উনিশ শতকের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য
Published: 30th, May 2025 GMT
শিরোনামের ‘মুসলিম’ শব্দটির ব্যাপারে প্রথমেই টীকা দিয়ে রাখা দরকার। ‘বাংলা সাহিত্য’ কথাটার উপস্থিতিতে এ ধরনের অনুমান হওয়া সম্ভব যে এখানে বাংলাভাষী মুসলমানের কথাই বলা হচ্ছে। কিন্তু বাংলা অঞ্চলে অবাঙালি মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রচুর এবং তারাই ছিল প্রভাবশালী। উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলাপ তুললে আলোচনার কেন্দ্র হিসেবে কলকাতার কথা মনে না এসে উপায় থাকে না। তখন কলকাতাই ছিল বাংলা সাহিত্যের, অন্তত আধুনিক অর্থে আমরা যাকে বাংলা সাহিত্য বলে প্রায় সর্বসম্মত স্বীকৃতি দিয়েছি তার প্রধানতম চর্চাস্থল। সে কলকাতায় বাঙালি মুসলমানের তুলনায় উর্দুভাষী মুসলমানরা কেবল সংখ্যায় নয়, প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকেও বেশ অগ্রসর ছিল। এমতাবস্থায় বাংলা সাহিত্যের সাপেক্ষে আলাপ তুলে আমরা বাঙালি মুসলমানকে যতই আলাদা করতে চাই না কেন, দুটি সংশ্লিষ্ট ও প্রতাপশালী জনগোষ্ঠীর হিস্সা বাদ দিয়ে সে আলাপ পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।
এর প্রথমটি যদি হয় বাংলা অঞ্চলের অবাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়, অন্যটি হবে হিন্দু ভদ্রলোক সমাজ। উনিশ শতকের বাংলা ভাষাচর্চা, সাহিত্যচর্চা এবং পশ্চিমা অর্থে আধুনিকতার চর্চা প্রধানত শেষোক্ত সমাজটিই করেছিল। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এবং চর্চাকারীরা সংখ্যায় খুব কম হলেও সে চর্চার ফলাফল বর্ণাঢ্য ও ঈর্ষণীয়। বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়ে আলাপে এ জনগোষ্ঠীর অনিবার্যতা এই যে মুসলমান সমাজ যখন ‘আধুনিকতা’র সিঁড়িতে পা রাখল, কিংবা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় অগ্রসর হলো, তখন ওই জনগোষ্ঠীর নানামাত্রিক সাপেক্ষতা এড়িয়ে পথচলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বস্তুত এ সাপেক্ষতা এত প্রবল যে এখন প্রায় ২০০ বছর পরেও আমাদের প্রভাবশালী বয়ানগুলো একে এড়িয়ে কথা বলতে শেখেনি। সাপেক্ষতার কথা মনে রাখা জরুরি; তার এক বড় কারণ এই যে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী হিসেবে আধুনিকায়নের নিরিখে মুসলমান সমাজের বিলম্বিত বিকাশে ভদ্রলোক হিন্দু সমাজের প্রভাব ছিল অতি গভীর। কিন্তু সাপেক্ষতাকেই চূড়ান্ত মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করায় মুসলমান সমাজের বিকাশের নিজস্ব বহুমাত্রার দিকে মনোযোগ দেওয়ার অবকাশ কম হয়েছে। পাঠের সে এক সীমাবদ্ধতাই বটে।
অন্যদিকে বাংলা অঞ্চলের উর্দুভাষী মুসলমান সমাজের প্রচণ্ড প্রতাপের মধ্যেই বাংলাভাষী মুসলমান বিদ্বত্সমাজের বিকাশ ঘটেছিল। তার সঙ্গে এ কথাও গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত থাকা দরকার যে সর্বভারতীয় উর্দু-সংস্কৃতির প্রভাব এড়ানোও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিশ শতকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাস্তবতায় উর্দুর বিপরীতে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের বিকাশের পটভূমিতে অনেকটা কালাতিক্রমী দোষ ঘটিয়ে বিচার করা হয় বলে উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের উর্দু ভাষা-লগ্নতাকে ‘ত্রুটি’ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু যদি ব্রিটিশ–ভারতীয় বাস্তবতার পটভূমিতে ভারতীয় মুসলমান সমাজের ‘সংখ্যালঘুতা’ বিবেচনায় রাখা হয় আর ভারতীয় রাজনীতিতে নিখিল মুসলমান সমাজের ঐক্যের বোধটা উপলব্ধি করা যায়, তাহলেই বোঝা যাবে, বাংলাভাষী মুসলমানের কথিত উর্দুপ্রীতি বিদেশিয়ানা তো নয়ই, এমনকি মুসলমানিত্বও নয়, বরং নির্ভেজাল অস্তিত্বলগ্ন বাস্তবতা। ঠিক যেমন কলকাতার ভদ্রলোকশ্রেণির গত বহু দশকের ইংরেজিয়ানা তার বাঙালিয়ানায় বড় কোনো সংকট তৈরি করেনি।
২.
তাহলে বাংলা সাহিত্যচর্চার নিরিখে ‘মুসলিম মানস’ শব্দযুগল বাঙালি মুসলমানকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করলেও আরও অন্তত তিনটি বর্গকে হাজির-নাজির জেনেই আলোচনাটা করতে হবে। তার বাইরে ছাতাবর্গ হিসেবে থাকবে মহামহিম ইংরেজ রাজ, যার ছত্রচ্ছায়ায় প্রচণ্ড ঔপনিবেশিক বাস্তবতার মধ্যে প্রাগুক্ত প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত বিচলন এবং হ্রাস-বৃদ্ধি সংঘটিত হয়েছিল। ঠিক এখানেই ‘উনিশ শতক’ সময়বর্গটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলে থাকেন, উনিশ শতক কেন? আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় উনিশ শতক কি যথেষ্ট দূরবর্তী নয়? জবাবে বলতে হয়, আমাদের বর্তমানময়তার জন্য উনিশ শতক একমাত্র না হলেও খুবই জরুরি বর্গ। যে ধরনের আধুনিকায়নের পথ ধরে বাংলাদেশের জনসমাজের গরিষ্ঠাংশ অর্থাৎ মুসলমান সমাজের বিকাশ ঘটেছে এবং আজতক যে ধরনের জীবনদৃষ্টি ও ইতিহাসবোধ আমাদের বর্তমানকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তার অধিকাংশ মূল ধারণা কাঠামোপ্রাপ্ত হয়েছিল উনিশ শতকেই।
ঠিক এ ধরনের একটা প্রয়োজনবোধের প্রকাশ হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এ সময়ের মুসলমান সমাজ ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। আজকের এ বক্তৃতায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে স্মরণ করতেই হয়। এর প্রধান কারণ, তাঁর স্মরণেই এ বক্তৃতা। অন্যতর কারণ, আজকের বক্তৃতার বিষয় আবশ্যিকভাবে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর ইতিমধ্যে ক্ল্যাসিক হয়ে ওঠা বইটিকে—‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ নামে যে বই প্রথমবারের মতো বেরিয়েছিল ১৯৬৪ সালে। এটি একাডেমিক গবেষণার সংশ্লিষ্ট এলাকায় দেশে ও বিদেশে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত গ্রন্থ। কয়েক দশক পরে প্রকাশিত গ্রন্থটির এক নতুন মুদ্রণে লেখক জানিয়েছেন, বইটিতে প্রকাশিত মতামত ও বিশ্লেষণ তখনো বিশেষ পরিবর্তন করার দরকার তিনি বোধ করেননি। এই যে কয়েক দশক ধরে তিনি নিজের মতে নিষ্ঠ থাকতে পেরেছেন আর অন্য ব্যবহারকারীরাও এ বয়ানে সম্মতি দিয়ে গেছেন, তা একদিকে বইটির শক্তিমত্তার পরিচায়ক, অন্যদিকে পরিবর্তিত তথ্য-উপাত্ত এবং দৃষ্টিভঙ্গি অঙ্গীভূত না করা, দুই তরফেই কিছু সীমাবদ্ধতাও নির্দেশ করে। প্রথমে শক্তিমত্তার দিকগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করা যাক।
‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থ গবেষক আনিসুজ্জামানের তথ্যনিষ্ঠার চমত্কার নিদর্শন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাহিত্যপাঠের কায়দাকানুন ও দক্ষতা। গবেষকের বস্তুনিষ্ঠ মনও এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আনিসুজ্জামান গবেষণার সীমা নির্ধারণ ও তদনুযায়ী গোছগাছের জন্য সুখ্যাত। এ বইয়ে সে খ্যাতির উল্লেখযোগ্য অভিব্যক্তি ঘটেছে। এ সবগুলো বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছে গ্রন্থটির গদ্যরীতি আর উপস্থাপনভঙ্গিতে। ফলে বইটি সুখপাঠ্য হয়েছে।
গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে বইটির দ্বিতীয় বড় গুণ বেশ কিছু নতুন টেক্সট ও রচনাধারা প্রথমবারের মতো বিশ্লেষিত হওয়া এবং সেসব বিশ্লেষণের পাঠক-স্বীকৃতি। বলা যায়, সাহিত্যের এবং ইতিহাসের বেশ কিছু দিকের পাঠ-পদ্ধতি নির্দিষ্ট হয়েছে এ বইয়ে, যা পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়েছে।
তবে এ বইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্যের ব্যাপারে স্পষ্টতা আর একাগ্রতা। একনামে একে ডাকতে পারি আধুনিকায়ন নামে। লেখক প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা প্রভাবে আধুনিকায়নের যেসব নতুন আলামত হিন্দু সমাজে ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছিল, মুসলমান সমাজে তার আবির্ভাবের যাত্রাপথ তালাশ করেছেন। উদারনৈতিক মানবতাবাদী ঘরানার কিছু বুনিয়াদি ধারণা, যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থে সেক্যুলারবাদ, সাহিত্যে রুচি-সৌন্দর্য আর মানবিক অভিব্যক্তির অন্বেষণ, দুনিয়াবি দৃষ্টিভঙ্গির ক্রম-অগ্রসরতা অর্থে প্রগতি ইত্যাদি তাঁর যাবতীয় বিবেচনা ও মূল্যায়নে পরম গুরুত্ব পেয়েছে। এ বইয়ের সবচেয়ে বড় গুরুত্ব এসব জীবনদৃষ্টির পরিচ্ছন্ন ও নিশ্চিত একটা রূপরেখার অধীন যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত ও মূল্যায়নকে সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত করতে পারা। আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা আর দুনিয়াদারি অর্থে সেক্যুলারবাদ ইত্যাদি বর্গের স্বচ্ছ আর প্রত্যয়ী অধিগ্রহণই সম্ভবত এ গ্রন্থের দীর্ঘমেয়াদি সম্মতিলাভের মূল কারণ।
অনেকেই বলে থাকেন, মুসলিম মানসকে আলাদাভাবে চিহ্নিত-চিত্রিত করা বৃহত্তর পাকিস্তানি ভাবধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তাঁর পরবর্তী কাজ মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্রকেও এ ধারায় বিবেচনা করা চলে। এ কথা আংশিক সত্য মাত্র। আর আংশিক হিসেবে তা প্রকৃত ‘সত্য’ থেকে এতটাই দূরবর্তী যে এ মূল্যায়ন ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ বইটি সম্পর্কে বস্তুত কোনো সত্যই প্রকাশ করে না। সত্য এই যে ১৯৬০-এর দশকে যখন বাংলাভাষীরা ইতিমধ্যে দুই রাষ্ট্রে বিভাজিত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র এক উপস্থিত বাস্তবতা, তখন বিশেষভাবে মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বরূপের সন্ধান করা একজন তরুণ গবেষকের কাণ্ডজ্ঞানের পরিচায়ক। জরুরি প্রশ্ন হলো, তখন বিশেষভাবে মূর্ত হয়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সঙ্গে এ বয়ান সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে কি না। এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, মুসলমান-প্রধান এক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ ধ্যানধারণা আবিষ্কার করে তাকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার যাবতীয় উপাদান এ গবেষণা গ্রন্থে হাজির আছে। লেখক মুখ্যত স্বাতন্ত্রবাদিতার উপাদানগুলো চিহ্নিত করে তাকে পরিহার করা এবং ইতিহাসে সমন্বয়বাদিতার যেসব বড় মুহূর্ত অঙ্কিত হয়ে আছে সেগুলোকে সামনে নিয়ে আসার কাজটাই করেছেন। সেখানে সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি, অসাম্প্রদায়িকতা, বাংলা ভাষার প্রমিত রূপের চর্চা এবং সর্বোপরি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলিঙ্গন প্রধান হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানবাদী দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যবাদও সেখানে বন্দিত হয়নি, নিখিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শবাদও বড় হয়ে ওঠেনি। ষাটের দশকের পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের মডারেট ও গ্রহণযোগ্য একটা রূপই তাতে ধরা পড়েছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বিখ্যাত উদারনীতিবাদের সে এক কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন বোঝাপড়া। উল্লেখ্য, বিশ শতকের আশির দশকে ঢাকায় তুলনামূলক উগ্রবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বিকাশ ও প্রকাশ দেখি, আনিসুজ্জামান তাতে খুব সামান্যই অংশগ্রহণ করেছেন, যদিও মোটাদাগে নতুন ধারার জাতীয়তাবাদ চর্চাকারীদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বিরোধ ছিল না।
৩.
গত কয়েক দশকে ইতিহাসদৃষ্টি ও তথ্য-উপাত্তের যেসব নতুন আমদানি ঘটেছে, তার একাংশের ওপর এবার নজর দেওয়া যাক।
প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ‘আধুনিকতা’বিষয়ক ধ্যানধারণার পরিবর্তনের কথা। উনিশ শতকের মুসলিম মানসকে যদি আনিসুজ্জামানের বয়ানের পটভূমিতে পাঠ করতে চাই, তাহলে এ বর্গের ধারণাগত পরিবর্তন এ কারণে খুব জরুরি যে তাঁর পুরো বয়ানের শিরদাঁড়া আধুনিকতার ধারণা। আধুনিকায়নকে তিনি দেখেছেন স্বতঃপ্রগতিশীল এক গুণবাচক বর্গ হিসেবে। সাধারণভাবে আজকাল আর ব্যাপারটিকে সেভাবে দেখা হয় না। না দেখার সঙ্গে অবশ্য অন্য একটি বর্গ বিশেষভাবে সম্পর্কিত—ঔপনিবেশিক শাসন। ব্রিটিশ আমলই আনিসুজ্জামানের মূল ক্রিয়াক্ষেত্র এবং এ ব্যাপারে তিনি মোটেই বেখেয়াল ছিলেন না। তবে ব্রিটিশ আমলকে স্মরণে রাখা এক কথা আর একে ঔপনিবেশিক শাসন হিসেবে বর্গীকরণ আরেক। ১৯৬০-এর দশকে উপনিবেশের বাস্তবতার তুলনায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও বিরোধের বাস্তবতাকে বড় করে দেখা ছিল ইতিহাসচর্চার সাধারণ প্রবণতা। উপনিবেশশাস্ত্র ১৯৮০-এর দশকে যে ধরনের প্রগাঢ়তা লাভ করেছিল, ওই সময় তা সুদূরের ব্যাপার। তা ছাড়া ব্রিটিশ শাসন যদি আধুনিকায়নের উত্স হয়ে কলকাতায় মহামহিম রেনেসাঁর জোগান দিয়ে থাকে, তাহলে একে ঔপনিবেশিক শাসন হিসেবে পাঠ করার কোনো অভ্যন্তর-প্রেরণাও থাকার কথা নয়।
গত কয়েক দশকের জ্ঞানকাণ্ডে আধুনিকতাবিষয়ক ধারণার ব্যাপক রদবদলের অন্যতম কারণ ব্রিটিশ আমলকে ঔপনিবেশিক আমল হিসেবে দেখা। এ প্রেক্ষাপটে উনিশ শতকের আধুনিকায়নকে সহজেই পশ্চিমায়ন আর উনিশ শতকের ভাব-বিপ্লবকে উপনিবেশায়ন-প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। দেখার ও পড়ার এ দৃষ্টিভঙ্গি আনিসুজ্জামানের কালের প্রভাবশালী রীতি-পদ্ধতির তুলনায় এতই আলাদা যে দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটলে বহু সিদ্ধান্তেরও বদল অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
সাহিত্যপাঠের তরিকায়ও গত কয়েক দশকে বেশ বড় ধরনের বদল ঘটেছে। আনিসুজ্জামান উনিশ শতকের সাহিত্য পাঠ করেছেন একধরনের ক্ল্যাসিক মেজাজে—উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বরাভয়ে। সেখানে পাঠের নিশ্চয়তা সম্বন্ধে বিশেষ সন্দেহ দেখা যায়নি। উঁচু শিল্পকলার বিপরীতে নিচু শিল্পকলা নিমেষেই বাতিল হয়ে গেছে। ভাষাভঙ্গির দিক থেকেও তিনি স্বভাবতই অবলম্বন করেছেন সেকালের প্রভাবশালী ধারণা—প্রমিত রীতি অবলম্বনকে প্রগতিশীল অবস্থান হিসেবে অনায়াসেই ঘোষণা করেছেন। শিল্পকলার শ্রেণিবিভাজন আজকাল আর এত নিঃসংশয়ে করা হয় না। ‘নিচু’ হিসেবে আখ্যাত বা শ্রেণিকৃত শিল্পোত্পাদনকে জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক অস্তিত্ব ও পরিচয়ের খুব নির্ভরযোগ্য উপকরণ হিসেবে দেখার কলা ও অভ্যস্ততা মানুষ রপ্ত করেছে। অপ্রমিত উচ্চারণের আধারে মানুষের জিব ও গলার উষ্ণতা তালাশ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও বিদ্যাজগৎ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সম্মত হয়েছে।
উনিশ শতকের মুসলমান সমাজ নিয়ে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তেও যথেষ্ট বদল ঘটেছে। এ বদল একদিকে পরিমাণগত, অন্যদিকে গুণগত। এ কথা ঠিক, একজন স্থিতধী তরুণ গবেষক হিসেবে আনিসুজ্জামান কেবল প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তই ব্যবহার করেননি, সেকালের তথ্যভান্ডারে বেশ কিছুর জোগানও দিয়েছেন। কিন্তু কোনগুলো একটি গবেষণায় তথ্য হিসেবে বিবেচিত হবে আর সেগুলোর ব্যবহারবিধিই বা কী হবে, তা অনেক সময়ই প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যাক, ব্রিটিশ আমলের সরকারি নথিপত্রের যে ধরনের ব্যবহার সাবঅলটার্ন স্টাডিজ দল করেছিল, কিংবা নীলেশ বোস মুসলমান সম্প্রদায়ের বিশেষ পর্বের ঐতিহাসিক ভাষ্য প্রণয়নের কাজে যে ধরনের প্রাথমিক উত্সকে মূল্যবান ভেবেছেন, তা আনিসুজ্জামানের তুলনায় বেশ আলাদা। উনিশ শতকের বাংলায় মুসলিম মানস উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি বা তথ্যভান্ডারের এ বদলের একটা বড় কারণ আসলে লক্ষ্যগত পরিবর্তন। পরবর্তীকালের অনেক গবেষকই আধুনিকতা তালাশ না করে, কিংবা সে আধুনিকতার অগ্রসর নিশানবরদার হিসেবে বাঙালি হিন্দু সমাজের সঙ্গে মুসলমান সমাজের তুলনা কমিয়ে এনে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন ভেতর থেকে মুসলমানের পরিচয় উদ্ঘাটনের দিকে। ফলে তথ্য-উপাত্তের পরিমাণগত ও গুণগত বদল ঘটেছে।
ওপরে কয়েক দশকের ব্যবধানে যেসব পরিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইশারা দিলাম, তার নিরিখে উনিশ শতকের মুসলিম মানস পুনর্গঠিত হলে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্ভবত তাকে স্বাগত জানাতেন। এ প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়তো প্রাসঙ্গিক হবে। একবার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তিনি আমার পিএইচডি সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন। উনিশ শতক প্রসঙ্গে সেমিনারে উত্থাপিত এক সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাঈদ-উর রহমান আপত্তি তুলে বসলেন। সরাসরি স্যারকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আপনি তো এ বিষয়ে আমাদের ক্লাসে সম্পূর্ণ অন্য রকম সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন।’ আমার প্রায় হয়ে যাওয়া বিব্রতকর অবস্থাকে অনতিবিলম্বে বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় রূপান্তরিত করে শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক উত্তর দিলেন: অধিকতর তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। শুধু এই বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্তে নয়, আদতে আমার পুরো থিসিসের ক্ষেত্রেই তিনি সমরূপ ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছেন। প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত আমার ভূরি ভূরি সিদ্ধান্তের মধ্যে খুবই গৌণ দু-একটি ছাড়া তিনি আমার মত পরিবর্তনের প্রসঙ্গ তোলেননি। একে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার নিষ্ঠা হিসেবে দেখলে যথেষ্ট হবে না। এ আদতে তাঁর বিশিষ্ট উদারনীতিবাদী মানসিক অবস্থা, যা জীবনের শেষ দশকে পার্টি-ঘনিষ্ঠতা তুলনামূলক বাড়ানোর পরেও অনেকটাই অক্ষুণ্ন ছিল।
৪.
দৃষ্টিভঙ্গি বদলের একটা উদাহরণ নেওয়া যাক কথিত দোভাষী পুঁথির চর্চা থেকে। উনিশ শতকে মুসলমানদের রচনা বলে সাব্যস্ত করা যায় এমন গ্রন্থাদির বড় অংশ লিখিত হয়েছিল এ রীতিতে। আনিসুজ্জামান অবশ্য প্রধানত আধুনিকতার তালাশ করছিলেন বলে ১৮৭০ সালকে নতুন ধারার সাহিত্য রচনার সূচনা-বছর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উল্লেখ করতে ভোলেননি, এরপরও মুসলমান সমাজে এ ধরনের পুঁথি বিস্তর লিখিত হয়েছে। এ ভাষাকে তিনি বলেছেন মিশ্র ভাষা। মিশ্র ভাষার মধ্যে বাংলার সঙ্গে, তাঁর এবং আরও অনেকের মতে, মিশেছিল আরবি, ফারসি, উর্দু, তুর্কি ইত্যাদি। এ সিদ্ধান্তের একটা বড় পরিণতি এই যে মিশ্রণের অন্য ভাষাগুলো যেহেতু ‘বিদেশি’, কাজেই এ সূত্রে খুব সহজে বলা সম্ভব যে মুসলমান সমাজ বাংলাপ্রীতির বদলে ‘বিদেশি’ ভাষার প্রতি অনুরাগে মগ্ন ছিল।
কিন্তু আঠারো-উনিশ সালের ভারতীয় ভাষা-বাস্তবতা আমলে আনলে খুব সহজেই অন্য সিদ্ধান্তের অবকাশ তৈরি হয়। এ সময় ভারতের প্রধান লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল হিন্দুস্তানি। সে এতটাই যে ব্রিটিশরাজ উনিশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত নিজেদের আনুষ্ঠানিক স্থানীয় ভাষা হিসেবে হিন্দুস্তানিই ব্যবহার করত। এ ধরনের প্রভাবশালী একটা ভাষার সঙ্গে বাংলার মিশ্রণ ঘটেছিল—এটাই ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত হয়। অন্য ভাষার শব্দগুলো এ ভাষার অংশ হিসেবেই বাংলার সঙ্গে মিশেছে। হিন্দুস্তানি এক বিশুদ্ধ ভারতীয় বাস্তবতা—মোটেই বিদেশি চিজ নয়। তদুপরি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেই ১৯২৬ সালেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন, বাংলায় সরাসরি আদতে আরবি শব্দ মেশেনি—এসেছে ফারসির মধ্য দিয়ে। আসলে বলা উচিত, হিন্দুস্তানির মধ্য দিয়ে। যদি ফারসি থেকেও হয়, তাহলেও বলতে হবে, এ ভাষা-বাস্তবতার মধ্যে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা প্রায় শূন্যের কোঠায়। কারণ, ফারসি বহু শতক ধরে ভারতের রাষ্ট্রভাষা ছিল। উল্লেখ্য, দোভাষী পুঁথি প্রসঙ্গে হিন্দুস্তানির ব্যাপারটা পরবর্তীকালে আহমদ শরীফ সামনে এনেছিলেন।
কাজেই দোভাষী পুঁথির ভাষাকে মিশ্র ভাষা বলার মধ্য দিয়ে একদিকে প্রভাবশালী ভাষা-বাস্তবতাকে লঙ্ঘন করা হয়েছে; অন্যদিকে যে ঘটনা বিশুদ্ধ ভারতীয়, তাকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছে ‘বিদেশি’ বলে। গবেষক আনিসুজ্জামানের এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কারণ, পুরো থিসিসেই তিনি ভাষাবিষয়ক বিবেচনাটা এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই করেছেন। এর ফলে মুসলমান সমাজ যে প্রধানত ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় বিদেশের প্রতি অনুরক্ত হয়ে জীবন যাপন করে, এবং বর্তমানময়তার সঙ্গে তার যে কোনো সম্পর্ক নেই—এ বড় বয়ানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়েছে।
এ দৃষ্টিভঙ্গি ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থের বহু সিদ্ধান্তের উত্স। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে এখানে অব্যবহিত দুটি পরিণতির কথা বলা যাক। দোভাষী পুঁথিকারেরা অনবরত দাবি করেছেন, তাঁরা ‘চলতি’ বাংলায় লিখছেন। এ ধরনের কয়েকটি দাবির কথা আনিসুজ্জামান তাঁর অধ্যায়টিতে উল্লেখও করেছেন। অনেক পরে পুরোনো বাংলা গদ্য নামের জরুরি বইটিতে তিনি আদালতের জবানবন্দিসহ প্রচলিত ভাষার যেসব উদাহরণ সংকলন করে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, সেগুলো নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে, পুঁথিকারদের চলতি ভাষার দাবিটি ঠিকই ছিল। ১৯৬০-এর দশকে এসব তথ্য-উপাত্ত ছিল না। কিন্তু জনগণের ভাষায় জনগণের জন্য লিখছেন—এ রকম একটি অসামান্য ঘটনা যে এ গবেষকের কাছে মোটেই উল্লেখযোগ্য মনে হয়নি, তা এক বিরাট ক্ষতিই বটে।
অন্যদিকে দোভাষী পুঁথির মতো ‘প্রাচীনপন্থী’ রচনাদিতে সমকালীনতা থাকতেই পারে না, এ রকম একটা মনোভঙ্গি তাঁকে এতটাই চালিত করেছিল যে তিনি বহুবার এসব রচনাকে জীবনবিমুখতার দোষে অভিযুক্ত করেছেন। এ ধারার রচনা নিয়ে গত কয়েক দশকে অসাধারণ সব সন্দর্ভ রচিত হয়েছে। ১৯৬০-এর দশকের জ্ঞানকাণ্ডে সে ধরনের কিছু ছিল না। কিন্তু অন্তত গৌতম ভদ্র ‘ঈমান ও নিশান’ বইয়ে যে ধরনের পুঁথি-জাতীয় রচনার ভিত্তিতে ইতিহাস প্রণয়ন করেছেন, সে ধরনের বেশ কিছু দৃষ্টান্ত তাঁর সামনে ছিল। কিন্তু তিনি সেগুলো ব্যবহার করতে পারেননি।
