২৩ জুলাই প্রথম আলো আয়োজিত ‘গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর: অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায় ‘এখন মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে যে আমরা সরকার বলতে যাদের দেখি আনুষ্ঠানিকভাবে, আসলে তার ভেতরেও আরেকটা সরকার আছে।’

সরকারের ভেতরে যে আরেকটি সরকার আছে, অনেক ঘটনায়ই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সরকার রাষ্ট্রীয় সংস্কারে অনেকগুলো কমিশন ও কমিটি করেছে, যার সব কটির সঙ্গে নির্বাচন ও সংবিধান সরাসরি সম্পর্কিত নয়, সরকার চাইলে প্রশাসনিক ও নির্বাহী আদেশেই সংস্কারকাজ করতে পারে। কিন্তু কাজগুলো হয়নি। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নিজেও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন। প্রতিবেদনের ফলাফল সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে চার মাস আগে বলেছিলেন,  ‘প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শ্বেতপত্র প্রতিবেদনটি গ্রহণ (ওউন) করেছেন। কিন্তু তাঁর উপদেষ্টা পরিষদে যাঁরা প্রাসঙ্গিক, তাঁরা গ্রহণ করেননি। হয়তো প্রতিবেদন অনুসারে সংস্কারের সক্ষমতার ঘাটতি আছে কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার যে পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা সংস্কারের অনুকূলে নয়। (প্রথম আলো, ৫ মার্চ ২০২৫)

এর মাধ্যমে তিনি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের ইংগিত করেছেন। তাঁদের মধ্যকার মতবিরোধ এখন স্পষ্ট। কখনো সংস্কার নিয়ে, কখনো নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে। গত এক বছরে পুলিশ বিভাগ, জনপ্রশাসন বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে যেসব সুপারিশ এসেছে, তাও বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ নেই।

সরকারের ভেতরে থাকা সরকার যে কতটা তৎপর তার আলামত পাওয়া গেল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিপত্রে। ২১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ থেকে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও ওড়না এবং অন্যান্য পেশাদার শালীন পোশাক পরার নির্দেশনা দেওয়া হয়। শর্ট স্লিভ ও লেংথের ড্রেস অর্থাৎ ছোট হাতা ও ছোট দৈর্ঘ্যের পোশাক ও লেগিংস পরিহার করতে বলা হয়েছে। ওই নির্দেশনায় ফরমাল স্যান্ডেল বা জুতা, সাদামাটা হেডস্কার্ফ বা হিজাব পরতে বলা হয়েছে।

পুরুষদের পোশাকের ক্ষেত্রে লম্বা বা হাফ হাতার ফরমাল (আনুষ্ঠানিক) শার্ট ও ফরমাল প্যান্ট পরতে বলা হয়েছে। পরিহার করতে বলা হয়েছে জিনস ও গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। নির্দেশনা না মানলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনার কথাও বলা হয়েছিল।

পোশাক নিয়ে এত দিন জনপরিসরে অনেক বিতর্ক চলছিল। অনেক নারী হেনস্তার শিকার হয়েছেন। কিন্তু সেটা যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে যাবে, কেউ ভাবেননি।

এই পরিপত্র জারি হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এম আহসান মনসুর যখন বিদেশে, তখনই এটি জারি করা হয়। তিনি বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং অবিলম্বে এটি প্রত্যাহার করতে বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘মিডিয়ার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিষয়টি বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের গোচরীভূত হলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তাঁর নির্দেশনা মোতাবেক বিষয়টি এ মুহূর্তে প্রত্যাহার করা হলো।’

ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্দেশনাটি ছিল পরামর্শমূলক। কিন্তু পরামর্শমূলক নির্দেশনায় শাস্তির কথা আসে কী করে?

