মৌলিক সংস্কারে শর্ত সাপেক্ষে একমত হওয়া উদ্বেগজনক
Published: 5th, August 2025 GMT
রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের ক্ষেত্রগুলোতে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর শর্ত সাপেক্ষে একমত হওয়াকে উদ্বেগজনক মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, দলগুলো এখন যেসব বিষয়ে শর্ত সাপেক্ষে একমত হচ্ছে, বাস্তবায়নের সময় যদি সেগুলো না মানতে চায়, তাহলে ঝুঁকির জায়গা তৈরি হবে। একই সঙ্গে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি কী হবে, তার বাধ্যবাধকতা কী হবে, সে সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। ফলে সংস্কারের আশায় ধাক্কা লাগতে পারে এবং রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
গতকাল সোমবার রাজধানীতে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ড.
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা নিয়ে আলোচনা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয় না উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক দলের সংস্কার না হলে, দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে দলগুলো কীভাবে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম ও মো. জুলকারনাইন। পরে গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর সার্বিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন ইফতেখারুজ্জামান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান ও উপদেষ্টা সুমাইয়া খায়ের।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ১১টি সংস্কার কমিশনের আশুকরণীয় বেশ কিছু সুপারিশ চিহ্নিত করে সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করবে বলা হলেও তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো সুপারিশগুলো পাশ কাটিয়ে একটি–দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে অ্যাডহক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা সংস্কারের নামে আরও বেশি সংকট সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের শতাধিক সুপারিশের মধ্য থেকে কয়েকটি সুপারিশ চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে শৌচাগার পরিষ্কার রাখার মতো সুপারিশকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে একধরনের বৈষম্য আছে উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রথম দফায় ছয়টি সংস্কার কমিশনের ওপর অনেকটা যৌক্তিক কারণেই প্রাধান্য বেশি হয়েছে। তবে পরবর্তী পাঁচটি কমিশনের বিষয়ে আলোচনা–পর্যালোচনা বা সামনে কী হবে এবং এই কমিশনগুলোর দেওয়া সুপারিশগুলোর ভাগ্যে কী ঘটবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। নারী, শ্রম, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম এবং স্থায়ী সরকার কমিশনের সুপারিশগুলো এখন পর্যন্ত আলোচনার বাইরে।
সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে কথা বলেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট–পরবর্তী রাজনৈতিক যাত্রা অশুভ ছিল। ৫ আগস্ট বিকেল থেকেই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের একাংশ দলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা–বাণিজ্য শুরু করে এবং এক বছর ধরে তা আরও বেড়েছে। এমনকি দলের উচ্চ পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
সরকারের কোনো কেনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে কিছু কিছু স্বার্থের দ্বন্দ্বপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের উচ্চ মহল থেকে দুদকের কাজে প্রভাব সৃষ্টি করার মতো উদ্বেগজনক ঘটনাও ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এমনটা প্রত্যাশিত ছিল না।
এক বছরের চিত্রগবেষণায় জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, গুমসংক্রান্ত তদন্ত ও বিচার, আইনি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা, নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা, বিচারিক সেবা, আর্থিক খাত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবেশ সংরক্ষণ, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, দুর্নীতি–অনিয়ম প্রতিরোধ, অর্থ পাচার রোধ এবং প্রধান প্রধান অংশীজন তথা রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমসহ সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে।
গুমের ঘটনার বিচারে ধীরগতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার বিরুদ্ধে গুমের আলামত নষ্টের অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর জড়িত সদস্যদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের অবস্থান অস্পষ্ট। র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ বাস্তবায়নেও সরকারের অবস্থান স্পষ্ট নয়।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বলা হয়, নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের একাধিকবার মতামত প্রকাশ বিতর্কিত ছিল। জুলাই–আগস্টে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতার সময় সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুনএনসিপি ‘কিংস পার্টি’, তাদের দুজন সরকারে: টিআইবির নির্বাহী পরিচালক৭ ঘণ্টা আগেজনপ্রশাসনজনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, জনপ্রশাসনে একটি দলের অনুসারীদের পরিবর্তে অন্য দল বা দলগুলোর প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বঞ্চিত হওয়ার নামে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা আদায় চলছে। পতিত সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় বঞ্চিত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি কর্মকর্তা উপসচিব, যুগ্ম সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫৫০ জনকে অনুমোদিত পদের বাইরে এবং ৭৬৪ জনকে ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দেওয়া হয় (এপ্রিল পর্যন্ত)। চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় ৪০ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত)। প্রতিবেদনে পদোন্নতি পাওয়া বা পদবঞ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণে ব্যর্থতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে টিআইবি।
নির্বাচন বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েকটি দলের চাপে যে প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষ দমনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে বলা হয়েছে, সরকার পতনের আগে–পরে সারা দেশে বিভিন্ন থানায় হামলা ও সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। পুলিশের নির্লিপ্ততা ও দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা এবং সামাজিক অসহনশীলতা রোধে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আর্থিক খাত নিয়ে বেশ কিছু ঘাটতি তুলে ধরা হয়েছে টিআইবির প্রতিবেদনে। সেগুলো হলো সঠিক তথ্য–উপাত্তভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন হলেও বাজেটে খাতভিত্তিক বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারা অনুসরণ করা। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সামগ্রিক বরাদ্দ হ্রাস; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গতানুগতিক বরাদ্দ, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম; সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাদ দেওয়া। শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশ গুরুত্ব না দেওয়া এবং বাজেট প্রণয়নে এর প্রতিফলন না থাকা। এ ছাড়া পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে সরকারের কূটনৈতিক কৌশল ও অংশীজনের সম্পৃক্ততায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
অনিয়ম–দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক মূল্যায়নে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুদকের কার্যক্রম রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। তদন্ত ও মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণ অব্যাহত রয়েছে। দুদক সংস্কার বিষয়ে প্রায় সর্বজনীন ঐকমত্য থাকলেও অগ্রগতির সম্ভাবনা হতাশাজনক বলেছে টিআইবি।
রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ১২১রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে টিআইবি বলেছে, গত ১১ মাসে দেশে ৪৭১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১২১ জন নিহত এবং ৫ হাজার ১৮৯ জন আহত হয়েছেন। এসব রাজনৈতিক সহিংসতার ৯২ শতাংশের সঙ্গে বিএনপি, ২২ শতাংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ৫ শতাংশের সঙ্গে জামায়াত এবং ১ শতাংশের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি জড়িত।
গণমাধ্যমবিষয়ক পর্যবেক্ষণে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই অভ্যুত্থান–সংক্রান্ত হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। তিনজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে হামলায় নিহত হয়েছেন (আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত)।
টিআইবি বলছে, এ পর্যন্ত ২৪ জনের বেশি গণমাধ্যমকর্মীকে পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে; আটটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তাপ্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে; অন্তত ১৫০ জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে ‘মব’ তৈরি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি।
এনসিপি কিংস পার্টিসংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ইফতেখারুজ্জামান। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল (কিংস পার্টি) গঠন করা হয়েছে। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, কিংস পার্টি কারা। উত্তরে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা গোপন করার কিছুই নেই। এটি জাতীয় নাগরিক পার্টি। কারণ, এদের সহযোদ্ধা বা সহযাত্রীদের দুজন এখন সরকারে আছেন। সেই হিসেবে কিংস পার্টি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক স ট আইব র প সরক র র পরবর ত ত হয় ছ হয় ছ ন র ওপর ত হওয় আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের সুপারিশ, একমত নয় দলগুলো
জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান–সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতার মধ্যে বিশেষজ্ঞদের নতুন পরামর্শ প্রস্তাব সামনে এনেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাতে বলা হয়েছে, মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করতে পারে। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। এরপর আদেশটি নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করা যেতে পারে।
গতকাল বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হয়। তবে এটি নিয়েও কোনো ঐকমত্য হয়নি। বিএনপিসহ কিছু দল প্রস্তাবটির সঙ্গে দ্বিমত করেছে। প্রস্তাবটি জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবের কাছাকাছি, তারা এটি সমর্থন করেছে। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, প্রস্তাবটি নিয়ে তাদের দলে আলোচনা করতে হবে।
এর বাইরে সংবিধানের সংশোধন বা সংবিধান আদেশ অন্তর্বর্তী সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ করতে পারবে কি না বা অন্য কোনো উপায়ে এটা করা যায় কি না, এ বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। আরও কয়েকটি দলও সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার কথা বলেছে। তবে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল সকাল থেকে শুরু হওয়া আলোচনা বিকেল পাঁচটায় মুলতবি করা হয়। এ বিষয়ে আগামী অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে আবার আনুষ্ঠানিক আলোচনা হতে পারে। আলোচনার তারিখ পরে জানাবে ঐকমত্য কমিশন।
সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করছে ঐকমত্য কমিশন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বে দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। এতে ৮৪টি প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। যদিও গতকাল পর্যন্ত সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
