Prothomalo:
2025-06-06@03:53:04 GMT

আমার পুডিং

Published: 4th, June 2025 GMT

ছবিটির কথা প্রায়ই মনে হয়। আমার তিন ভাইয়ের ছবি—ষাটের দশকে, বরিশালের কোনো এক ঈদের সকালে। তিন ভাই একই রকমের সফেদ-সাদা পাঞ্জাবি আর কালো চটি পরে সম্ভবত বাবার জন্য অপেক্ষা করছি ঈদের জামাতে যাওয়ার জন্য। কী নিষ্পাপ সুন্দর একটি ছবি। দেখে মনে পড়ে যায় আমাদের ছোটবেলার ঈদ উৎসবের স্মৃতি। 

খুব ভোরে উঠে যেতাম ঈদের দিন। চোখ বন্ধ রেখেই টের পেতাম, ঈদের কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে সারা বাড়িতে। দূর থেকে দুধ জ্বাল দেওয়ার মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসত। আহ্, সেমাই বানানো শুরু হয়ে গেছে। বাবা ঝট করে বাজার সেরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, টের পাচ্ছি। রহিমনবু সারা ঘর তাঁর ভাষায় ‘ধোয়া-পাখলা’ শুরু করে দিয়েছেন। আমার ঘরের সামনেটা মুছতে মুছতে বলতেন, ‘উইঠ্যা পড় বাজান। ঈদের দিন সক্কাল সক্কাল উঠলে নেকি অনেক বেশি।’ নেকির লোভে নয়, চারদিকে যত কিছু হচ্ছে, তার কিছুই যেন বাদ না যায়, তা নিশ্চিত করতে ঝট করে উঠে পড়তাম। উঠতে উঠতেই দেখতাম, রাতে কখন যেন মা খলিফা চাচার সেলাই করা নতুন কাপড় বালিশের পাশে রেখে দিয়েছেন। 

আসতেন নিরামিশাষী হরিশ কাকা, প্রচণ্ড আমিষী আসলাম ভাই, আসতেন অশ্বিনীদা, জহির চাচা আরও কতজন।

উঠেই রান্নাঘরে মায়ের কাছে—পুডিং হচ্ছে কি না, নিশ্চিত করতে। মা তখন সেমাই সামলাতে ব্যস্ত—আগুনের গনগনে আঁচে ফরসা মুখ তাঁর তেতে লাল। আমার প্রশ্নে রেগে গিয়ে বলতেন, ‘এ ছেলে তো পুডিং পুডিং করে পাগল হয়ে যাবে।’ বলেই হয়তো তাঁর খারাপ লাগত। গলাটা অদ্ভুত নরম করে মুচকি হেসে বলতেন, ‘হচ্ছে পুডিং। পাউরুটিও দিয়েছি তাতে একটু।’ আমাকে আর পায় কে? তিন লাফে বসার ঘরে—ওটা সাজানোর ভার আমার। দেখতাম, মধ্য টেবিলে রহম আলী ভাইয়ের সাজানো ফুলের তোড়া, তার পাশে বাবা আতরদানি নামিয়ে রেখেছেন।

বসার ঘর সাজানো শেষ করতে করতে শুনতাম, বাবা স্নানের তাড়া দিচ্ছেন। স্নান সেরে নতুন জামাকাপড়ে সজ্জিত হয়ে আমরা তিন ভাই তৈরি, তৈরি বাবাও। একটুকরো তুলোয় আতর লাগিয়ে কানের ভেতরে গুঁজে দিতেন বাবা, ঘষে দিতেন কবজিতেও। খাবার টেবিলে তখন গরম সেমাই, যার সোয়াদই অনন্য। তারপর ঈদগাহের দিকে রওনা হওয়া। আমরা বেরোনোর মুখে মা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেন। আমরা চারজন তাঁকে বলে যাত্রা শুরু করতাম। সে সময় এক অদ্ভুত তৃপ্তি তাঁর মুখে খেলা করত। 

