বিএনপি-জামায়াতের চার যুগের বন্ধুত্বের কী হলো
Published: 19th, September 2025 GMT
জামায়াতে ইসলামীর আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমরা একটা জোট করতেছি, যেখানে বিএনপি থাকবে না।’ ইসলামপন্থী আরেক রাজনৈতিক দল খেলাফত মজলিসের আমির কিছুদিন আগে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইসলামপন্থীদের আনুকূল্য নিয়েই বিএনপিকে চলতে হবে।’
দেশে ‘ইসলামি রাজনীতির’ যে জাগরণ চলছে এবং তাদের নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তৃতা–বিবৃতি দেখলে বোঝা যাবে, তাদের সবার মুখের ও মনের ভাষা একই। স্বাধীনতার পর এ ধরনের সুযোগ তারা পায়নি।
ইসলামি দলগুলোর মধ্যে বিবাদ আছে, এই বিভক্তি নিয়েও তারা সবাই মোটামুটি একমত—বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। যেটাকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান।’ ডাকসু-জাকসুর নির্বাচনী ফলাফলকে পর্যবেক্ষকেরা বলছেন জামায়াতের উত্থান।
বিএনপির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে ২০–দলীয় জোট গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোটসহ বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল। আওয়ামী লীগ আমলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট প্রতিকূলতা ছিল। তাদের বেশ জড়সড় হয়ে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করতে হতো।
৫ আগস্ট অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। এখন ইসলামি দলগুলো বিএনপির তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে নিজেরাই তাঁবু খাটিয়েছে এবং জানান দিচ্ছে, ‘ইসলামপন্থীদের আনুকূল্য নিয়েই বিএনপিকে চলতে হবে।’ এখন জামায়াতে ইসলামী জোট গঠন করছে বিএনপির বিরুদ্ধে।
বিএনপি-জামায়াতের চার যুগের বন্ধুত্বএকাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর বিতর্কিত ভূমিকা তাদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোণঠাসা করে রেখেছিল। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইসলামী দলগুলো আবার হাঁটি হাঁটি পা নিয়ে বিএনপির আনুকূল্যে রাজনীতি করা শুরু করে। বেগম খালেদা জিয়াও জামায়াতদের জোটবদ্ধ করে তাঁদের নেতৃবৃন্দকে মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। তখন ভাষ্য ছিল, ‘বিএনপির আনুকূল্য নিয়েই ইসলামি দলগুলোকে চলতে হবে।’
ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দল জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন বিএনপির আনুকূল্যে রাজনীতি করেছে। বিশেষত শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে তারা নানাভাবে এত বেশি কোণঠাসা ছিল যে নিজেদের স্বাধীন সত্তা খুব কমই প্রকাশ করতে পেরেছে। বিএনপিকেও জামায়াতকে জোটে আশ্রয় দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয়েছিল। তবে হাসিনার আমলে জামায়াতকেও বিএনপির দরকার ছিল।
তখন বড় দুই দলের ছিল ৪০/৪০ ভোট ব্যাংক। জামায়াতের ও জাতীয় পার্টির প্রতিটির ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোট, বড় দুই দলের যেকোনো একটির সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সহায়ক ছিল। নব্বইয়ের বছরগুলোতে যখন তুলনামূলকভাবে তিনটা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন এই দুইটা ছোট দলের সমর্থনের তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জাতীয় পার্টির ভোট ছিল রংপুর ও উত্তরাঞ্চলে কিছু অংশে সীমাবদ্ধ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মামলাগুলোর জন্য জাতীয় পার্টিকে সব সময় যারা ক্ষমতায়, তাদের সাপোর্ট করতে হতো। জামায়াতের ভোট ছিল সারা দেশেই মোটামুটি সুষমভাবে ছড়িয়ে। বিএনপির অনেক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আসনগুলোতে জামায়াতের ভোট পেয়ে জিততে পেরেছে। যদিও বিগত তিন নির্বাচনে কোনো সুস্থ ভোট হয়নি, তবু সামনের নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশায়, বিএনপি সব সমালোচনা মেনে নিয়ে জামায়াতকে সঙ্গে রেখেছিল।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বন্ধুত্ব বা জোট ছিল কৌশলগত, আদর্শিক কোনো মিল ছিল না। তবে চার যুগ ধরে এই বন্ধুত্ব সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। দুই দলেরই প্রচেষ্টা ছিল বন্ধুত্বের ভারসাম্য বজায় রাখতে।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী মাঠ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ভোটের ৪০/৪০ অনুপাত অনেক বদলে গেল। জামায়াতের স্বাধীন রাজনীতির সব প্রতিকূলতা আপাতত দূর হয়ে গেল। এখন তারা আলাদা হয়ে সর্বত্রই নিজেদের স্বাধীনতা উপভোগ করছে। জামায়াতের বিএনপির বন্ধুত্ব আর প্রয়োজন নেই।
বড় দল হিসেবে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তাদের জামায়াতের ভোটের এত প্রয়োজন নেই। তবু তারা জামায়াতকে আগের মতো সঙ্গে রাখতে চেয়েছিল। কে চায় প্রতিযোগী বাড়াতে?
