ব্যাংকার্স ক্লাব অব বাংলাদেশের আবেদনে ব্যাংকগুলোর অর্থায়নে দেশে একটি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য একটি ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। তাতে জমা হয় ৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু গত বছরের আগস্টে সরকার বদলের পর ব্যাংকারদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণের এই উদ্যোগ থমকে গেছে।

ব্যাংকার ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকারদের জন্য হাসপাতাল তৈরির বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে দেশের সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা অর্থায়নে সম্মতিও দিয়েছিলেন। এ জন্য গঠন করা হয় ব্যাংকার্স ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ফাউন্ডেশন গঠনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের এপ্রিল–জুনে আটটি সরকারি–বেসরকারি ব্যাংক মিলে ৬৮ কোটি টাকা জমাও করে সেই ফাউন্ডেশনে। ব্যাংকের কর্মকর্তা–কর্মচারী, পরিচালক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য এই হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আর সেই প্রক্রিয়া এগোয়নি। অন্য ব্যাংকগুলো টাকা জমা দেয়নি। ফলে ব্যাংক হিসাবে পড়ে রয়েছে জমা হওয়া টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকারদের হাসপাতাল তৈরির জন্য গঠিত ফাউন্ডেশনের তহবিল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার কর্মকর্তাকে। তাঁদের তিনজনকে এরই মধ্যে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন এই হাসপাতাল নির্মাণ হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, ২০২২ সালের ১৬ জুন সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের অংশগ্রহণে ও গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকগুলোর অর্থায়নে একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর নানা প্রক্রিয়া শেষে ‘ব্যাংকার্স ফাউন্ডেশন’–এর নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়। ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকের প্রতিটি এই ফাউন্ডেশনে ১০ কোটি টাকা এবং চতুর্থ প্রজন্ম ও পরবর্তী সময়ে অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো চার কোটি টাকা করে চাঁদা দেবে। গত বছরের ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিটি ব্যাংককে চিঠি দিয়ে ব্যাংক হিসাব নম্বর ও চাঁদার পরিমাণ জানিয়ে দেওয়া হয়। এতে সব মিলিয়ে ৫৩২ কোটি টাকা চাঁদা ওঠার কথা। হাসপাতালের জমি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণকাজে এই অর্থ ব্যবহারের কথা ছিল। যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই চাঁদার হার নির্ধারণ করে, তখন ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক তারল্যসংকটে ছিল।

এ জন্য ব্যাংকার্স ফাউন্ডেশনের নামে অগ্রণী ব্যাংকে একটি হিসাব খোলা হয়। ব্যাংকার্স ফাউন্ডেশনের প্রধান করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহারকে। ব্যাংক হিসাবে স্বাক্ষরদাতা করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো.

নাছের, সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম, ইসলামী ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা ও ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখারকে। এর মধ্যে সরকার বদলের পরদিনই আবু ফরাহ মো. নাছেরকে পদত্যাগে বাধ্য করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সোনালী ব্যাংক এমডিকে সরিয়ে দেয় সরকার এবং ইসলামী ব্যাংক এমডিকেও ছুটিতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও পালিয়ে যান।

অগ্রণী ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকার্স ফাউন্ডেশনের এই হিসাবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সিটি ব্যাংক প্রথম এক লাখ টাকা জমা দেয়। ফাউন্ডেশন গঠনের খরচের জন্য এই টাকা জমা দেয় ব্যাংকটি। এরপর গত বছরের এপ্রিল–জুন এই তিন মাসে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক, আল–আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক ১০ কোটি টাকা করে সব মিলিয়ে ৬০ কোটি টাকা জমা দেয়। এ সময়ে এই হিসাবে প্রিমিয়ার ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক চার কোটি টাকা করে আট কোটি টাকা জমা করে। ফলে সব মিলিয়ে হিসাবটিতে এখন ৬৮ কোটি টাকা জমা রয়েছে। হিসাব থেকে কোনো টাকা খরচ করা হয়নি।

সূত্র জানায়, হাসপাতালটির জন্য প্রথমে গুলশানে জমি খোঁজা হয়। সেখানে চাহিদামতো জমি না পাওয়ায় পরে ১০০ ফিট সড়কের দিকে জমির খোঁজ করা হয়। এর মধ্যে একাধিক বিক্রেতার সঙ্গে জমি কেনার বিষয়ে আলোচনাও হয়েছিল। তবে সরকার পরিবর্তনের পর সব প্রক্রিয়া থেমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার বদলের পর ব্যাংকগুলোয় বড় ধরনের সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে। ফলে নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের কাছে ব্যাংক হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়টি এখন পর্যন্ত উপস্থাপন করা হয়নি। ব্যাংকগুলোকে তাগাদা না দেওয়ায় অন্যরা তহবিলে চাঁদাও জমা দেয়নি। তবে বেশির ভাগ ব্যাংক এখনো হাসপাতাল নির্মাণে চাঁদা দেওয়ার পক্ষে।

তবে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা একরকম জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার ব্যাংক উদ্যোক্তারা এটার বিরোধিতা করেছিলেন। মনে হয় না, এই হাসপাতাল হবে। যারা টাকা জমা দিয়েছে, তাদের টাকা ফেরত দেওয়া উচিত। ব্যাংকারদের হাসপাতাল ধারণাটি বাস্তবসম্মত নয়।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গত বছর র কর মকর ত হয় ছ ল র পর ব এই হ স র জন য প রথম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম, এখানে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা নেই: জেড আই খান পান্না

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।

আজ শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বারের হলরুমে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার সংকট ও আইনি প্রতিকার পাওয়ার পথ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জেড আই খান পান্না। সেমিনারটির আয়োজন করে আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিস (এইচআরসিবিএম), বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।

বক্তব্যে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এখানে সংখ্যালঘুর কথা বলা হচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন আমি সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। আজ মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা দেখি, জুতা দিয়ে বাড়ি দিতে দেখি, কিন্তু কিছু করতে পারি না। তাই আমি সবচেয়ে বড় অসহায়।’

এসব কথা বলতে বলতে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না কেঁদে ফেলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, জীবনে কখনো জেনে-বুঝে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন, তাঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

জেড আই খান পান্না আরও বলেন, ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, কারও সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এটা সাম্প্রদায়িকতার দেশ না। সংবিধানে যেন কেউ হাত না দেয়। সরকারের অনেকেই বিদেশি হয়েও স্বদেশি ভাব দেখাচ্ছেন।

সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সমাজে ন্যায়বিচার বা সুবিচার পাওয়ার কথা থাকলেও তা মিলছে না। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচার হয় না। কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরে বেরিয়ে যায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুমন কুমার রায় বলেন, সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত। বর্তমান নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা হলেও সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না, এমনকি দুঃখও প্রকাশ করে না।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ শুরু হলে তা দমন করতেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে উল্লেখ করে সুমন কুমার দাবি করেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সনাতনী সম্প্রদায়ের বাক্‌স্বাধীনতা বন্ধ করতে, নেতৃত্ব দমন করতে এসব করা হচ্ছে।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে কে পাল। সঞ্চালনায় ছিলেন এইচআরসিবিএমের বাংলাদেশ চ্যাপটারের আহ্বায়ক লাকি বাছাড়। সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ও মো. গোলাম মোস্তফা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