নতুন প্রস্তাবে যা আছেসংবিধান–সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে একাধিকবার বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। গতকালের বৈঠকে ‘বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত চূড়ান্ত অভিমত’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব তুলে ধরে কমিশন।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আইনবিশেষজ্ঞদের প্যানেল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে কিছু পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারকে সুপারিশ করার পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলো হলো:
১. অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করতে পারে; যেখানে জুলাই সনদে উল্লিখিত মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে।
২. পরবর্তীতে এই সংবিধান আদেশ নিয়ে গণভোটে করা যেতে পারে। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট হবে। সংবিধান আদেশে গণভোটের বিধান রাখা যেতে পারে।
৩. যদি গণভোটের মাধ্যমে জনগণ সংবিধান আদেশের প্রতি সম্মতি দেয়, তবে তা কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকেই অনুমোদিত বলে গণ্য হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়। ওই ঘোষণাপত্রের ২২ দফায় বলা আছে, ‘...বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।’
দলগুলোর অবস্থানগতকালের আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর দফার ভিত্তিতে সংবিধান আদেশ জারির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জুলাই ঘোষণার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও এখনো এর আইনি ভিত্তি নেই। আর ঘোষণাপত্র বলা হয়েছে, এসব বাস্তবায়ন করা হবে। করা হয়েছে, তা নয়। সুতরাং এটার ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়া যায় কি না, তিনি সে প্রশ্ন তোলেন।
বিএনপির এই নেতা বলেন, জুলাই ঘোষণায় সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, সময় ও ফোরাম কোনটা হবে, তা বলা আছে। এ সময় তিনি জুলাই ঘোষণাপত্রের ২৫ ও ২৭ নম্বর দফার উল্লেখ করেন, যেখানে আগামী সংসদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, অবিলম্বে যদি জুলাই সনদ কার্যকর হয়, তাহলে সংবিধান সংশোধন হয়ে গেল। কিন্তু এর বৈধতা কে দেবে, তিনি সেই প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম কোটের মতামত চাওয়া যায় যে, সংবিধান আদেশ বা অন্য কোনোভাবে সংবিধানে পরিবর্তন আনা যায় কি না।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটের প্রস্তাব ভালো। কিন্তু সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে সংসদে সংশোধনী পাস হওয়ার পর গণভোট করতেই হবে। এখন আগে একবার এবং পরে একবার, কয়বার গণভোট করা হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এনডিএম, ১২–দলীয় জোটসহ আরও কয়েকটি দল ও জোটের পক্ষ থেকেও সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার কথা বলা হয়। তবে কোন কোন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া হবে, আলোচনায় তা সবাই পরিষ্কার করেননি।
আলোচনায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, তাঁরা মনে করেন ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আদালতের মতামত নিশ্চয় সবাই মানবে। সন্দেহ নেই, একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এখান থেকে বের হতে হবে। তবে যেনতেনভাবে বের হলে হবে না। এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে সবার ‘উইন উইন’ অবস্থা থাকে।
জামায়াত ও এনসিপি যা বলেছেগতকাল আনা প্রস্তাবটি সমর্থন করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ আলোচনায় বলেন, ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সমাধান নয়। সংবিধান আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি দেওয়া হোক, তার ভিত্তিতে নির্বাচন হতে হবে। আর গণভোট সবচেয়ে শক্তিশালী। সংসদ মৌলিক সংস্কার বা সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করতে পারবে না।
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়া হলে পরে জটিলতা তৈরি হবে কি না, তা দেখতে হবে। এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন হচ্ছে, সেখানে থাকবেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। আবার কেউ কেউ রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন। সুতরাং এখান থেকে নিরপেক্ষ সমাধান আসবে কি না, তা নিয়ে ঝুঁকি আছে। তাঁরা আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান না।
নতুন প্রস্তাবটি নিয়ে তাদের দলে আলোচনা করতে হবে বলে জানান এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। তিনি বলেন, পরবর্তী সংসদে গিয়ে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে, এমন একটা ইঙ্গিত আলোচনা থেকে পাওয়া যাচ্ছে। সেটা একটু ঘুরিয়ে, ১০৬ অনুচ্ছেদকে সামনে এনে। যদি আদালত বলেন, এটা করা যাবে না। তখন কী হবে?
জাবেদ রাসিন বলেন, তাঁরা এই সরকারের অধীনে সনদের বাস্তবায়ন চান। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পথ হলো গণপরিষদ, যা একই সঙ্গে নিয়মিত সংসদ হিসেবেও কাজ করতে পারে।
একাধিক বিকল্প সুপারিশ থাকবেগতকালের আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান–সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পূর্ণাঙ্গ মতামত দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। অনেকে এটা সমর্থন করেছেন, অনেকেই এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। আগের যেসব প্রস্তাব ছিল, সেগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চাওয়া যেতে পারে—এ রকম মত এসেছে।
বৈঠক মুলতবি করা হয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, তাঁরা দলগুলোকে কিছুটা সময় দিতে চান। যাতে দলগুলো পরস্পর আলোচনা করতে পারে। সরকারকে একাধিক বিকল্প পদ্ধতি সুপারিশ করতে চায় কমিশন। এখন দলগুলোর কাছ থেকে ছয়টির মতো এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একটি মতামত আছে। কমিশন বিকল্প আরও কমিয়ে আনতে চায়। অক্টোবরের শুরুর দিকে আবার আলোচনায় বসে দ্রুত কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তৈরি করে সরকারকে দেওয়া যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন।