আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে তুমুল বিতর্ক। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এরই মধ্যে আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে ভোটের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির পাশাপাশি কেউ কেউ ওই সময়ে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদীয় রাজনীতিতে নির্বাচনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সংসদে আস্থা ভোটে হেরে গেলে প্রধানমন্ত্রীকে যে কোনো সময়ে নতুন করে সাধারণ নির্বাচন দিতে হয়। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ইতোমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হয়েছে। এ ব্যবস্থায় নতুন সংসদ গঠনের পর পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ভোট হবে। সে হিসাবে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের সময় কমপক্ষে তিন মাস পিছিয়ে যাবে। এতে যে কোনো মাসেই ভোটের তারিখ পড়তে পারে। সে হিসাবে এবার ডিসেম্বরে ভোট হলে পরের সংসদ নির্বাচন হবে এপ্রিলেই। বিএনপিসহ সমমনারা নির্বাচনের দিনক্ষণ আরও এগিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপিসহ ইসলামপন্থি দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে। তাদের দাবি, বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কতটুকু সক্ষম, তা আগে যাচাই করতে হবে।
এপ্রিলে ভোটের নজির নেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর আগে অনুষ্ঠিত ১২ সংসদ নির্বাচনের কোনোটিই এপ্রিলে হয়নি। সর্বোচ্চ তিনটি নির্বাচন হয় ফেব্রুয়ারিতে; জানুয়ারি, মার্চ ও ডিসেম্বরে হয়েছে দুটি করে নির্বাচন। আর মে, জুন ও অক্টোবর হয়েছে একটি করে নির্বাচন।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন দেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালের ৭ মে। চতুর্থ সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ।
এরপর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। পঞ্চম সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। একই বছর ১২ জুন হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর হয় অষ্টম সংসদ ও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এটি সর্বশেষ ভোট। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে শেখ হাসিনা তথ্য সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান চালু করেন। এই দলীয় সরকারের অধীনে পরপর তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ এবং সর্বশেষ গত বছর ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড.
এপ্রিলের আবহাওয়া যেমন থাকে?
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্ববর্তী উপাত্ত এবং চলতি বছরের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করছেন, আগামী বছরের এপ্রিলেও হতে পারে রেকর্ডভাঙা গরমের মাস। থাকতে পারে ঝড়বৃষ্টি-ঘূর্ণিঝড়ও।
আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এপ্রিল শুধু বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম মাসই নয়, এটি আবহাওয়াগতভাবে সবচেয়ে অস্থিতিশীলও। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ, বজ্রসহ বৃষ্টি, কালবৈশাখী– সব মিলিয়ে এই মাসে প্রকৃতি প্রায়ই আগ্রাসী থাকে। যদিও আশার খবর হচ্ছে, চলতি বছরের এপ্রিল ছিল অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। গত এপ্রিলে ৯ দিন কালবৈশাখী হয়েছে, বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য কম ছিল। তবে এর আগের বছরই এপ্রিল-মে মাসে দেশ টানা ৩৫ দিন তাপপ্রবাহের মধ্যে ছিল। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের গরম এবং ওই সময় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।
আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, তাপমাত্রার রেকর্ড যা-ই হোক, অনুভূত তাপমাত্রা তার চেয়ে গড়ে ৬ ডিগ্রি বেশি থাকে এপ্রিলে। এর প্রধান কারণ, এপ্রিলে সূর্য কিরণের স্থায়িত্ব বেশি এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ থাকে প্রায় ৭৫ শতাংশ। তিনি বলেন, ২০২৬ সালের এপ্রিল-মে মাসে যদি পশ্চিমা লঘুচাপ ঠিকঠাক তৈরি হয়, তাহলে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়বে। না হলে গরম আরও ভয়াবহ হতে পারে।
