দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ ও মারধরের অভিযোগে সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকসহ উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীসহ ৭৫ জনের নামে থানায় মামলা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে। নবাবগঞ্জ উপজেলার তর্পণঘাট গ্রামের বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী নজরুল ইসলাম (৪০) বাদী হয়ে ৮ জানুয়ারি নবাবগঞ্জ থানায় এ মামলা করেন।

মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন দিনাজপুর-৬ (নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, হাকিমপুর ও ঘোড়াঘাট) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও নবাবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শিবলী সাদিক (৪২); তাঁর চাচা দিনাজপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন (৬৫); নবাবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো.

জিয়াউর রহমান ওরফে মানিক (৫০); উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজওয়ার মোহাম্মদ ফাহিম (৩৫); সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পারুল বেগম (৫০); সহসভাপতি আমির হোসেন (৬২); যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েম সবুজ (৪৫), সানোয়ার হোসেন মণ্ডল (৫৮); উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহিনুর রহমান (৩৫); উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল হোসেন (২৮), সাধারণ সম্পাদক শামীম হোসেন (৩০); ৬ নম্বর ভাদুরিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি জামাল বাদশা (৩০); ১ নম্বর জয়পুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন (৪০) এবং একই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আইনুল হক চৌধুরী (৬০)।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত বছর দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে মামলার আসামিরা রাষ্ট্রের আইনের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নবাবগঞ্জ বাজারে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে একটি গোপন সভা করেন। সভায় নবাবগঞ্জ উপজেলায় চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা যেন জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারেন, সে জন্য জনমনে ভীতি সঞ্চারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ৪ আগস্ট বেলা সোয়া ২টার দিকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা দেশি ধারালো অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমবেত হন। একই সময়ে মামলার বাদীসহ আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় মামলার আসামি শিবলী সাদিক ও দেলোয়ার হোসেনের নির্দেশে আসামি সায়েম সবুজ, মাসুদ রানা, সানোয়ার হোসেন মণ্ডল ও সাদ্দাম হোসেন ককটেল নিয়ে এবং অন্য আসামিরা হাতে ধারালো হাঁসুয়া, লোহার রড, চায়নিজ কুড়াল ও দেশ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেন।

এ সময় আসামি সায়েম সবুজ, মাসুদ রানা, সানোয়ার হোসেন মণ্ডল ও সাদ্দাম হোসেন সেখানে বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। অন্যরা ধারালো দেশি অস্ত্র দিয়ে বাদীর (নজরুলের) নবাবগঞ্জ বাজারে থাকা চারটি দোকান ভাঙচুর করেন। এতে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মালামাল ক্ষয়ক্ষতি হয়। নজরুল ইসলামসহ ছাত্র-জনতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়। একপর্যায়ে বিস্ফোরিত ককটেলে নজরুল ইসলাম, মিন্টু সম্রাট, জহুরুল হক ভুট্টুসহ অনেকে গুরুতর আহত হন।

নবাবগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহুবার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় ৮ জানুয়ারি নবাবগঞ্জ থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও অন্যান্য ধারায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার আসামিরা পলাতক আছেন। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা

লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।

আরো পড়ুন:

আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা

চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।

তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।

শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।

তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।

তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।

ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।

রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”

“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”

“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”

টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”

“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।” 

সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