জামায়াত ও বিএনপির বন্ধুত্ব ভেঙে গেল। জামায়াত এখন বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই বন্ধুত্ব ভাঙার পেছনে কোন দলের অবদান কতটুকু এবং কী কী উপাদান কাজ করেছে, সেই আলোচনা বেশ বিস্তৃত।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে কৃতিত্ব দাবিজামায়াতের ছাত্রশিবির বিভিন্ন পরিচয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরর সঙ্গে যুক্ত ছিল। আন্দোলনে সফলতার পর তারা এই নিয়ে খোলাখুলি কৃতিত্ব দাবি করে। ৫ আগস্টের পর জামায়াতকে যথেষ্ট প্রভাবশালী মনে করা হচ্ছে। তারা সরকারের বিভিন্ন কাজকর্মে প্রভাবিত করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জামায়াত মাঠপর্যায়ে তাদের কর্মীদের কাজে লাগিয়ে তাদের প্রভাবকে দৃশ্যমান করেছে।
অন্যদিকে ৫ আগস্টের পরপর বিএনপি কিছুটা হকচকিত ছিল। যেহেতু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে বিএনপির অংশগ্রহণ ছিল না বা থাকলেও সেটি জামায়াতের মতো জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি ফলে তারা জনসংযোগে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ছাত্র আন্দোলনে দলের প্রকাশ্য সমর্থন না দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে জবাবে তিনি বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। অন্যদিকে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘১৭ বছর গাছে পানি দিয়েছে বিএনপি, ফল খেয়েছেন আপনারা।’
মোট কথা জুলাই বিপ্লবে যদিও বিএনপি রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে, তবে উদ্দীপনার ব্যাপারটা বিএনপির অনুকূলে ছিল না, অপরদিকে জামায়াত ছিল দারুণভাবে উজ্জীবিত।
দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে জামায়াতকে প্রতিষ্ঠা করাজামায়াত জানে, দেশে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন নেই এবং আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বিএনপিই বড় দল। এনসিপি জাতীয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এখনো প্রস্তুত নয়। জামায়াতের সুযোগ রয়েছে, বিএনপির সঙ্গে জোট করে তারা ক্ষমতার ভাগীদার হওয়ার। কিন্তু এবার তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন, প্রধান দলের কাছাকাছি থাকা বা দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে নিজেদের দাঁড় করানো। সমমনা বা অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জোটের সম্ভাবনার মধ্য দিয়েতারা তাদের এই লক্ষ্য আরও স্পষ্ট করেছে। তারা মনে করে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকলে তাদের সুযোগ আছে ক্ষমতায় যাওয়ার অথবা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে তারা তাদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়াতে পারবে।
বিএনপির চাঁদাবাজি ও দলীয় কোন্দল এবং জামায়াতের ‘ক্লিন’ ইমেজআওয়ামী লীগের ক্ষমতা ছাড়ার পর বিএনপির ছাত্রদল ও যুবদল চাঁদাবাজি, দখলদারি, নিজেদের মধ্যে হানাহানি ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হয়ে আওয়ামী লীগের দুর্নামগুলোও দখল করে নিয়েছে। এই নিয়ে প্রথম থেকেই বিএনপি সমালোচনার মুখে পড়ে, সবচেয়ে বেশি সমালোচনা আসে জামায়াতে ইসলামী থেকে। জামায়াত মনে করে, তারা বিএনপির এসব চাঁদাবাজি ও দখলদারিকে সামনে তুলে এনে নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন দল হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারবে। তাদের এই উদ্যোগ কিছুটা হোঁচট খায় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে সাদাপাথর লুটের যে বিবরণ বের হয়েছে, তার থেকে। দুদক এনসিপি, বিএনপি ও জামায়াতের সিলেট জেলার নেতাদের দোষী করে প্রতিবেদন করেছে। এই প্রতিবেদনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় আমিরের পরিবারের সদস্যও রয়েছেন, তবে জামায়াত এর প্রতিবাদ করেছে। এখনো তারা মনে করে, ক্লিন দল হিসেবে জনগণ তাদের বেছে নেবে।
