ইরাকের সেই সাজানো গল্প এবার ইরানেও
Published: 18th, June 2025 GMT
বিশ্ব এই সাজানো চিত্রনাট্য আগেও দেখেছে। এখানে অস্তিত্বের ওপর হুমকি তৈরি হচ্ছে—এ রকম একটা বয়ান তৈরি করা হয়। সংবাদমাধ্যমগুলো সম্মিলিতভাবে এটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না। রাজনীতিবিদেরা রণবাদ্য বাজায়, নিরাপত্তার কথা বলে আগ্রাসনের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়।
আগেরবার ছিল ইরাক। আর এবারে ইরান।
কিন্তু দৃশ্যপটে স্পষ্ট করে ভেসে থাকা একটা জ্বাজল্যমান সত্য সবাই দেখেও দেখছে না। ইসরায়েলের কাছে পারমানবিক অস্ত্র আছে, অথচ কেউ তাদের জবাবদিহি করছে না।
এবার আসুন বাস্তবতাগুলো স্পষ্ট করে বলা যাক—ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সদস্যরাষ্ট্র। তারা আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) অনুমতি দিয়েছে। ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সব সময় নজরদারির মধ্যে থাকে। শুধু সম্ভাব্য পারমাণবিক সক্ষমতার অভিযোগেই ইরানের ওপর বিধ্বংসী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
অন্যদিকে ইসরায়েল এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি। ইসরায়েল কখনো আইএইএকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দেয়নি। এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়, ইসরায়েলের কাছে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক ওয়্যারহেড রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিধর দেশ ইসরায়েল। দীঘদিন ধরেই তারা বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার প্রাণঘাতী কৌশল অবলম্বন করে আসছে। তারা ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে আসছে।
আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?২১ ঘণ্টা আগেবিস্ময়কর ভণ্ডামিএই মুহূর্তে ইসরায়েলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তদন্ত চলছে। এটা কোনো তত্ত্ব কিংবা জল্পনা নয়, এখনো সেটা চলমান।
গাজা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। শিশুদের দেহ খণ্ডবিখণ্ড হচ্ছে। গোটা পরিবার ধরে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে। গোটা পাড়া পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর এসব ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞের জন্য যে রাষ্ট্র দায়ী, পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত সেই রাষ্ট্রই অন্য রাষ্ট্রকে নজরদারির মধ্যে আনার দাবি জানাচ্ছে।
এ ঘটনা আমাদের সেই তথাকথিত ‘নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’ সম্পর্কে কী ধারণা দেয়?
এটি আমাদের বলে, নিয়মকানুন শুধু দুর্বলদের জন্য প্রযোজ্য। এটি আমাদের বলে, কিছুর রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে যেকোনো কিছু করতে পারে। এ কাজে সেই রাষ্ট্রগুলো ভূরাজনৈতিক জোটের প্রশ্রয় পায়, তাদের মদদদাতারা নীরব থাকে।
এটি আরও বলে, যেসব সংবাদমাধ্যমে ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান একসময় দাবি করেছিল, ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে (যা পরে চরমভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল), সেসব সংবাদমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান এখনো সবচেয়ে অনিবার্য প্রশ্নগুলো তুলতে ব্যর্থতা দেখাচ্ছে।
আরও পড়ুনইরানে হামলা ইসরায়েলের জন্য কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে ১৭ জুন ২০২৫ইসরায়েল যদি এভাবে তাদের সহিংসতা ও পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের জন্য প্রশ্নহীন সমর্থন পেতেই থাকে, তাহলে এনপিটি অর্থহীন হয়ে পড়বে। আইএইএ নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আর ভবিষ্যতে তারা যে ‘রেড লাইন’ বা বিপদের সীমারেখা টেনে দেবে, সেটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই হবে না।ইরানের ক্ষেত্রে বা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে যে মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়, সেটা কেন ইসরায়েলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় না?
একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন। কেন সেই দেশ জরুরি বৈশ্বিক উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু নয়?
ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার আছে, সেটা আতঙ্কের বিষয় নয়, অথচ ইরান পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলেছে—এমনটা কল্পনা করে আমরা কেন আতঙ্কিত হচ্ছি?
এই দ্বিচারিতা বিস্ময়কর। বাকি বিশ্বের মানুষেরা এটা ভালো করেই বুঝে ফেলেছে।
ইরাকের চিত্রনাট্যবৈশ্বিক দক্ষিণ এই ভণ্ডামি দেখছে। মুসলিমরাও এটা দেখছে। আর ফিলিস্তিনের জনগণ দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি প্রতিদিন ভোগ করছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকেরা তাদের নেতাদের এই দ্বিচারিতা সম্পর্কে ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের নৈতিক কর্তৃত্ব ক্রমে ধ্বংস হচ্ছে।
এটি ইরানের পক্ষে দাঁড়ানোর বিষয় নয়। এটি আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের ধারাবাহিক ও বিপজ্জনক অবক্ষয়ের বিষয়।
যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সত্যিই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে সব পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে; বিশেষ করে যেসব রাষ্ট্রের কোনো স্বচ্ছতা নেই, যারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা উসকে দেয়।
ইসরায়েল যদি এভাবে তাদের সহিংসতা ও পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের জন্য প্রশ্নহীন সমর্থন পেতেই থাকে, তাহলে এনপিটি অর্থহীন হয়ে পড়বে। আইএইএ নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আর ভবিষ্যতে তারা যে ‘রেড লাইন’ বা বিপদের সীমারেখা টেনে দেবে, সেটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই হবে না।
আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েলের হামলার আসল যে কারণ১৬ জুন ২০২৫বিশ্বের যেকোনো নৈতিকতাবোধসম্পন মানুষ স্পষ্টভাবে বলতেই পারে, ইসরায়েলকে শুধু গাজা ও পশ্চিম তীরে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য নয়, তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের জন্যও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
মিথ্যা অজুহাত কারও ক্ষেত্রে নিয়মের দোহাই, আর কারও ক্ষেত্রে দায়মুক্তি—এই পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান থেকে বিশ্বকে আরেকটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া আমরা সহ্য করতে পারি না।
ইরাকে ব্যবহার করা সেই পুরোনো চিত্রনাট্য বহু আগেই বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি যদি আবার ফিরিয়ে আনা হয়, তবে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধও গড়ে তুলতে হবে।
এই দ্বিচারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কোনো চরমপন্থা নয়; বরং এটি উপেক্ষা করাটাই সাধারণ নিয়মে পরিণত করা ঠিক নয়।
উমর সোলায়মান ইয়াকিন ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র ক আম দ র র জন য এনপ ট
এছাড়াও পড়ুন:
দলগুলো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে
জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, তাহলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে।
আজ সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি সভায়’ এই সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরে সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়েছে, সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।
তবে গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি আগে হবে। এসব সুপারিশ জমা দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আজ জরুরি বৈঠকে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল