শফিকুল ইসলাম নিজ এলাকায় পরিচিত আদম ব্যবসায়ী হিসেবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, মানুষজনকে বিদেশে কাজে পাঠানোর কথা বলে কয়েক বছরেই তিনি হাতিয়েছেন প্রায় কোটি টাকা। নকল ভিসা ও বিমানের টিকিট তৈরি করে এ প্রতারণা করতেন তিনি। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শফিকুলকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে আটক করেছে র‍্যাব ১৪।

শফিকুল ইসলাম (৪২) ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কালাদহ ইউনিয়নের পাটিরা গ্রামের বাসিন্দা। গতকাল রাত পৌনে দুইটার দিকে গাজীপুরের জয়দেবপুর টেকনোপাড়া এলাকা থেকে তাঁকে আটক করা হয়। র‍্যাব জানায়, শফিকুল ‘জাজিরা এয়ারওয়েজ’, ‘এয়ার আরাবিয়া’, ‘সালাম এয়ার’, ‘ইজিপ্ট এয়ার’সহ বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে নকল টিকিট বানিয়ে প্রতারণা করতেন। আজ বিকেলে তাঁকে ফুলবাড়িয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

শফিকুলের বিরুদ্ধে র‍্যাবের কাছে অভিযোগ করেন ফুলবাড়িয়া উপজেলার শুশুতি গ্রামের আবদুল গণি (৩০) ও রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের পাহাড় অনন্তপুর গ্রামের নাজমুল হক।

আবদুল গণি বলেন, ‘ভাগ্যবদলের আশায় তুরস্কে যাওয়ার জন্য শফিকুলের হাতে মোট ৬ লাখ ১০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন। তুরস্কে নেওয়ার কথা বলে পাসপোর্ট ও টাকা জমা নিলেও দেড় বছর ঘোরান শফিকুল। এরপর জানান, তুরস্ক যাওয়া যাবে না, ২০ দিনের মধ্যে সৌদি আরব পাঠানো হবে। তবে সেখানেও পাঠাতে পারেননি তিনি। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘জাজিরা এয়ারওয়েজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া বিমানের টিকিট ও ভিসা দেওয়া হয়েছিল। পরে জানা যায়, টিকিট ও ভিসা দুটোই নকল। এরপর টাকা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও ১০ এপ্রিল থেকেই এলাকা ছেড়ে পালান শফিকুল। দাদনের চাপ ও টাকা ফেরত না পেয়ে নিরুপায় হয়ে তিনি র‍্যাবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।

আরেক অভিযোগকারী আবদুল গণি বলেন, তাঁর যা সম্বল ছিল, সব বিক্রি করে ও দাদনে টাকা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকেও বিদেশে পাঠানো হয়নি। টাকা চাইতে গেলে উল্টো তাঁকেই নানা হুমকি-ধমকি দিতেন শফিকুল। তাঁরা জানান, আশপাশের এলাকার অনেক মানুষ শফিকুলের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন।

র‍্যাব ১৪–এর অধিনায়ক নয়মুল হাসান বলেন, মানব পাচার ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে গ্রামের সরল মানুষের সঙ্গে প্রায় তিন বছর ধরে প্রতারণা করছিলেন শফিকুল। তাঁর বিরুদ্ধে নিয়মিত আইনে মামলা হবে। এ কাজে জড়িত অন্যদের ব্যাপারেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রোকনুজ্জামান জানান, শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি যাচাই–বাছাই করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

‘মব সহিংসতার ভিকটিম সবাই’

কিছুদিন আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে প্রকাশ্যে হত্যা করার বিষয়টি জনমনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মব বা সংঘবদ্ধ ভিড় তৈরি করে নৃশংসতার ঘটনা সামনে এসেছে। মাজারসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে আইনি ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত ব্যক্ত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

৫ আগস্ট-পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি, সেখানে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে মবকে শুরু থেকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে এমন কিছু ঘটনা ঘটানো হয়েছে, সেটি যদি আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হতো, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ প্রতিবাদ করত কিনা সন্দেহ। তাহলে একটা জাস্টিফিকেশন দেখানোর ব্যাপার থাকত যে, রাষ্ট্র কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে। যখন মব ব্যবস্থা নিচ্ছে, রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, তখন তারা আসলে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। ফৌজদারি আইনে মব সৃষ্টিকারী যেমন অপরাধী; তেমনি সহযোগীরও মবের সমান শাস্তি হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এর দায় এড়াতে পারবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটা অজুহাত থাকবে যে, পুলিশ বাহিনী ছিল না, তাদের অর্ধেকই কাজে যোগ দেয়নি। পুলিশের পুনর্গঠন, তারা সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে কাজ করে, এটি করার জন্য যে দৃশ্যমান কাজগুলো করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি। অভ্যন্তরীণভাবে কী কী কাজ করা হয়েছে, সেটি তারাই জানবেন। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে যা দেখছি, সে কথাই বলছি।
গণঅভ্যুত্থানের পর ৮০টির বেশি মাজার ভাঙা হলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? একদম শেষে একটা মাজার ভাঙার ঘটনায় দেখেছি, গ্রামবাসীই প্রতিরোধ করেছে মাজার ভাঙাকে। আইন ও প্রশাসনের আশানুরূপ ভূমিকা ছিল না।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পারভেজকে ছুরি মারার ঘটনা থেকে শুরু করে ভিডিওগুলো দেখছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম, কীভাবে এটি সম্ভব– শুধু একটি হাসির কারণে মেরে ফেলা হলো! আমি ধরে নিচ্ছি, যৌন হয়রানি করার জন্যই সে হেসেছে। আমি একজন অধিকারকর্মী হিসেবে বলছি। দীর্ঘদিন ধরে নারী অধিকার নিয়ে আমি কথা বলছি। যৌন হয়রানি কোনোভাবে সমর্থন করার মতো বিষয় নয়। এটি খুবই অস্বস্তিকর একটি বিষয় এবং প্রচণ্ড রকমের হয়রানি নারীর জন্য। কিন্তু এর জন্য মেরে ফেলা? আপনি যদি মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিজেই নেন, যে নারী অভিযোগ এনেছেন, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তিনি বলছেন যে, আমি তো শুধু হাত-পা ভাঙতে বলেছিলাম, মারতে তো বলিনি। তিনি আসলে বলেছিলেন, শারীরিক আক্রমণ করতে। এখন কেউ যদি শারীরিক আক্রমণ করার জন্য বন্ধু-বান্ধব ডেকে এনে এমন ঘটনা ঘটায়, তাহলে তো আপনি আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। আপনি আইনের দ্বারস্থ হতে পারতেন। থানায় অভিযোগ করতে পারতেন তাঁর নামে যে, আপনাকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে। আজ যে পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে– আমার একজন সহকর্মী বলছেন, তাঁর সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, এগুলো দেখে খুব চিন্তা হয়, সন্তান আমার ঠিকঠাক ঘরে ফিরবে তো? মানুষজন নিজের পরিবার নিয়ে এখন আর নিরাপদ বোধ করছে না। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, যে কোনো সময় মব তৈরি করে কারও বিরুদ্ধে আক্রমণ করা যাচ্ছে, পুলিশ সেখানে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। যশোরে গিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘অনেক হয়েছে, আর মব জাস্টিস মেনে নেওয়া হবে না।’ তার মানে কি দাঁড়াল? আমাদের আইনের ভাষায় এটিকে বলে, পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেওয়া যে, তারা এতদিন ধরে মব জাস্টিসকে সমর্থন করেছেন। মব জাস্টিসকে বৈধতা দেওয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে? এখন কেন আপনারা বলছেন, অনেক হয়েছে? কথাটা খুবই বিভ্রান্তিকর।
এই কথিত মব জাস্টিসের ভিকটিম আসলে সবাই। নারী-পুরুষ আলাদা করার কিছু নেই। বিগত সরকারের আমলেও এমনটা হয়েছে। সেটির চেহারা ছিল এক রকম। এখনকার চেহারাটা আরেক রকম। স্কুল থেকে সন্তানকে আনতে গিয়ে পিটিয়ে এক নারীকে হত্যা করার ঘটনাটি বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। এরকম ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তারও আগে ছিনতাইকারীকে ধরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া, মাইকে ঘোষণা দিয়ে ডাকাত ডাকাত বলে পিটিয়ে মেরে ফেলা– এরকম ঘটনা তো ঘটেছেই। এসব মবের পেছনেও জাস্টিফিকেশন তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর নারীরা শুরু থেকে বিভিন্ন কারণে ও অজুহাতে আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল। অথচ নারীরাই আন্দোলনের সবার আগে ভূমিকা পালন করেছে। এসব আক্রমণের ক্ষেত্রে আবার ধর্মীয় কারণ, হিজাব, পোশাক, ধূমপানের বিষয় নিয়ে আক্রমণের শিকার হয়েছে।
আমরা কেউই আশা করিনি যে, পরিস্থিতি এরকম জায়গায় নিয়ে যাবে। যারা ক্ষমতায় আছেন, একটা নিয়মের মধ্যে আনার জায়গা ও দায়িত্ব তাদেরই। সেই জায়গাতে নাগরিক হিসেবেও আমরা বিফল হয়েছি। আবার সামাজিকভাবে আমরা প্রচণ্ডরকম অসহিষ্ণু জাতিতে পরিণত হয়েছি। বিগত সরকারের শাসনকে দোষারোপ করে নিজেদের খারাপ দিকগুলো থেকে পার পাওয়া যাবে না। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে গেলে সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার, সেটি নেওয়া হয়নি। কেবল বাচনিক জায়গাতে থাকলেই কাজ হবে না। সক্রিয়তা লাগবে। আপনাকে দেখাতে হবে, আপনি রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কোন দিকে ধাবিত করতে চাইছেন।     গ্রন্থনা : দ্রোহী তারা
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