জুলাই সনদ—দুই দলের চাওয়া সাংঘর্ষিকসংস্কার ও জুলাই সনদ নিয়েও দুই দলের যথেষ্ট পরস্পরবিরোধী স্বার্থ রয়েছে। জামায়াত যদিও ব্যাপক রাজনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে তাদের ভোটব্যাংক এবং ব্যাংক ব্যালান্স দুটিই বেশ বাড়িয়েছে, সেটা এখনো এমন পর্যায়ে আসেনি যে তারা এককভাবে খুব বড় শক্তি নিয়ে পার্লামেন্টে যেতে পারবে। সে ক্ষেত্রে তাদের বাড়তি ভোট নিয়ে একমাত্র ‘পিআর’ পদ্ধতিতেই তারা বেশি আসন পেতে পারে। জামায়াত পিআর নিয়ে বেশ অনড়, তারা নিম্ন ও উচ্চ—উভয় কক্ষে পিআর চায়। অপরদিকে বিএনপি পিআর পদ্ধতির ঘোর বিরোধী।
বিএনপি হবে স্বাধীনতাযুদ্ধের একমাত্র স্বপক্ষ দলবিএনপি মনে করে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তাদের জন্য বড় সুযোগ এনেছে—একাত্তরের স্বাধীনতাপন্থী একক দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার। নির্বাচনকালে তারা জামায়াতের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের কীর্তি-কলাপ নিয়ে সমালোচনা করতেও দ্বিধা করবে না। এতে অনেক আওয়ামী লীগপন্থী ভোটার তাদের ভোট দিতে আকৃষ্ট হতে পারে।
বিএনপির অনেক নেতৃস্থানীয় নেতা মেজর হাফিজের সঙ্গে একমত, ‘জামায়াত “নতুন বাংলাদেশে” একাত্তরের কথা শুনতে চায় না।’
বন্ধুত্বের ভাঙন কি চিরস্থায়ী?প্রশ্ন উঠবে, এই দুই দলের বৈরিতা কত দিন থাকবে? সম্ভবত এই দুই দলের মাঝে যত দিন না অন্য কোনো দল বড় জনসমর্থন নিয়ে আবির্ভূত হবে, তত দিন তারা বিপরীত মেরুতে থাকবে। তবে তাদের জন্য কোনো নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিলে প্রয়োজনে খুব তাড়াতাড়ি এই দুই দল একই তাঁবুর নিচে আবার চলে আসতে পারে। জামায়াতের আমিরই সেই পথটা খোলা রেখেছেন, ‘বিএনপিকে পাইলে আমিও জড়িয়ে ধরি, আমারে পাইলেও বিএনপি জড়িয়ে ধরে। এই ভ্রাতৃত্ব তো আমাদের আছে।’
সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসল মপন থ র স ব ধ নত র বন ধ ত ব র জন ত ক দ ই দল র দল হ স ব ব এনপ ক ও ব এনপ ব এনপ র দলগ ল র র জন য এই দ ই ক ষমত আওয় ম ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
বন্দরে বসুন্ধরা সিমেট্রি কারখানায় অগ্নিকান্ড
বন্দরে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে বসুন্ধরা সিমেট্রি কারখানা অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়েছে। তবে এ ঘটনায় কোন প্রানহানী ও ক্ষয়ক্ষতির কোন খবর পাওয়া যায়নি।
শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭টায় বন্দর থানার মদনগঞ্জস্থ বসুন্ধরা সিমেট্রি কারখানায় এ ঘটনাটি ঘটে। খবর পেয়ে বন্দর ফায়ার সার্ভিসের ২টি ইউনিট ৩০ মিনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
বন্দর ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটে। খবর পেয়ে আমাদের ২টি ইউনিট আধ ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনি।
তবে এ ঘটনায় প্রানহানী বা বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতির কোন খবর পাওয়া যায়নি।