Prothomalo:
2025-09-18@03:35:19 GMT

আমার পুডিং

Published: 4th, June 2025 GMT

ছবিটির কথা প্রায়ই মনে হয়। আমার তিন ভাইয়ের ছবি—ষাটের দশকে, বরিশালের কোনো এক ঈদের সকালে। তিন ভাই একই রকমের সফেদ-সাদা পাঞ্জাবি আর কালো চটি পরে সম্ভবত বাবার জন্য অপেক্ষা করছি ঈদের জামাতে যাওয়ার জন্য। কী নিষ্পাপ সুন্দর একটি ছবি। দেখে মনে পড়ে যায় আমাদের ছোটবেলার ঈদ উৎসবের স্মৃতি। 

খুব ভোরে উঠে যেতাম ঈদের দিন। চোখ বন্ধ রেখেই টের পেতাম, ঈদের কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে সারা বাড়িতে। দূর থেকে দুধ জ্বাল দেওয়ার মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসত। আহ্, সেমাই বানানো শুরু হয়ে গেছে। বাবা ঝট করে বাজার সেরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, টের পাচ্ছি। রহিমনবু সারা ঘর তাঁর ভাষায় ‘ধোয়া-পাখলা’ শুরু করে দিয়েছেন। আমার ঘরের সামনেটা মুছতে মুছতে বলতেন, ‘উইঠ্যা পড় বাজান। ঈদের দিন সক্কাল সক্কাল উঠলে নেকি অনেক বেশি।’ নেকির লোভে নয়, চারদিকে যত কিছু হচ্ছে, তার কিছুই যেন বাদ না যায়, তা নিশ্চিত করতে ঝট করে উঠে পড়তাম। উঠতে উঠতেই দেখতাম, রাতে কখন যেন মা খলিফা চাচার সেলাই করা নতুন কাপড় বালিশের পাশে রেখে দিয়েছেন। 

আসতেন নিরামিশাষী হরিশ কাকা, প্রচণ্ড আমিষী আসলাম ভাই, আসতেন অশ্বিনীদা, জহির চাচা আরও কতজন।

উঠেই রান্নাঘরে মায়ের কাছে—পুডিং হচ্ছে কি না, নিশ্চিত করতে। মা তখন সেমাই সামলাতে ব্যস্ত—আগুনের গনগনে আঁচে ফরসা মুখ তাঁর তেতে লাল। আমার প্রশ্নে রেগে গিয়ে বলতেন, ‘এ ছেলে তো পুডিং পুডিং করে পাগল হয়ে যাবে।’ বলেই হয়তো তাঁর খারাপ লাগত। গলাটা অদ্ভুত নরম করে মুচকি হেসে বলতেন, ‘হচ্ছে পুডিং। পাউরুটিও দিয়েছি তাতে একটু।’ আমাকে আর পায় কে? তিন লাফে বসার ঘরে—ওটা সাজানোর ভার আমার। দেখতাম, মধ্য টেবিলে রহম আলী ভাইয়ের সাজানো ফুলের তোড়া, তার পাশে বাবা আতরদানি নামিয়ে রেখেছেন।

বসার ঘর সাজানো শেষ করতে করতে শুনতাম, বাবা স্নানের তাড়া দিচ্ছেন। স্নান সেরে নতুন জামাকাপড়ে সজ্জিত হয়ে আমরা তিন ভাই তৈরি, তৈরি বাবাও। একটুকরো তুলোয় আতর লাগিয়ে কানের ভেতরে গুঁজে দিতেন বাবা, ঘষে দিতেন কবজিতেও। খাবার টেবিলে তখন গরম সেমাই, যার সোয়াদই অনন্য। তারপর ঈদগাহের দিকে রওনা হওয়া। আমরা বেরোনোর মুখে মা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেন। আমরা চারজন তাঁকে বলে যাত্রা শুরু করতাম। সে সময় এক অদ্ভুত তৃপ্তি তাঁর মুখে খেলা করত। 

পথে পথে চেনা-অচেনা কত লোক—সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর টুপিতে পরিবৃত। রঙিন পাঞ্জাবির চল তখনো শুরু হয়নি। শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পথচলা। চলতে চলতে চোখে পড়ত, তাদের বাবার হাত ধরে আমার বন্ধু নওশাদরা দুই ভাই চলছে। ওদের মুখে কোনো হাসি নেই। মনে পড়ত, গত বছরই আসমা খালা চলে গেছেন। ভাবতাম, আজ নওশাদরা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কেউ ওদের বিদায় জানায়নি। নামাজ শেষে ওরা যখন ফিরে যাবে, তখন মাকে ওরা সালাম করতে পারবে না। বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠত।

নামাজের সারিতে দাঁড়িয়ে যেতাম যথারীতি। আমার পাশে এসে দাঁড়াত আমার বন্ধু নাজিম। সিজদায় গিয়ে দেখতাম, নাজিম চোখ খোলা রেখে চারদিক হাতড়াচ্ছে। ‘বেশির ভাগ মানুষেরই নাকি সিজদার সময়ে পকেট থেকে পয়সা পড়ে যায়’—এ ‘নাজিম-তত্ত্বের’ সূত্র ধরে সে সিজদার সময় পয়সা খুঁজে বেড়াত। আমার এ মজার বন্ধুটি বহুকাল আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। নামাজ শেষে কোলাকুলি যেন শেষ হতেই চায় না। সেই সঙ্গে সবার বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ।

বাড়ি ফিরে এক আশ্চর্য বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করত। আমাদের সদ্যস্নাতা মা সুন্দর ঈদের শাড়ি পরে, হালকা প্রসাধন করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কী সুন্দর যে লাগত তাঁকে! তাঁকে সালাম করার সময় পদ্মর মতো তাঁর সুন্দর পা–টাই নজরে পড়ত আমার। সালাম শেষে আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে কিছু বলতেন—কী বলতেন, জানি না, কোনো আশীর্বাণীই হবে হয়তো। মনটা প্রশান্ত হয়ে যেত। ওই সালাম সেরেই ‘পথে এবার নামো সাথি’ বলে পাড়া বেড়ানো। বাড়ি-বাড়ি ঘোরা, ভালো-মন্দ খেয়ে পেট ভরানো, শেষে এমন হতো, অনেক সুখাদ্যও বাদ যেত। আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু বরিশালে ‘ঈদি’র প্রচলন দেখিনি। 

সারা দিনে কত মানুষ যে আসত। বাবার সহকর্মীরা, বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা, আমার বন্ধুবান্ধব। আসতেন নিরামিশাষী হরিশ কাকা, প্রচণ্ড আমিষী আসলাম ভাই, আসতেন অশ্বিনীদা, জহির চাচা আরও কতজন। তবে একজন মানুষের খাবার সময় শত কাজের মধ্যেও মা পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলতেন, খাবার তদারকি করতেন। তিনি নারানদা (নারায়ণ ধাঙড়)—সারা কলেজ, সারা পাড়ার সব রকমের ময়লা-জঞ্জাল সাফ করতেন। ভারি সুপুরুষ ছিলেন নারানদা—মেহগনির মতো কুচকুচে গায়ের রং, পেটানো শরীর, রামকিঙ্করীয় চুল আর আশুতোষ মার্কা গোঁফে তাঁকে এক দেবপুরুষ মনে হতো আমার। সুন্দর ধুতি, রঙিন ফতুয়ায় সজ্জিত মাদুরে আসন পেতে খেতেন তিনি। খাওয়া শেষে গড় হয়ে মাকে প্রণাম করতেন নারানদা। মা তাঁর হাতে একপ্রস্থ কাপড় তুলে দিতেন। মাথা পেতে নিতেন তিনি। তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি যে, মা নারানদাকে ভিন্নভাবে সমাদর করতেন, যাতে তাঁর কিছুতেই মনে না হয় যে, তিনি আলাদা।

তারপর একসময় রাত নেমে আসত। মা-বাবা সেজেগুজে পাড়ায় ঈদ-বেড়ানোতে বেরোতেন। কী যে সুন্দর লাগত দুজনকে। বাবার হাতে জোরালো টর্চ, মায়ের হাতে নকশা করা থলে। আমাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে। খাব কী? সারা দিনের বড় রকমের খাবারদাবারের জের তখনো চলছে। সেই সঙ্গে সারা দিনের টইটই করে ঘোরার ক্লান্তি। ঘুমে চোখ বুজে আসত। বালিশে মাথা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের আচ্ছন্নতায় মনে পড়ে যেত, হায় হায়, সারা দিনের উত্তেজনায় পুডিংটাই তো খাওয়া হয়নি। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে অস্ফুট স্বরে বলতাম আমি, ‘আমার পুডিং.

..!’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র প ন র নদ আম দ র স ন দর র জন য র বন ধ র সময় করত ন আসত ন বলত ন

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