দাম নিয়ে মনোপলি খেলা, রাস্তায় চামড়া ফেলে ক্ষোভ প্রকাশ
Published: 8th, June 2025 GMT
রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ও লবণের দাম কম থাকায় এবার আড়তে ভালো দাম পাওয়ার আশা ছিল মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের। দিনভর চামড়া সংগ্রহের পর তা নিয়ে আড়তে যান তারা। কিন্তু আড়তদাররা হতাশ করেছে তাদের। দেননি ন্যায্য দাম। হতাশা ও ক্ষোভে অনেকে তাই রাস্তার ওপরে ছুড়ে ফেলেছেন চামড়া। তবে আড়তদাররা দোষ চাপাচ্ছেন ট্যানারি মালিকদের ওপর। তারা বলছেন, ট্যানারি মালিকরা কম দাম দেওয়ায় বেশি দামে কিনতে পারছেন না চামড়া।
এমন দোষাদোষীর মধ্যেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন রাস্তায় পড়ে থাকা চামড়া ট্রাকে করে সড়ক থেকে তুলে নিয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে এ বছর ৪ লাখ কোরবানি পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলেন আড়তদাররা।
শনিবার (৭ জুন) সকাল থেকে কোরবানির পর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করতে শুরু করেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। দুপুরের পর থেকে তারা সংগ্রহ চামড়া নিয়ে যান নগরীর আতুরার ডিপো এলাকার চামড়ার আড়তে। কিন্তু সেখানে ৭০০-৮০০ টাকা দিয়ে কেনা চামড়ার অর্ধেক দামও দেয়নি আড়তদাররা। চামড়া সংরক্ষণ করা কঠিন হওয়ায় অনেকে লোকসানে তা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এতে করে ফের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
নগরীর আগ্রাবাদের চৌমুহনী এলাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকে চামড়া সংগ্রহ করে জড়ো করে থাকেন। সন্ধ্যার পর তারা তা নিয়ে যান আড়তে। প্রতি বছর কোরবানির ঈদে তাই জমজমাট হয়ে উঠে এই এলাকা। গত কয়েক বছর এ চিত্রে কিছুটা ভাটা থাকলেও এবার দিনভর বেশ জমজমাট ছিল এই এলাকা। কিন্তু আজ রোববার থেকে সেখানে সুনসান নিরবতা। ক্ষুদ্ধ ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ সেখানে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেন।
মৌসুমি ব্যবসায়ী সেকান্দর হোসেন বলেন, ৭০০-৮০০ টাকায় কেনা চামড়াও আড়তদারেরা প্রতিটি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার বেশি দামে কিনতে চাইছেন না। তাদের কাছে জিন্মি হয়ে আছি আমরা।
তবে দ্বিমত পোষণ করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো.
তিনি আরও বলেন, একটি ২০ ফুটের চামড়ায় প্রায় ৫০০ টাকা খরচ পড়ে। এর মধ্যে প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন খরচ, আড়তের খরচ সবকিছু অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া ট্যানারি মালিকেরা প্রতিটি চামড়ায় ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে দেন। এতে করে আড়তদারেরাও খুব বেশি লাভ করতে পারেন না।
এ বছর কোরবানির পশুর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে ৫ টাকা বাড়িয়ে প্রতি বর্গফুট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। আর ঢাকার বাইরের চামড়ার দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে প্রতি বর্গফুট ৫৫ থেকে ৬০ টাকা করা হয়েছে। একই সঙ্গে খাসি ও বকরির চামড়ার দাম ২ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
আড়তদাররা জানান, ট্যানারিতে বিক্রির সময় ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে প্রতি ফুটে ৫৫-৬০ টাকা পড়ে না। এছাড়া চামড়ার মানেও পার্থক্য থাকায় দামের হেরফের হয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস য় আড়তদ র স গ রহ ক রব ন
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রামে চামড়া কিনে বিপাকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা, দাম পাচ্ছেন না
ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ বেলাল দুই দশক ধরে চামড়ার ব্যবসা করেন। তবে স্থায়ী ব্যবসায়ী তিনি নন, ঈদের দিনই চলে তাঁর বিক্রিবাট্টা। গত বছর চামড়া বেঁচে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছিলেন তিনি। তাই এ বছর বেশি চামড়া কেনেননি। বড়-ছোট মিলিয়ে শ খানেক চামড়া কিনেছেন। কেনা পড়েছে গড়ে ৪৫০ টাকা।
আজ শনিবার বিকেল চারটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদের চৌমুহনী এলাকায় গিয়ে মোহাম্মদ বেলালের সঙ্গে দেখা হয়। চামড়ার পাশে চেয়ার পেতে বসে ছিলেন তিনি। দরদাম কেমন, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আড়তদারেরা প্রতিটি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় কিনতে চাইছে। এখনো বিক্রি করছি না। তবে পাঁচটার আগেই বিক্রি করব।’
মোহাম্মদ বেলাল পেশায় ফল ব্যবসায়ী। থাকেন নগরের মিস্ত্রিপাড়ায়। গতবার লোকসানের পরও এবার কেন ব্যবসায় ফিরেছেন, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল মোহাম্মদ বেলালের কাছে। তিনি বলেন, অনেক দিন ধরেই চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি। ঈদের দিন সকাল থেকে চামড়া সংগ্রহ করা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ কারণে এটি ছাড়তে পারছেন না। তবে আশা করেছিলেন রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় এবার দাম পাবেন। কিন্তু আড়তদারেরা দাম কম বলছেন।
ঈদের দিন বেলা ১১টা থেকেই চৌমুহনী এলাকাটি জমজমাট হয়ে ওঠে। মোহাম্মদ বেলালের মতো শতাধিক মৌসুমি বিক্রেতা চামড়া নিয়ে জড়ো হন এ এলাকায়। সড়কের ওপর চামড়া রেখে তাঁরা আড়তদার ও তাঁদের প্রতিনিধির জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। নতুন ও পুরোনো মৌসুমি বিক্রেতারা চামড়া নিয়ে ভিড় করেছেন। এ রকম ১৫ জন বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেছেন, আড়তদারেরা দাম দিচ্ছেন না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরু ও মহিষের কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অর্থাৎ সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিটি ১ হাজার ১৫০ টাকা।
আরেক মৌসুমি ব্যবসায়ী মনজু মিয়া এবার ২২টি বড় আকারের চামড়া কিনেছেন। তাঁর কেনা ৬০০ টাকা। তবে আড়তের প্রতিনিধিরা ৪০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছেন। দামের বিষয়টি উল্লেখ করে মনজু মিয়া বলেন, টেলিভিশনে দেখেছি দাম এবার ১ হাজার ১০০ টাকার মতো। ভেবেছিলাম অন্তত ৮০০ টাকা পাব। লাভ হবে। কিন্তু পরিস্থিতি ভালো নয়। লোকসান গুনতে হবে। মোহাম্মদ ফাহিম নামের আরেক বিক্রেতা দাবি করেন, তাঁর ৪০০ টাকা কেনা পড়েছে। ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে।
রাইড শেয়ার করে সংসার চলে মোহাম্মদ সুজনের। আজ ঈদের দিন কিছু বাড়তি টাকা আয় করতে তিনি ৫০টি চামড়া কেনেন। কেনা পড়েছে গড়ে ৪৫০ টাকা। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই চামড়া বিক্রি হয়নি।
আড়তদারেরা কী বলছেন
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ১ হাজার ১৫০ টাকা। একটি ২০ ফুটের চামড়ায় প্রায় ৫০০ টাকা খরচ পড়ে। এর মধ্যে প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন খরচ, আড়তের খরচ—সবই অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া ট্যানারিমালিকেরা প্রতি চামড়ায় ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে দেন।
মুসলিম উদ্দিন বলেন, লবণ ছাড়া চামড়া বেশি দামে কেনার সুযোগ নেই। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ছাড়া এবার চামড়ার দাম এখনো পর্যন্ত ভালো পাওয়া যাচ্ছে। ৬০০-৭০০ টাকাও দাম উঠেছে।
আড়তদারেরা বলছেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ লবণযুক্ত চামড়ার দামের সঙ্গে কাঁচা চামড়ার দাম গুলিয়ে ফেলেন। এতে অনেক সময় তাঁরা বেশি দামে চামড়া কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এবারও সেটা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবার সমবায় সমিতির আওতায় ২৫ জন আড়তদার চামড়া সংগ্রহে অংশ নিচ্ছেন। এ ছাড়া আরও ৩০-৩৫ জন আড়তদার আছেন, যাঁরা নিজ উদ্যোগে চামড়া কিনে থাকেন। সমিতির তথ্য অনুযায়ী, আগে এই সংখ্যা ছিল ১১২। ২০১৯ সালের পর ট্যানারিমালিকদের কাছে বকেয়া পাওনা পরিশোধ না হওয়ায় অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দেন। বর্তমানে সক্রিয় আড়তদারের সংখ্যা কমে এসেছে।
সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মৌসুমি বিক্রেতাদের তাঁরা বারবার সতর্ক করেছেন। মূলত সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। বিক্রেতারা সেটি গুলিয়ে ফেলেছেন।
চট্টগ্রামে রিফ লেদার নামের একটিমাত্র ট্যানারি থাকলেও বেশির ভাগ চামড়া ঢাকার ট্যানারিগুলোতেই যায়। ঈদের পর ঢাকার ট্যানারিমালিকেরা এসে চামড়া কিনে নিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন আড়তদারেরা।
এবার চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ চার লাখ গরু ও মহিষের চামড়া সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ ছাড়া ছাগলসহ অন্যান্য পশুর কিছু চামড়াও হয়। তবে সেগুলোর দাম একেবারে নগণ্য। কিছু চামড়া উপজেলা পর্যায়ে লবণ দিয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ চামড়া চলে আসে নগরের আতুরার ডিপোর আড়তে। এ ছাড়া গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশও কিছু চামড়া সংগ্রহ করে।