নিঃসন্দেহে ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রেক্ষাপটে পুঁথিসাহিত্য পড়ার ও বিবেচনার যে ছাঁচ তৈরি হয়েছিল, আনিসুজ্জামান তাকেই অনুসরণ করেছিলেন। বিশ শতকের গোড়ায় মুসলমান ভদ্রলোকসমাজ প্রমিত ভাষা রপ্ত করার পটভূমিতে দোভাষী পুঁথি একবার ব্যাপকভাবে সামষ্টিক তিরস্কারের মুখে পড়ে। চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনের আবহে স্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তার প্রবলতায় ওই মনোভঙ্গি বদলে গিয়ে পুঁথির আদর-আপ্যায়ন বেড়ে গিয়েছিল। ষাটের দশকে বিপরীত একটা মনোভঙ্গি দোভাষী পুঁথির পাঠকে আবার বিপরীতক্রমে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থের ‘দোভাষী পুঁথি’ চরিত্রটি এই শেষোক্ত পর্বের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।
৫.
ইংরেজ আমলে শাসকপক্ষের সঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল—এ প্রশ্নে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য প্রভাবশালী প্রচলিত মতের অনুসরণ না করে নতুন দিশা দেখিয়েছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার ক্ষেত্রে নতুন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সামনে আনার কৃতিত্বও এ বইকে দিতে হবে। তার একটি মুসলমান সম্প্রদায়ের জমিদারি হারানো–বিষয়ক। প্রচলিত মত এই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে মুসলমানরা জমিদারি হারিয়েছিল। আনিসুজ্জামান দেখিয়েছেন, এ গল্প সত্য নয়। পুরোনো জমিদারির অবসান হয়েছিল। নতুন বাস্তবতায় নতুন জমিদারি পত্তনের আর্থিক সক্ষমতা কেবল হিন্দুদেরই ছিল। এর চেয়ে বড় কথা, মুসলমান আমলেও জমিদারি আসলে হিন্দুদের হাতেই ছিল, মুসলমানদের হাতে নয়। দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি মুসলমানদের ইংরেজি পড়া–সম্পর্কিত। আজতক জোরালোভাবে প্রচলিত ধারণা হলো, মুসলমান সমাজ ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বশবর্তী হয়ে ইংরেজি শেখায় বিমুখ ছিল। সে রকম প্রচারণা যে তখনকার সমাজে ছিল না, তা নয়। কিন্তু আনিসুজ্জামান বারবার এ বিষয়ে সাবধান করেছেন, মূলত ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণেই মুসলমানরা ইংরেজি শেখায় অগ্রসর হতে পারেনি। তার প্রমাণ, বিচিত্র খাতে প্রথম থেকেই শাসকপক্ষের সঙ্গে মুসলমানদের সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল। এ দুই মতই পরে আহমদ শরীফ প্রচার করেছিলেন। তিনি সম্ভবত ধারণাগুলো আদিতে পেয়েছিলেন ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ বই থেকে। আর নানা সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আনিসুজ্জামান ধারণাগুলো পেয়েছেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের কাছে। সে যা–ই হোক, প্রবল প্রতাপ মতের বিপরীতে অন্য মত গ্রহণ করা এবং তার বৈধতা প্রতিপাদনপূর্বক বয়ান পুনর্নির্মাণ করা দায়িত্বপূর্ণ গবেষকের প্রমাণ বৈকি।
কিন্তু এ বইয়ের এক পুনরাবৃত্ত দাবি—মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি শাসক ইংরেজের স্বতন্ত্র কোনো বিরূপতা ছিল না—সন্দেহাতীতভাবে ইতিহাসের ‘অর্ধ-সত্য’। এ দাবিতে শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক এতটাই নিষ্ঠ ছিলেন যে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের নগণ্য সংখ্যা বিষয়ে হান্টারের উদ্বেগ খণ্ডানোর জন্য তিনি উত্তর ভারতে মুসলমানদের তুলনামূলক বহুগুণ বেশি চাকরির কথা তুলেছেন। যোগ্য প্রার্থী ছিল না বলে অর্থাৎ ইংরেজি শেখেনি বলে বাংলার মুসলমানরা চাকরি পায়নি, সে কথা সত্য। কিন্তু শাসকপক্ষ থেকে শুরু করে স্থানীয় হিন্দু এলিট পর্যন্ত সবার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণে ভারতীয় মুসলমান সমাজের যে ব্যাপক অপরায়ণ ঘটেছিল, সে কথা উল্লেখ না করলে পূর্বোক্ত অর্ধ-সত্য মিথ্যার আকার নেয়। উপনিবেশায়ন-প্রক্রিয়া হিসেবে খুঁটিয়ে কালটিকে বিচার না করলে এ ছবিটা খুব স্পষ্ট করে ধরা না দেওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু মুসলমানদের অপরায়ণের একরাশ সংবাদ ১৯৬০-এর দশকের আগেই যথেষ্ট প্রচারিত ছিল। তাহলে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের থিসিসে তা প্রায় অনুপস্থিত কেন?
‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ আধুনিকায়নকে প্রগতির একমাত্র স্মারক হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, আর আধুনিকতার সফল আত্মস্থকারী হিসেবে শিক্ষিত হিন্দু সমাজের সঙ্গে সমন্বিত হওয়াকেই মুসলমান সমাজের প্রধান গুণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এহেন চিহ্নায়নই প্রাগুক্ত অনুপস্থিতির প্রধান কারণ। একই কারণে এ বইয়ে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ হয়ে উঠেছে সাম্প্রদায়িকতার নামান্তর। হিন্দু-স্বাতন্ত্র্যবাদ বিষয়টি প্রায় উহ্য থেকে গেছে। উনিশ শতকের শেষাংশ ও বিশ শতকের প্রথমাংশের কোনো কোনো মুসলমান লেখকের সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে তিনি হিন্দু সমাজের অনুরূপ মনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সাম্প্রদায়িকতার উত্স, বিস্তার ও গভীরতা সম্পর্কে এ গবেষণায় জরুরি বহু আলাপ অনুপস্থিত।
ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করেছিল সরাসরি মুসলমানপক্ষ থেকে। শাসনকাজের স্বাভাবিক সূত্র অনুযায়ী পূর্ববর্তী শাসকদের অক্ষমতা ও অযোগ্যতার ফিরিস্তি নির্মাণ খুব জরুরি আর ইংরেজরা তা-ই করেছিল। স্থানীয় এলিট হিন্দু সমাজ তাতে পরিপূর্ণ সমর্থন ও উত্সাহ জুগিয়েছে। বস্তুত ব্রিটিশ-ভারতীয় ইতিহাস গড়ে উঠেছিল এ ধারণার ভিত্তিতে যে ভারতীয় মুসলমান শাসন কেবল অন্ধকারাচ্ছন্ন আর পশ্চাত্পদ নয়, নৈতিক দিক থেকেও দূষিত। কাজেই ভারতীয় হিন্দুর পতনের মূল কারণ ‘বিদেশি’ মুসলমানরা। পুরো উনিশ শতকে এ মনোভাবই আমরা কলকাতার সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সর্বত্র প্রতিফলিত হতে দেখি। গবেষকগণ দেখিয়েছেন, স্থিতধী রামমোহন, বিদ্রোহী ডিরোজিও, হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী বঙ্কিমচন্দ্র—কারোরই এ বিষয়ে কোনো ভিন্নমত ছিল না। কিন্তু আনিসুজ্জামান এ ধরনের সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি দেখেছেন কেবল উনিশ শতকের শেষ ভাগে, যখন হিন্দু পুনর্জাগরণের একটা আন্দোলন চলছিল। রেনেসাঁর পরে রেস্টোরেশন—এ ছক মান্য করেই সম্ভবত তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কলকাতার উনিশ শতক পাঠ করার ক্ষেত্রে ছকটি বেশ জনপ্রিয়ই বটে। তবে এ ছক ধরে মুসলমানদের হাল-সাকিন ও সাহিত্যকর্মের খবর নেওয়ার অন্য সংকট আছে।
আনিসুজ্জামান যথার্থই খেয়াল করেছেন, ১৮৭০-এর দশকের গোড়ায় একদিকে মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার নতুন পর্ব শুরু হয়েছিল, অন্যদিকে আধুনিক সাহিত্যে তাদের অনুপ্রবেশও ঘটেছিল। সাহিত্য, চিন্তা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানবিদ্বেষজনিত সাম্প্রদায়িকতার প্রবলতা সত্ত্বেও এ সময় উঠতি মুসলমান ভদ্রলোকশ্রেণির সঙ্গে প্রভাবশালী হিন্দু মধ্যবিত্তের একটা সমঝোতার সম্পর্কই আমরা দেখতে পাই।
১৯২০–এর দশকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতি, দাঙ্গা ও স্বাতন্ত্র্যচেতনা বেড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি ও সহানুভূতির নানা নজির বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯), বিনয়কুমার সরকার (১৮৮৭-১৯৪৯) প্রমুখ এ দৃষ্টিভঙ্গির ভালো প্রতিনিধি; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১০–এর দশকের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে লেখা বহু-উদ্ধৃত প্রবন্ধগুলো এবং আগে-পরে লেখা ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধগুলো এ সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল রচনা; চিত্তরঞ্জন দাশ (১৮৭০-১৯২৫) ও সুভাষচন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫) চিহ্নিত হতে পারেন রাজনৈতিক প্রতিনিধি আর অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলনের যৌথতা ও বেঙ্গল প্যাক্টকে বলা যেতে পারে সমধর্মী রাজনৈতিক কর্মসূচির বহিঃপ্রকাশ।
ওই প্রজন্মের বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন করলেই বোঝা যাবে, সমন্বয়বাদিতাই প্রধান যুগধর্ম। শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১), রেয়াজুদ্দীন মাশহাদী (১৮৫৯-১৯১৮), মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ (১৮৬১-১৯৩৩), আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩), মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০), ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯) প্রমুখ এ যুগের প্রতিনিধি। এঁদের অনেকেই সমন্বয়বাদী ছিলেন—বস্তুত অধিকাংশ; আর কয়েকজন ছিলেন রীতিমতো জাতীয়তাবাদী-কংগ্রেসি। সবাই পত্রপত্রিকা বের করেছেন। স্বজাতির কল্যাণ কামনায় কাজ করেছেন। এই স্বজাতি মুখ্যত বাঙালি মুসলমান; আর প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই অগ্রসর বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে ঐক্যের মেজাজই প্রধান ছিল। ব্যতিক্রমহীনভাবে সবাই বাংলায় লিখেছেন। আর এঁদের সবার বাংলা প্রমিত; অনেকেরই বঙ্কিমীয় ও রাবীন্দ্রিক—তত্সমবহুল। এক কথায় একে বলা যায় সমন্বয়ধর্মী বাংলা, বাঙালি মুসলমানের তরফে যে বাংলার প্রবর্তন করেছিলেন বস্তুত মীর মশাররফ হোসেন।
মুসলমান সমাজ সংখ্যাগুরুর রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগের দশকগুলোতে বিকশিত ‘বাঙালি’ ও ‘ভারতীয়’ জাতীয়তাবাদ এবং ‘অসাম্প্রদায়িক’ সমন্বয়বাদের ওই অসাধারণ যুগটিকে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারব না, যদি উনিশ শতকের কলকাতায় হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের আধুনিকায়নের উত্থান-পতনের পথরেখা ধরে পুরো ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করতে চাই। ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থের এ অংশটি, আমাদের বিবেচনায়, এ কারণেই সন্তোষজনক হয়নি।
৬.
আগেই বলেছি, উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের মনোজগৎ ও সাহিত্য বিশ্লেষণের জন্য ভারতীয় মুসলমান, বাংলা অঞ্চলের অবাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু—অন্তত এ তিনটি বর্গের সঙ্গে সম্পর্ক পরীক্ষা করা জরুরি। একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, এটা গভীরভাবে শ্রেণিগত প্রশ্ন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বেশ কিছু ক্ষেত্রে, যেমন বাঙালি মুসলমানের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ-প্রশ্নে, আর্থিক সংগতির কথা মনে রেখেছেন। কিন্তু নানা লক্ষণ থেকে মনে হয়, এ ব্যাপারে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। মুসলমান সমাজের সংস্কার আন্দোলন কেন আবশ্যিকভাবে ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনে রূপ নিল, তার ব্যাখ্যা শ্রেণি-প্রশ্ন বা কৃষক-প্রশ্ন ছাড়া পাওয়া যাবে না। ঠিক তেমনি বাঙালি মুসলমান সমাজের নেতারা প্রায় সবাই কেন উর্দুভাষী ছিলেন, তার ব্যাখ্যাও আসলে শ্রেণিগত। শুধু মতাদর্শ আর মনোজগতের বরাত দিয়ে এসবের কিনারা করতে যাওয়াকে জ্ঞানতাত্ত্বিক সংকটই বলতে হবে।
উল্লেখ্য, ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থসহ এ বিষয়ের প্রভাবশালী প্রায় সব সন্দর্ভেই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলনামূলক কম গুরুত্ব পেয়েছে। ভারতীয় মুসলমানরা যে ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু, ফলে তাদের সামষ্টিক মনস্তত্ত্ব ও প্রতিক্রিয়ায় প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে সে অবস্থার প্রতিফলন ঘটবে, সে কথা মোটের ওপর অনুল্লেখিতই থাকে। আগের শাসক ছিল মুসলমান আর ব্রিটিশদের সঙ্গে দেনদরবারে মুসলমানরা প্রায় সমান প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের উপস্থিত করতে পেরেছিল—প্রধানত এ দুই কারণে প্রায় সব আলোচনায় সংখ্যালঘুতার গুরুতর দিকটা এড়িয়ে যাওয়া হয়। বাঙালি মুসলমানের উত্তর ভারতপ্রীতি, উর্দুপ্রীতি ইত্যাদিকে আদতে সন্তোষজনকভাবে কিছুতেই ব্যাখ্যা করা যাবে না, যদি সর্বভারতীয় সংখ্যালঘুতা বিষয়টিকে আড়াল করে কেবল মানসিক পশ্চাত্পদতাকে মুখ্য করে তোলা হয়। তার চেয়ে বড় কথা, উনিশ শতকের ‘বাঙালি’ ধারণাটি বিশুদ্ধত হিন্দু-কল্পনা আর মুসলমানের তরফে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকের মামলা। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষাপ্রীতিকে কেন্দ্রীয় বর্গ স্থির করে দেশপ্রেম ও প্রগতিশীলতা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কেবল যে ওই কালের ভাষা-পরিস্থিতির প্রতি অমনোযোগ প্রমাণ করে তা নয়, এটা আসলে পরিষ্কার কালাতিক্রমী দোষ।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ সম্পর্কে বলা যায়, তিনি সেকালের প্রভাবশালী মতামত দ্বারাই মুখ্যত চালিত হয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান কৃতিত্ব হলো, তিনি কেবল সে মতামতের ভোক্তা ছিলেন না, নিজেও তার পোষকতা করেছেন এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভাষার জোগান দিয়েছেন। তাঁর অর্জনের যথার্থ ব্যবহার হবে কেবল তখনই যখন একে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে আমরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল আর তথ্য-উপাত্তের নিরিখে নতুনতর সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব। তার জন্য মনে রাখা দরকার, ইতিহাসপাঠে ‘সত্যমূলকতা’ তুলনামূলক গৌণ ব্যাপার। কারণ, ইতিহাসে আমরা বস্তুত বর্তমানকেই পাঠ করি। আনিসুজ্জামান তাঁর কালের প্রগতিশীল ও প্রয়োজনীয় ভাবধারা হিসেবে জাতীয়তাবাদ অবলম্বন করেই বয়ান নির্মাণ করেছেন। সেকালের পটভূমিতে জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য উত্তম বিবরণী হাজির করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সে জন্য তিনি পর্যাপ্ত প্রশংসাও পেয়েছেন।
কিন্তু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উদারনৈতিক অবস্থান, আধুনিকতাবাদ এবং প্রগতিশীলতাও বিশেষ স্থান-কালের বাস্তবতা দ্বারাই চালিত হয়। এ প্রতিটি বর্গের সাধারণ সীমাবদ্ধতা এই যে সুবিধাপ্রাপ্ত তুলনামূলক শিক্ষিত-নাগরিক জনগোষ্ঠীর ভিত্তিতেই এ বর্গগুলো কাজ করে থাকে। আরও বেশি পরিমাণে মানুষের কাছে পৌঁছানো এবং বিবেচনার গণ্ডিতে আরও অনেক বেশি মানুষকে নিয়ে আসার কথা আমাদের ভাবতে হবে। এটা একদিকে বর্তমান রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে ইতিবাচক অর্থে প্রভাবিত করার মামলা, অন্যদিকে জ্ঞানতাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত নতুন অর্জনগুলোকে আত্মসাৎ করে বয়ানকে তুলনামূলক পূর্ণাঙ্গ করে তোলার অভিযাত্রা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পর্কে যতটা ভাবা যায় তার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, তিনি এ ধরনের অভিযাত্রাকে নিঃসংকোচে স্বাগত জানাতেন।
[১৬ মে ২০২৫ তারিখ আনিসুজ্জামানের মৃত্যুবার্ষিকীতে কালি ও কলম আয়োজিত ‘অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্মারক বক্তৃতা’ হিসেবে পঠিত]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব র ট শ আমল ব যবহ র কর চ হ ন ত কর ব শ শতক র র ব স তবত র পটভ ম ত জনগ ষ ঠ র ব স তবত র র ম সলম ন ষ ট র দশক ঔপন ব শ ক ম সলম ন র প রগত শ ল আম দ র ব র জন ত ক কর ছ ল ন গ রন থ র র ব পর ত র দশক র প রসঙ গ ধরন র প উপন ব শ এ বইয় র এ ধরন র প রচল ত উপস থ ত কলক ত র পরবর ত প ঠ কর পর ম ণ ত কর ছ র বর ত র অন য র জন য উল ল খ র পর চ ম ণ কর ত পর ব মন য গ হ র কর ন কর ছ ত র এক কর ছ ন হয় ছ ল বক ত ত বর গ র ই কর ছ র য সব ত হয় ছ দরক র এ সময় এতট ই ব ষয়ক প রথম একদ ক অবস থ র একট গ রহণ স মরণ সবচ য় সমন ব