ধারণা করি, গভর্নরকে না জানিয়েই কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পোশাক ঠিক করার কাজটি যাঁরা করেছেন, তাঁরা হলেন সরকারের ভেতরের সরকার। অর্থনৈতিক খাতে সরকারের অনেক ব্যর্থতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন, এটা সবাই স্বীকার করেন। তাহলে  তার অর্জিত সুনাম নষ্ট করার জন্য ভেতরের কেউ তৎপরতা চালাচ্ছেন কি না, খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

সরকারের ভেতরে সরকার থাকার আরও অনেক উদাহরণ আছে। অন্তর্বর্তী সরকার পাঠ্যবই পরিবীক্ষণের উদ্দেশ্যে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করলে একটি মহল এর তীব৶ বিরোধিতা করে। তাঁদের নামে ধর্মবিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আসা সরকার তখন শক্ত অবস্থান না নিয়ে কমিটি বাতিল করে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই আরেকটি উদারহণ। পাঠ্যবইয়ে জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের বিভিন্ন গ্রাফিতি মুদ্রিত হয়, যার একটিতে ‘আদিবাসী’ কথাটি লেখা ছিল। অমনি চারদিকে শোরগোল তোলা হয়।

এখানেও সরকার নিজের অবস্থানে স্থির থাকতে পারেনি। মহল বিশেষের আপত্তির মুখে আদিবাসী লেখাসংবলিত গ্রাফিতি বাদ দিয়ে দেয়। বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বাঙালি শোভিনিজম নিয়ে উচ্চকণ্ঠ। এমনকি তাঁরা সংবিধানেও ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ কথাটি বাদ দিতে চান বহুত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে। কিন্তু তাঁদের সেই বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে আদিবাসীদের ঠাঁই হলো না। এমনকি রাষ্ট্র সংস্কারে যেসব কমিশন গঠন করা হয়েছিল, তাতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপস্থিতিও তুলনামূলক কম ছিল। কোনো কোনোটিতে ছিলই না।

অন্যান্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে যে রাজনৈতিক মহলে তর্কবিতর্ক হয়েছে, সেটা স্বাভাবিক। কেউ পক্ষে বলেছেন। কেউ বিপক্ষে। কিন্তু নারী অধিকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার পর একটি মহল কেবল কমিশনের সুপারিশের বিরোধিতা করেনি, পুরো কমিশনই বাতিল করার দাবি জানিয়েছে। এরপর থেকে নারীবিষয়ক কমিশন ফাইলবন্দী। এ নিয়ে সরকারের কেউ কোনো কথা বলছেন না। এখানেও সরকারের ভেতরে অদৃশ্য সরকারের আলামত পাওয়া যায়।

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে খেটে খাওয়া গরিব মানুষের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন শ্রমজীবী মানুষেরা, ২৮৪ জন।

দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক, ট্রাকের চালক–সহকারী, দোকানের কর্মী, রেস্তোরাঁর কর্মচারী ও পোশাক কারখানার কর্মীদের মতো আনুষ্ঠানিক–অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা গণ–অভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন। শ্রমজীবীদের পরে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন শিক্ষার্থী—২৬৯ জন।

কিন্তু গত এক বছরে সেই শ্রমজীবী মানুষের কাজের সুযোগ বাড়েনি। বরং  অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। নিত্যপণ্যের, বিশেষ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার তাঁদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছর ২৬ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে।

লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরকার কার্যকর কোনো কর্মসূচি না নিলেও সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করতে বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতনকাঠামো নির্ধারণ করতে বেতন কমিশন গঠন করা হয়। বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বেতনের সমন্বয় না থাকায় নতুন বেতনকাঠামো গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে।

কিন্তু সরকার ১৫ লাখ মানুষকে খুশি করতে গিয়ে বাকি সব মানুষকে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলল, সেটা কি মনে রেখেছে? বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অর্থনৈতিক বর্তমান নাজুক অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রশ্ন আমাদেরও।

অতীতে রাজনৈতিক সরকারগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের খুশি রাখতে নানা রকম প্রণোদনা দিত। এর বাইরের মানুষের দুঃখ–কষ্টের কথা খুব ভাবত না। বর্তমান সরকার তো দলীয় সরকার নয়, তারা কেন তেলা মাথায় তেল দিচ্ছে?  বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। কিন্তু সরকারের নীতি–পরিকল্পনায় সেই বৈষম্য কমানোর কোনো লক্ষণ নেই।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত প রথম আল শ রমজ ব ন সরক র উপদ ষ ট এক বছর হ র কর অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের

খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।

মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