দুর্নীতির জব্দ করা অর্থ-সম্পদ বাজেটে ব্যয় করলে চমক হবে
Published: 31st, May 2025 GMT
অত্যাচার, চুরি, দুর্নীতি বা করখেলাপির মাধ্যমে যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছেন, তাদের টাকা ও সম্পদ জব্দ করে বাজেট অর্থায়নে বিকল্প উৎস সৃষ্টির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এটি করতে পারলে এবারের বাজেটের বড় চমক হবে। নৈতিক অর্থনীতি গড়তেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
শনিবার ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাক-বাজেট ছায়া সংসদ’ নামে শিক্ষার্থীদের বিতর্ক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। রাজধানীর এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণের সভাপতিত্বে এ ছায়া সংসদ অনুষ্ঠিত হয়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমি আশা করি, আগামী বাজেটে আয়ের একটি নতুন খাত উন্মোচিত করবে সরকার। যারা অবৈধভাবে আয় করেছে, করখেলাপি, ঋণখেলাপি ও বিদেশে অর্থ পাচার করেছে, তাদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ এবং তাদের জব্দ করা সম্পদ বিক্রি করেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করে বাজেটে আয়ের একটি নতুন খাত হিসেবে দেখানো হবে। কীভাবে দেখানো যাবে, সে বিষয়ে ২০ বছর আগের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো বলেন, ‘আশায় আছি, অর্থ উপদেষ্টা সবাইকে চমকে দিয়ে চুরি করা টাকা, অবৈধভাবে উপার্জিত ও পাচার করা টাকা, দেশের ভেতরে ঋণ করে ফেরত না দেওয়া টাকা, করখেলাপির টাকা– যা এই ৯ মাসে জব্দ করা হয়েছে, তা বাজেট অর্থায়নে ব্যয় করার ঘোষণা দেবেন। আগামী বাজেটে এটি না হলেও ভবিষ্যতে আমাদের এটি করতে হবে।’
আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বর্তমান সরকার যে বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে, তা আগের সরকারের মতো গতানুগতিক বাজেটই হচ্ছে বলে মনে করছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, বৈষম্যবিরোধী অবস্থান থেকে সরকার নতুন কিছু করতে যাচ্ছে– এমন কিছু এখনও দৃশ্যমান নয়। গতানুগতিক বাজেটের চরিত্র হলো কর বাড়াতে পরোক্ষ করে বোঝা বাড়ানো। অথচ উচিত প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো। কিছু মানুষের বিত্ত-বৈভব দেশে অসাম্য তৈরি করছে। মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৮৫ শতাংশ সম্পদ চলে গেছে। সম্পদের কোন কোন অংশ করের আওতার বাইরে রয়ে গেছে, সেগুলো চিহ্নিত করে আওতায় আনা উচিত।
তিনি বলেন, এখন সরকারি যেসব আছে, তার ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া এবং অতিমূল্যায়িত। উচিত ছিল প্রকল্পগুলোকে এ, বি, সি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা। যেসব প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন আছে, সেগুলো বাদ দিতে হবে। যেসব প্রকল্পের কারণে রক্তক্ষরণ হতো, সেগুলো অব্যাহত আছে। সামাজিক সুরক্ষার যে ধরনের প্রকল্প প্রত্যাশিত, সেগুলো সেভাবে হচ্ছে না। কাঠামোগত পরিবর্তন কতটুকু হলো, বৈষম্যবিরোধী চরিত্রটা বদল হল কিনা, সেটিই দেখার বিষয়।
নানা সংকটের মধ্যেও বর্তমানে দেশের অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল আছে মন্তব্য করে ড.
তাঁর মতে, এখন কর্মসংস্থান দরকার। এ জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ দরকার। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকারীরা ছয় মাসের নীতি দেখে বিনিয়োগ করবেন না। তারা মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে নীতির স্থিতিশীলতা চান। নির্বাচনের পর এখনকার নীতিগুলো অব্যাহত থাকবে কিনা, তা বুঝতে চান। সরকার এখনকার বিনিয়োগ নীতি নিয়ে রাজনীতিবিদের সঙ্গে আলোচনা করলে ভালো হতো। কিন্তু অন্য বড় আলোচনার ফাঁকে অর্থনীতি হয়তো স্থান পায়নি। বিনিয়োগকারীরা নিশ্চয়তা পেলে হয়তো বিনিয়োগে উৎসাহিত হতো।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির কাজ নিয়ে কিছু প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, শ্বেতপত্র প্রণয়ন আগামী দিনের জন্য কোনো সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ছিল না। কাজটি ছিল অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিকে উত্তরাধিকার সূত্রে কী অবস্থায় পেয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করা। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির কিছু সুপারিশ সরকার বাস্তবায়ন করছে। কিছু সুপারিশ যেভাবে চাওয়া হয়েছিল, সেভাবে হয়নি।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির প্রতিযোগিতায় ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজকে পরাজিত করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা বিজয়ী হন। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিতার্কিকদের হাতে ট্রফি তুলে দেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন সরক র প রকল প প রণয়ন
এছাড়াও পড়ুন:
যেসব কারণে বাজেটের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতায় পিছিয়ে বাংলাদেশ
বাজেট শুধু সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব উপস্থাপন করে না। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক নীতি দলিল। বাজেট নিয়ে আলোচনায় প্রায়ই বরাদ্দের অগ্রাধিকার ও রাজস্ব পদক্ষেপের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয় অনেক সময় উপেক্ষিত থাকে।
বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা মূল্যায়নে ‘ওপেন বাজেট সার্ভে’ একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। এই জরিপে তিনটি মূল বিষয় মূল্যায়ন করা হয়। প্রথমটি হলো– বাজেটসংক্রান্ত তথ্য জনগণের জন্য কতটুকু উন্মুক্ত। দ্বিতীয়ত–বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনঅংশগ্রহণের সুযোগ কতটুকু রয়েছে। পার্লামেন্ট ও জাতীয় নিরীক্ষা কার্যালয়সহ তদারকি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা মূল্যায়ন করা আরেকটি উপাদান।
স্বচ্ছতা সূচকে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল মাত্র ১০০-এর মধ্যে ৩৭, যা ২০১২ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫৮। জনগণের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের স্কোর ২০২৩ সালে মাত্র ১১। তদারকিতে ছিল ৩৭। সব স্কোরই বৈশ্বিক গড়ের অনেক নিচে। ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কোরে কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবে অবনতির দিকে গেছে। যদিও ২০২৩ সালে সরকারের বাজেট প্রস্তাবনা বিস্তৃত ছিল, তবে জাতীয় সংসদে অনুমোদিত বাজেট এবং সিটিজেন বাজেট (যা সরকারের নির্বাহী বাজেট প্রস্তাবনার মৌলিক তথ্যগুলো সাধারণ নাগরিকদের কাছে সহজভাবে তথ্য উপস্থাপন করে) এখনও অনেক সীমিত। প্রাক-বাজেট বিবৃতি, বছর শেষের প্রতিবেদন এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদনের মতো অতিপ্রয়োজনীয় তথ্য উপাদান শুধু অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে সীমাবদ্ধ। এ ছাড়া বছরের মাঝে বাজেট বাস্তবায়নবিষয়ক রিপোর্ট দেরিতে প্রকাশ হয়। এতে করে এসব রিপোর্টের কার্যকারিতা কমে যায়। এ ছাড়া বছরের মধ্যভাগে কোনো পর্যালোচনা হয় না।
বাংলাদেশের বাজেট প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। বাজেট প্রণয়ন ও অনুমোদনের সময় অল্প কিছু মতামত নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন ও নিরীক্ষা পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত রয়েছে। ফলে ওপেন বাজেট সূচকের এই অংশে বাংলাদেশের স্কোর শূন্য। বাজেট তদারকিতেও বাংলাদেশের অবস্থা দুর্বল। বাজেটের পরিকল্পনা পর্যায়ে জাতীয় সংসদের ভূমিকা খুবই কম এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে তেমন কোনো নজরদারি করে না। এ প্রবণতা বিশেষভাবে প্রমাণ করে যে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও জবাবদিহির ক্ষেত্রগুলো ধীরে ধীরে অবনতি হয়েছে। গত এক দশকে বাজেট উন্মুক্ততায় যে বিপর্যয় ঘটেছে, তা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাজেটের স্বচ্ছতা এ জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বাজেট বাস্তবায়ন পর্যায়েও তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। প্রাক-বাজেট বিবৃতি এখনও প্রকাশ করা হয়নি। বছরের মধ্যভাগে এসে কোনো বাজেট প্রস্তুত করা হয়নি। গত সরকারের বাজেট বাস্তবতাবর্জিত হওয়া সত্ত্বেও তাতে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জানার জন্য প্রণীত শ্বেতপত্রে সময়মতো বাজেট সংশোধনের সুপারিশ থাকলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে।
বাজেটসংক্রান্ত তথ্য ও নথিপত্রের সহজলভ্যতা বাড়বে কিনা, তা এখনও অনিশ্চিত। বর্তমানে সংসদ কার্যকর নেই। ফলে সরকারের নির্বাহী বাজেট প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা বা পর্যালোচনার সুযোগ কম। তা ছাড়া বাজেট ঘোষণার পরপরই ঈদ উপলক্ষে ১০ দিনের সরকারি ছুটি এ প্রক্রিয়াকে আরও বাধাগ্রস্ত করবে।
বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে বেশি স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ততা প্রত্যাশিত ছিল। এখন পর্যন্ত তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়োজনে প্রাক-বাজেট আলোচনাগুলো স্বাভাবিকভাবে হলেও অর্থ বিভাগের আলোচনা সীমিত রাখা হয়। সরকারের বাইরে অন্যদের বাজেট সম্পর্কিত আলোচনায় মূল নীতিনির্ধারকরা অনেক ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হতে চাননি। রাজনৈতিক দলগুলোকেও বাজেট নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক, এখন পর্যন্ত বাজেটের স্বচ্ছতা, জনঅংশগ্রহণ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ আশানুরূপ নয়। আশা করা যায়, সামনে অন্ততপক্ষে এ বিষয়ে কিছু ইতিবাচক চেষ্টা দেখা যাবে।
লেখক: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, সিপিডি