এছাড়াও পড়ুন:
বিজিএমইএ’র ৩৫ পরিচালক পদে ভোটগ্রহণ চলছে
গণঅভ্যুত্থানের পর পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর পর্ষদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এর সাত মাস পর নতুন নেতৃত্ব ঠিক করতে বিজিএমইএর ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। আজ শনিবার ঢাকায় এবং চট্টগ্রামে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে।
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য শেষ মূহূর্তে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ নির্বাচনের প্রার্থীরা। ছোট উদ্যোক্তাদের সহায়তা, গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান এবং পোশাক খাতের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনে উদ্যোগ নেওয়ার মতো নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৫-২৭ মেয়াদের এই নির্বাচনে ৩৫টি পরিচালক পদের বিপরীতে ৭৬ জন প্রার্থী লড়ছেন। আজ শনিবার ঢাকায় এবং চট্টগ্রামে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে। মোট ভোটার ১ হাজার ৮৬৫ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৫৬১ এবং চট্টগ্রামে ৩০৩ জন।
প্রার্থীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর আগে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসকের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে। তাই নির্বাচন যেন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়, তা নিশ্চিত করার দাবি তুলছেন অনেকেই। তারা বলছেন, এবার ভোটের মাঠে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ফোরাম, সম্মিলিত পরিষদ ও ঐক্য পরিষদ নামে তিনটি প্যানেলের অধীনে অংশ নিচ্ছেন প্রার্থীরা। এর মধ্যে ফোরাম ও সম্মিলিত পরিষদ ঢাকায় ২৬টি, চট্টগ্রামে ৯টিসহ ৩৫ পদে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করলেও ঐক্য পরিষদ মাত্র ছয়জন প্রার্থী দিয়েছে।
নির্বাচনী ইশতেহারে ১৪ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ফোরাম। ফোরামের প্যানেল লিডার মাহমুদ হাসান খান সমকালকে বলেন, ‘নির্বাচিত হলে পোশাক খাতের অগ্রগতির জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করব। উৎপাদন সচল রাখতে গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান, বিজিএমইএর সব কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং ছোট কারখানা মালিকদের টিকে থাকার জন্য সহায়তা করার চেষ্টা করব।’ এ প্যানেলের প্রার্থী আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, পোশাকশিল্প শুধু ব্যবসা নয়, এটি উদ্যোক্তাদের শ্রম, আত্মত্যাগ ও দীর্ঘদিনের স্বপ্নের প্রতিফলন। তাই বিপদে-আপদে বিজিএমইএর সদস্যদের পাশে থাকবেন।
১২ দফা ইশতেহার দিয়েছে সম্মিলিত পরিষদ। সম্মিলিত পরিষদের প্যানেল লিডার মো. আবুল কালাম সমকালকে বলেন, প্রতিপক্ষ প্যানেল নানা কারণে বন্ধ থাকা ৬৯০টি কারখানার মালিককে ভুয়া ভোটার বলে যে অপপ্রচার চালিয়েছে তার নিন্দা জানান তারা। নির্বাচিত হলে তাদের কারখানা চালু ও এসএমই কারখানাগুলোকে সহায়তা করবেন। পরিষদের প্রার্থী মনজুরুল ফয়সাল হক সমকালকে বলেন, বিদ্যুৎ সংকট, এলসি জটিলতা, উচ্চ সুদহার, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পড়ে থাকে দিনের পর দিন–এ জাতীয় নানা সমস্যায় আছে পোশাক খাত। নির্বাচিত হলে এসব বিষয়ে কাজ করব।
ফোরামের প্রার্থী
ফোরামের থেকে ঢাকায় প্রার্থী হয়েছেন– মাহমুদ হাসান খান, মোহাম্মদ আবদুস সালাম, কাজী মিজানুর রহমান, মো. শিহাব উদ্দোজা চৌধুরী, ইনামুল হক খান, মো. হাসিব উদ্দিন, মোহাম্মদ সোহেল, শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ, ভিদিয়া অমৃত খান, এম এ রহিম, শাহ রাঈদ চৌধুরী, মিজানুর রহমান, জোয়াদ্দার মোহাম্মদ হোসনে কামার আলম, এ বি এম শামছুদ্দিন, নাফিস-উদ-দৌলা, সুমাইয়া ইসলাম, আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, মজুমদার আরিফুর রহমান, মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া, ফাহিমা আক্তার, আসেফ কামাল পাশা, রশীদ আহমেদ হোসাইনী, রুমানা রশীদ, সামিহা আজিম, রেজওয়ান সেলিম ও ফয়সাল সামাদ।
চট্টগ্রামের প্রার্থীরা হলেন– সেলিম রহমান, মো. শরীফ উল্লাহ, মোহাম্মদ রফিক চৌধুরী, এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাকিফ আহমেদ সালাম, এনামুল আজিজ চৌধুরী, এমদাদুল হক চৌধুরী, মির্জা মো. আকবর আলী চৌধুরী ও রিয়াজ ওয়াইজ।
সম্মিলিত পরিষদের প্রার্থী
পরিষদের ঢাকা থেকে প্রার্থী হয়েছেন– মো. আবুল কালাম, আবদুল্লাহ হিল রাকিব, মির্জা ফায়েজ হোসেন, মো. নুরুল ইসলাম, তামান্না ফারুক থিমা, হেলাল উদ্দিন আহমেদ, মহিউদ্দিন রুবেল, খন্দকার রফিকুল ইসলাম, মো. শাহদাৎ হোসেন, মো. রেজাউল আলম, ফারুক হাসান, এ কে এম আজিমুল হাই, লিথি মুনতাহা মহিউদ্দিন, মো. আশিকুর রহমান, এস এম মনিরুজ্জামান, মো. মশিউল আজম, মোহাম্মদ রাশেদুর রহমান, আবরার হোসেন সায়েম, মোহাম্মদ সোহেল সাদাত, সয়েদ সাদিক আহমেদ, মোস্তাজিরুল শোভন ইসলাম, মাঞ্জুরুল ফয়সাল হক, সাইফুদ্দিন সিদ্দিকী সাগর, মোহাম্মদ কামাল উদ্দীন, ফিরোজ আলম ও আসিফ আশরাফ।
চট্টগ্রামের প্রার্থীরা হলেন– এস এম আবু তৈয়ব, রাকিবুল আলম চৌধুরী, মোহাম্মদ মুসা, অঞ্জন কুমার দাশ, নাফিদ নবি, সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, মোস্তফা সারোয়ার রিয়াদ, মো. আবসার হোসেন ও গাজী মো. শহীদ উল্লাহ।