পথে পথে চেনা-অচেনা কত লোক—সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর টুপিতে পরিবৃত। রঙিন পাঞ্জাবির চল তখনো শুরু হয়নি। শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পথচলা। চলতে চলতে চোখে পড়ত, তাদের বাবার হাত ধরে আমার বন্ধু নওশাদরা দুই ভাই চলছে। ওদের মুখে কোনো হাসি নেই। মনে পড়ত, গত বছরই আসমা খালা চলে গেছেন। ভাবতাম, আজ নওশাদরা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কেউ ওদের বিদায় জানায়নি। নামাজ শেষে ওরা যখন ফিরে যাবে, তখন মাকে ওরা সালাম করতে পারবে না। বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠত।

নামাজের সারিতে দাঁড়িয়ে যেতাম যথারীতি। আমার পাশে এসে দাঁড়াত আমার বন্ধু নাজিম। সিজদায় গিয়ে দেখতাম, নাজিম চোখ খোলা রেখে চারদিক হাতড়াচ্ছে। ‘বেশির ভাগ মানুষেরই নাকি সিজদার সময়ে পকেট থেকে পয়সা পড়ে যায়’—এ ‘নাজিম-তত্ত্বের’ সূত্র ধরে সে সিজদার সময় পয়সা খুঁজে বেড়াত। আমার এ মজার বন্ধুটি বহুকাল আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। নামাজ শেষে কোলাকুলি যেন শেষ হতেই চায় না। সেই সঙ্গে সবার বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ।

বাড়ি ফিরে এক আশ্চর্য বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করত। আমাদের সদ্যস্নাতা মা সুন্দর ঈদের শাড়ি পরে, হালকা প্রসাধন করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কী সুন্দর যে লাগত তাঁকে! তাঁকে সালাম করার সময় পদ্মর মতো তাঁর সুন্দর পা–টাই নজরে পড়ত আমার। সালাম শেষে আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে কিছু বলতেন—কী বলতেন, জানি না, কোনো আশীর্বাণীই হবে হয়তো। মনটা প্রশান্ত হয়ে যেত। ওই সালাম সেরেই ‘পথে এবার নামো সাথি’ বলে পাড়া বেড়ানো। বাড়ি-বাড়ি ঘোরা, ভালো-মন্দ খেয়ে পেট ভরানো, শেষে এমন হতো, অনেক সুখাদ্যও বাদ যেত। আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু বরিশালে ‘ঈদি’র প্রচলন দেখিনি। 

সারা দিনে কত মানুষ যে আসত। বাবার সহকর্মীরা, বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা, আমার বন্ধুবান্ধব। আসতেন নিরামিশাষী হরিশ কাকা, প্রচণ্ড আমিষী আসলাম ভাই, আসতেন অশ্বিনীদা, জহির চাচা আরও কতজন। তবে একজন মানুষের খাবার সময় শত কাজের মধ্যেও মা পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলতেন, খাবার তদারকি করতেন। তিনি নারানদা (নারায়ণ ধাঙড়)—সারা কলেজ, সারা পাড়ার সব রকমের ময়লা-জঞ্জাল সাফ করতেন। ভারি সুপুরুষ ছিলেন নারানদা—মেহগনির মতো কুচকুচে গায়ের রং, পেটানো শরীর, রামকিঙ্করীয় চুল আর আশুতোষ মার্কা গোঁফে তাঁকে এক দেবপুরুষ মনে হতো আমার। সুন্দর ধুতি, রঙিন ফতুয়ায় সজ্জিত মাদুরে আসন পেতে খেতেন তিনি। খাওয়া শেষে গড় হয়ে মাকে প্রণাম করতেন নারানদা। মা তাঁর হাতে একপ্রস্থ কাপড় তুলে দিতেন। মাথা পেতে নিতেন তিনি। তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি যে, মা নারানদাকে ভিন্নভাবে সমাদর করতেন, যাতে তাঁর কিছুতেই মনে না হয় যে, তিনি আলাদা।

তারপর একসময় রাত নেমে আসত। মা-বাবা সেজেগুজে পাড়ায় ঈদ-বেড়ানোতে বেরোতেন। কী যে সুন্দর লাগত দুজনকে। বাবার হাতে জোরালো টর্চ, মায়ের হাতে নকশা করা থলে। আমাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে। খাব কী? সারা দিনের বড় রকমের খাবারদাবারের জের তখনো চলছে। সেই সঙ্গে সারা দিনের টইটই করে ঘোরার ক্লান্তি। ঘুমে চোখ বুজে আসত। বালিশে মাথা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের আচ্ছন্নতায় মনে পড়ে যেত, হায় হায়, সারা দিনের উত্তেজনায় পুডিংটাই তো খাওয়া হয়নি। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে অস্ফুট স্বরে বলতাম আমি, ‘আমার পুডিং.

..!’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র প ন র নদ আম দ র স ন দর র জন য র বন ধ র সময় করত ন আসত ন বলত ন

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট, ধীর গতি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী থেকে মির্জাপুরের গোড়াই পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। আজ শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত মহাসড়কটিতে এই অবস্থা দেখা গেছে। ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কেও ধীর গতিতে চলছে যানবাহন। মহাসড়ক দুটিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ঈদে ঘরমুখো মানুষ।

প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করতে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর থেকে বাড়ি ফিরছেন কর্মজীবীরা। ফলে মহাসড়কগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন চলাচল করছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রাতে বেশ কয়েকটি স্থানে যানবাহন বিকল হয়ে মহাসড়কের দুইদিকে যানজটের সৃষ্টি হয়।

পুলিশ, যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, গাজীপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দুটিতে যানবাহনের চাপ থাকায় থেমে থেমে যানজট তৈরি হয়েছে। এতে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রী, চালক ও সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘ ভোগান্তি এড়াতে অনেকেই পায়ে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের গাড়ি ধরতে চাইছেন। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী থেকে মির্জাপুরের গোড়াই পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা ধীরে ধীরে চলাচল করছে যানবাহন।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, গতকাল শিল্পাঞ্চলগুলোর পোশাক কারখানায় ছুটি হওয়ায় লাখো মানুষ একই সঙ্গে নিজেদের গন্তব্যে যাত্রা করেন। এ ছাড়া মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যানবাহনের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এতে রাতভর মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট তৈরি হয়। ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষদের দীর্ঘসময় যানবাহনে বসে থাকতে হচ্ছে। গরম ও যানজটে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েন শিশু, নারী ও বয়োজ্যেষ্ঠরা।

আজ সকাল থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বোর্ডবাজার থেকে সালনা ৫ কিলোমিটার এলাকায় যানজট তৈরি হয়েছে। এসব এলাকায় থেমে থেমে চলছে গাড়ি। এর মধ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক যানবাহন না পেয়ে পেয়ে অনেকেই বিভিন্ন যানবাহনের খোলা ছাদ, ট্রাক ও পিকআপে করেই গন্তব্যে উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন। সুযোগ বুঝে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

রাজশাহী যাওয়ার উদ্দেশে চন্দ্রা থেকে আলম এন্টারপ্রাইজ পরিবহনের একই বাসে উঠেন আকবর আলী। যানজটে আটকে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কষ্ট করছি। কখন যানজট শেষ হয় কে জানে? রাস্তায় কোনো পুলিশও দেখছি না।’

রাজধানীর মহাখালী থেকে ৫ ঘণ্টা আগে রওনা হয়ে আস সকাল ৯টার দিকে গাজীপুরে চন্দ্রা এলাকায় আটকে ছিলেন জেঁকে পরিবহনের বাসচালক ময়নাল হোসেন। তিনি বলেন, চন্দ্রার আগে এসে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক বয়স্ক ও শিশু যাত্রী আছে, তাঁরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন নাওজোর হাইওয়ে পুলিশের (ওসি) সওগাতুল আলম। তিনি জানান, সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি যানবাহনের গতি সচল রাখতে হাইওয়ে পুলিশ সদস্যরা সর্বোচ্চ সচেষ্ট আছেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্যাসেঞ্জার তোলায় মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়ে। যানবাহনের চাপ ও রাতে কয়েকটি স্থানে পরিবহন বিকল হওয়ায় এই যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