এপ্রিল বজ্রপাতের দিক থেকেও ভয়াবহ। প্রতিবছর এই মাসে গড়ে সাড়ে ছয় লাখ বজ্রপাত হয় এবং গড়ে ১৬ জন মারা যান। বজ্রঝড় ও কালবৈশাখীর পাশাপাশি গড় বৃষ্টিও থাকে উল্ল্যেখযোগ্য– সিলেটে গড়ে ১৬ দিন আর ঢাকায় ১২ দিন বৃষ্টি হয় এপ্রিলে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, পরিবেশের উষ্ণতা বিশ্বজুড়েই বাড়ছে। সে জন্য গত বছরের মতো অস্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তাপপ্রবাহের ধরনও বদলে গেছে– আগে মার্চে শুরু হতো, এখন এপ্রিলেই শুরু হয় এবং দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়। তিনি জানান, আগামী বছরও এপ্রিলে তাপমাত্রা বেশি থাকার প্রবণতা রয়েছে। তবে এত আগে নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন, কারণ জলবায়ুগত পরিবর্তন একে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এপ্রিলে ভোট হলেও তাদের সমস্যা নেই। নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি চলমান। সব কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার জন্য ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ব্যালট বাক্স, সিল, প্যাড এবং অমোচনীয় কালি সংগ্রহের কাজ চলছে। ইউএনডিপির পক্ষ থেকে নির্বাচনী সরঞ্জাম সরবরাহের আশ্বাস মিলেছে। যদিও তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি এখনও হয়নি। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এপ্রিলের প্রথমার্ধে ভোটের পরিকল্পনার কথা জানানো হলেও দেশবাসীর মতো তারাও অপেক্ষা করছে লন্ডনের বৈঠকের জন্য। সেখান থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনের নতুন দিনক্ষণ নির্ধারণ হলে তখন পুরোদমে প্রস্তুতি শুরু করা যাবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল রাতে নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ সমকালকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ হয়নি। আগামী রোববার হয়তো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে অন্য কমিশনারদের বৈঠক হবে। তারপর হয়তো নির্বাচনের বিষয়ে একটি ধারণা দেওয়া যাবে। তিনি বলেন, নির্বাচন প্রস্তুতির রুটিনওয়ার্ক থেমে নেই।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রস ত ত ড স ম বর র জন ত ক ব যবস থ র জন য প রথম বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
আমাদের যত ঘুঘু
মনিরা হাঁসের (বৈকাল টিল) সন্ধানে ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহীর পদ্মা নদীতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বটতলা ঘাট থেকে ছেড়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় আধঘণ্টায় সিমলা পার্কের উল্টো পাশের চরের কাছে আসতেই একটি ঘুঘুকে পাড়ে বসে থাকতে দেখলাম। দ্রুত একটি ছবি তুলে ওটির পরিচয় নিশ্চিত হলাম। এই দুল৴ভ পাখিটি প্রথম দেখি ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ কুয়াশাভরা সকালে হবিগঞ্জের কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে। এরপর ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি সুন্দরবনের করমজলে।
পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর কাছ থেকে ভালো ছবি তোলার আশায় ধীরে ধীরে নৌকা পাখিটির কাছাকাছি নিতে থাকি। তবে নৌকা যতই কাছে যাক না কেন, সেটি কিন্তু অবিচল—একটুও নড়ছে না, চুপচাপ বসে আছে। কৌতূহলবশত নৌকা থেকে পাড়ে নামলাম, পাখিটির একদম কাছে চলে গেলাম। এরপর সেটি ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করল। আমরাও পিছু নিলাম। কিছুক্ষণ পর অনেকটা অনিচ্ছায় উড়াল দিল পাখিটি।
ঘুঘু পাখি কবুতরের মতো একই গোত্র কোলাম্বিডির (কপোত) সদস্য। ঘুঘুর দেহ কবুতরের মতোই তুলনামূলক ভারী, মাথা ছোট, চঞ্চু ও পা খাটো। ওড়ার পেশি শক্তিশালী। তাই দ্রুত ও দীর্ঘক্ষণ উড়তে সক্ষম। লেজ হাতপাখার মতো বিস্তৃত। তবে আকারে কবুতরের চেয়ে ছোট হয়। এরাও স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষ পিত্তথলিতে উৎপন্ন ক্ষীরের মতো অর্ধতরল দুধ খাইয়ে ছানাগুলোকে বড় করে তোলে, যা ‘পায়রা বা ঘুঘুর দুধ’ নামে পরিচিত। এদেশে এই গোত্রের যে ১৮টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১০টি কবুতর ও ৮টি ঘুঘু রয়েছে। প্রায় অর্ধেকের বেশি প্রজাতি সারা বছর প্রজনন করে। আয়ুষ্কাল চার থেকে ছয় বছর। এখানে এ পাখির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।
রামঘুঘু (ওরিয়েন্টাল টার্টল ডাব): ফিচারের শুরুতে লালচে বাদামি বর্ণের যে ঘুঘুর গল্প বললাম, সেটি এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি রাম, কইতর বা গোলাপ ঘুঘু। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে এর দেখা মেলে। প্রাপ্তবয়স্ক ঘুঘুর দেহের দৈর্ঘ্য ৩৩ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৬৫ থেকে ২৭৪ গ্রাম।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় উড়ন্ত ধবল ঘুঘু