব্যয় করা হবে পরামর্শকের জন্য! অথচ নিবন্ধটির বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তা লেখকেরা দেখিয়েছেন, যা কেনা হবে, সেই সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক কম ব্যয়ে কাজটা করতে সক্ষম। এতে রক্ষণাবেক্ষণ খাতেও বিপুল ব্যয় থেকে দেশ বেঁচে যাবে! অথচ আড়াই শ মিলিয়ন ডলার পূর্বপরিকল্পনামতো ব্যবহৃত হলে সফটওয়্যার নির্মাণ খাতে বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে ডেটা সিকিউরিটি হারাবে বাংলাদেশ।

উন্নয়নের নামে এ ধরনের অপচয়ই ছিল হাসিনা সরকারের অর্থনৈতিক ভিত্তি। অর্থনীতির সংস্কার যদি করতেই হয়, তাহলে এ ধরনের প্রকল্পগুলো আরও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে করা উচিত। প্রকল্পের খুঁটিনাটি তথ্য যদি না–ও দেওয়া যায়, তার মূল অংশগুলোকে বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম ও অংশীজনদের জন্য উন্মুক্ত রাখা সারা দুনিয়ার রীতি। অথচ এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই পর্যালোচনার সুবিধার্থে সিটা প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেশখ্যাত ব্যক্তিরাও ব্যর্থ হয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রকল্প গ্রহণ করছেন যথারীতি গোপনে, পুরোনো রীতিই অনুসরণ করে। অথচ আমলাতন্ত্রের বাইরে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিটি তৈরির মাধ্যমে এসব প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের বন্দোবস্ত করে তারা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত। এতে ভবিষ্যতের সরকারগুলোর পক্ষে সেই রীতি ভাঙা কঠিন হতো।

বাংলাদেশে দুর্নীতি আর অপচয়ের লাগামছাড়া পরিস্থিতির মস্ত কারণ মন্ত্রণালয়গুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে বিশেষজ্ঞদের কার্যকর ভূমিকা না থাকা। পৃথিবীর যে অল্প কিছু রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয়গুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জনপ্রশাসনের আমলারা প্রায় একচ্ছত্র ভূমিকা রাখেন, তার একটি বাংলাদেশ। পেশাদার কেউ তাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্বে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না।

ফিরোজ আহমেদ: রাজনীতিবিদ; সদস্য, সংবিধান সংস্কার কমিশন

সম্পর্কিত নিবন্ধ