পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমের সাম্প্রতিক তর্ক দেখলেই বারবার আহমদ ছফার কথা মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কপটতা নিয়ে তাঁর মতো এত তীক্ষ্ণ ও পরিচ্ছন্ন ভাষায় কেউ লিখেছেন বলে মনে হয় না। এ কারণে তাঁর ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রবন্ধটি ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। এই প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরও বুদ্ধিজীবীদের ভাষা ও চিন্তাভাবনা একই পাটাতনে রয়ে গেছে, যা প্রতিদিন বিভিন্ন মাধ্যমে উদোম হয়ে পড়ছে। এ কারণে গণঅভ্যুত্থানের পরও প্রধান জিজ্ঞাসা– বুদ্ধিজীবীরা আদৌ কি পরিবর্তন চান?

স্বাধীনতার পর দেশে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার প্রধান পথ ছিল অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম। এই পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা এ দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির হর্তাকর্তা। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাষ্ট্রভাবনায় সাধারণ মানুষ একেবারেই গরহাজির, যেখানে তারা শুধু ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত বলয়গুলো শক্তিশালী করেছে। সুতরাং এই সাজানো-গোছানো বাগান সংস্কার হলে প্রথমেই আঘাতটা লাগে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোতে, যার সঙ্গে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্পর্ক ওতপ্রোত। এ কারণে তাদের কাছে সংস্কারের পথ মানেই শঙ্কার! 

বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর রাজনীতিতে প্রধান শক্তি গোষ্ঠীগত বলয়। কেন্দ্রে কিংবা প্রান্তে গুটিকয়েক পরিবারই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড.

মির্জা এম. হাসান সমকালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও ঘুরেফিরে পারিবারিক প্রভাবাধীন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ যেমন শেখ পরিবার ছাড়া চলতে চায় না, তেমনি বিএনপিও জিয়া পরিবার ছাড়া চলতে চায় না।’ প্রশ্নটি আরও সরলভাবে তোলা যায়; বিএনপি আসলে আওয়ামী লীগ থেকে কতটা আলাদা? 
ঐতিহাসিক কারণে দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ উল্লেখযোগ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে; কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দলটি যে নেতিবাচক ধারার সূচনা করেছিল, পরবর্তী সময়ে গঠিত সব ক’টি দল একই পথে হেঁটেছে। নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসন উৎখাতের পর একটা ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সেটাও ক্ষমতা কাঠামোর বলয়গুলো কাজে লাগাতে দেয়নি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান জাতির সামনে আরেকটি সুযোগ এনে দিয়েছে; কিন্তু ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত পুরো বন্দোবস্ত সেই সম্ভাবনা থামিয়ে দিতে চায়। 

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে ভ্রান্তভাবেই দেশ নিয়ে বড় ধরনের আশা জেগেছিল। তারা মনে করেছিল, বড় দল হিসেবে বিএনপি তরুণদের সঙ্গে নিয়ে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটবে। কিন্তু পরক্ষণেই বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর পুরোনো চেহারা উদোম হয়ে পড়ে। যখনই তরুণরা নতুনভাবে রাজনীতিতে শরিক হয়েছে, তখনই পুরো কাঠামো বিদ্যমান ব্যবস্থা জারি রাখতে নানা রকম যুক্তি নিয়ে সামনে আসে। যে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটেছিল, বিএনপিসহ তার সঙ্গে যুক্ত বলয়গুলো আজ সেই বন্দোবস্ত কায়েম রাখতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানেই প্রশ্নটা আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ থেকে কতটা আলাদা?

বিএনপিও কিন্তু আওয়ামী লীগের মতোই পরিবার প্রভাবিত রাজনৈতিক দল। কেন্দ্রে কিংবা প্রান্তে কয়েকটি পারিবারিক বলয়ের ওপরেই হাজার হাজার কর্মীর নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। এসব বলয় তাদের বাইরে থেকে নেতৃত্ব বিকশিত হতে দেয় না। তবে এসব বলয় অক্ষুণ্ন রাখার জন্য শুধু রাজনীতিবিদরাই দায়ী– ঠিক তা নয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অর্থনীতির শরিক হিসেবে যুক্ত রয়েছে নাগরিক সমাজও। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশের ভূমিকা সবসময় শাসকদের পক্ষে থাকে। 
গণঅভ্যুত্থানের পরও নাগরিক সমাজের কোনো কোনো সদস্য পুরোনো ব্যবস্থা অটুট রাখার পক্ষে বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন। যে কোনো অভ্যুত্থানই বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে দিতে চায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানও সেই বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। এখানেই তরুণদের সঙ্গে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরোধ ও সংঘাত। নাগরিক সমাজের যে অংশ ইনিয়ে বিনিয়ে গণঅভ্যুত্থানকে অস্বীকার করতে চায়, তারাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বাংলাদেশের আগামী রাজনীতিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান একটি পাটাতন হিসেবে কাজ করবে। মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়ে যেমন বাংলাদেশের কল্পনা করা যায় না; তেমনি গণঅভ্যুত্থানকে উপেক্ষা করে আগামীর রাজনীতিও অসম্ভব। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’ বাস্তবতা হলো, গণঅভ্যুত্থানের পরও দেশের নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি অংশ একই ভাষা ও সুরে কথা বলছে।  
এখানেই তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তরুণরা বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর বলয়গুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশের রাজনীতি পুনর্গঠন করলেই জনগণ নিজেদের পথ খুঁজে পাবে। আর তরুণরা বিদ্যমান লুণ্ঠনের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভাষায় নিজেদের ঠেলে দিলে কেউই দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারব না। 

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল 
iftekarulbd@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত জ ল ই গণঅভ য ত থ ন র জন ত ত র র জন ত র জন ত ক ব যবস থ পর ব র আওয় ম ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। দলটি বলেছে, আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির পদক্ষেপ দেখতে চায়।

শুক্রবার জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।

তারা বলেন, এই উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

বিবৃতিতে নেতারা বলেন, অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক ও বিবৃতিতে আগামী বছরের পবিত্র রমজানের আগেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ এবং তার পূর্বশর্ত হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের ঘোষিত প্রত্যয়ে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, গণমানুষের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাঠামোগত মৌলিক সংস্কার এবং গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী শক্তির বিচারের ব্যবস্থা। এই বিষয় দুটির দৃশ্যমান অগ্রগতিই কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি রচনা করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সমাজের শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীদের মতামত, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের আহ্বান জানায় জেএসডি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • গণঅভ্যুত্থানে আহত সামিউলের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়
  • লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি