চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতামুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নগরে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকারি তিন সংস্থা। খরচ হচ্ছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে তিন ভাগ, ৭৫ শতাংশের বেশি। এর পরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলেনি। গত বছর বর্ষায় সাতবার ডুবেছে চট্টগ্রাম নগর।

সাত বছর পর এসে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ২৬টি প্রতিবন্ধকতার কথা বলছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে তারা এ সমস্যাগুলো সারানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা সমস্যার সুরাহার চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন চট্টগ্রামের মেয়র। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে ‘চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে করণীয়’ শীর্ষক বৈঠকে বসেছে উপদেষ্টা পরিষদ। ওই বৈঠকে ৯টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে প্রকল্পগুলোর প্রতিবন্ধকতা খতিয়ে দেখতে আগামী শনিবার সরেজমিন পরিদর্শনে আসছেন চার উপদেষ্টা।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বড় দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এর মধ্যে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের’ ব্যয় হবে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হবে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্য নিয়ন্ত্রণ জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন, নিষ্কাশন ও উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

সিংহভাগ কাজ শেষ প্রকল্পগুলোর

২০১৭ সালে নেওয়া ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের’ অধীনে ৩৬টি খালের মধ্যে ১৯টি খালের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। অন্য পাঁচটি খালের কাজও শেষ পর্যায়ে। প্রকল্পটির অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। একই সময়ে নেওয়া কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ১২টি স্লুইসগেটের মধ্যে ১০টির কাজ শেষ হয়েছে। সাতটি পাম্পহাউস নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ হয়েছে ৮২ শতাংশ। ২০১৯ সালে নেওয়া চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন, নিষ্কাশন ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৪৩ শতাংশ। প্রকল্পটির আওতায় ২১টি স্লুইসগেটের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে মাত্র চারটি। ১০টির কাজ চলছে। সাতটির কাজ শুরুই হয়নি। ২০১৪ সালে নেওয়া বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮০ শতাংশ। ৩ কিলোমিটার খালের মধ্যে ২ কিলোমিটার খাল খননকাজ শেষ হয়েছে।

মিলছে না সুফল

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর চার ভাগের মধ্যে তিনটি প্রকল্পের তিন ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি প্রকল্পটির কাজও প্রায় অর্ধেক শেষ হয়েছে। তবুও বর্ষায় দফায় দফায় ডুবছে নগর। জলাবদ্ধতায় নগরের  ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়।

এ অবস্থায় গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড.

মো. জিয়াউদ্দীন স্বাক্ষরিত প্রকল্পগুলোর সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টা এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে প্রকল্পগুলোর পরিচালকরা ২৬টি প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরেন। প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে– চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পাওয়া। ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের বড় প্রকল্পটিতে ৭৫৩ কোটি টাকা সরকারি ঋণ ও ৭৫৩ কোটি সিডিএর নিজস্ব অর্থায়নে কাজ বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। কিন্তু সিডিএর আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ের ফলে খাল-নালা ভরাট হওয়া, সচেতনতার অভাবে পরিষ্কারের পরও ময়লা-আবর্জনা খাল-নালায় নিক্ষেপ, খালপাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, খালের ভেতর নির্মিত বহুতল ভবন উচ্ছেদ করে খাল সংস্কারে জটিলতা, খালপাড়ের ভূমি ও স্থাপনায় আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা, প্রকল্পের যন্ত্রপাতির সংকট, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাশয় হ্রাস ও কর্ণফুলী নদীর নাব্য কমে যাওয়া।

উপদেষ্টা পরিষদের ৯ সিদ্ধান্ত

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে করণীয় নির্ধারণে গত ৫ জানুয়ারি এক সভায় ছিলেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক এবং পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সভায় আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে ৯টি করণীয় নির্ধারণ করা হয়। 

এগুলো হলো– চট্টগ্রাম শহরে সব ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করা, চট্টগ্রাম শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা, সিডিএ প্রকল্পের অধীনে নির্মাণাধীন ১৭টি স্লুইসগেটের মধ্যে ১৫টি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের অধীনে ২১টির মধ্যে ১২টি আগামী মের মধ্যে চালু করা, যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে গঠিত কমিটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজের সমন্বয় করবে।

সিদ্ধান্ত হয় বাস্তবায়ন হয় না

২০২১ সালের অক্টোবরে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর সমন্বয়ে বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি ইতোমধ্যে অন্তত এক ডজন সভা করেছে। প্রতিটি সভায় পাহাড় কাটা বন্ধ, খাল-নালায় ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধসহ নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্তের কোনোটিই কখনও কার্যকর হয়নি। 

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, নগরে অবস্থিত ৬০ শতাংশ খাল, ৩০ শতাংশ নালা ও নির্মাণাধীন রেগুলেটরের মাত্র ১৫ শতাংশ কাজ করছি আমরা। এর বাইরে থাকা খাল-নালাগুলো পরিষ্কার না থাকলে পানি নিষ্কাশন হয় না। আবার অন্য রেগুলেটরগুলো চালু না হলে জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। যার কারণে প্রকল্পের সিংহভাগ কাজ হলেও জলাবদ্ধতা হয়।

চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, নগরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ও মার্কেটে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য প্লাস্টিকের বিন বিতরণ শুরু করেছি। নগরবাসীকে পলিথিন, প্লাস্টিক, কর্কশিটসহ অপচনশীল দ্রব্যাদি যত্রতত্র নালা-নর্দমায় না ফেলে সেগুলো নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলার আহ্বান জানাচ্ছি। শুরুতে সচেতন করা হবে, পরে আমরা আইনি পথে হাঁটব।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ক জ শ ষ হয় ছ উপদ ষ ট সমস য নগর র ন রসন

এছাড়াও পড়ুন:

ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল

তিন দিন পর অবশেষে শুক্রবার ১৩ জুন দুই বোনের লাশ মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীতে ভেসে ওঠে। রাইসা ও জান্নাত মামাতো-ফুফাতো বোন। তারা আর হাসবে না। বই–খাতা, স্কুলড্রেস সব আছে, শুধু তারা তারা হয়ে গেছে দূর আকাশে। ১৩ বছরের জান্নাত ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ গিয়েছিল ঈদের ছুটিতে। তার এক বছরের ছোট মামাতো বোন রাইসার সঙ্গে খুব খাতির। ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে হাতে মেহেদিও দিয়েছিল দুজন। নানার বাড়ির কাছেই গজারিয়া নদী। সেখানে তারা বুধবার ১১ জুন যায় গোসল করতে। বলা হচ্ছে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয়। ঈদের ছুটির আগে-পরে (৫ জুন-১৪ জুন) এ রকম প্রায় ৬৬টি ঘটনায় ৭৮ জন ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মর্মান্তিক সব মৃত্যুর খবর এখনো আসছে।

যেকোনো বড় ছুটিতে ‘বাড়ির’ জন্য রওনা দিলেই সবাই পৌঁছাতে পারে না, আবার পৌঁছালেও সবার আর ফেরা হয় না কর্মস্থলে, স্কুলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে। শিশুরা এ সময় বেশি মারা যায় পানিতে ডুবে। এবার সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উল্লিখিত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

৭৮টি মৃতদেহের মধ্যে মাত্র ১২টি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের। বাকি ৬৬ জনই শিশু–কিশোর। এদের বয়স ১০ মাস থেকে ১৭ বছর। ৬৬ জনের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ৫ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এখন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু।

ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ ডুবে মারা যায়। এটি সে দেশের মোট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ দিনে মারা যায় প্রায় ৪০ জন।

এটা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ভারতের চেয়ে বেশি।

বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান মনে করেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।

টিকা দিয়ে বা সময়মতো চিকিৎসায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অকালমৃত্যু ঠেকানো গেলেও ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে’ মানে পানিতে খেয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ডুবে মারা যাচ্ছে পানির বালতিতে, ডোবায়, পুকুরে, খালে, নদীতে।

একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু

রাইসা আর জান্নাতের মতো কমপক্ষে ১৬ জন মারা গেছে, যারা একে অপরের বোন বা ভাই। মেহেন্দিগঞ্জে রাইসা ও জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না গেলেও ফরিদপুরের সালথায় তানহা নিজের ভাই তালহাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তানহা নিজেও পানিতে ডুবে যায়। যে কজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডুবে মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রিয়জনদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন। আসলে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের কৌশল জানা না থাকলে শুধু সাঁতারের জ্ঞান দিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণঘাতী প্রচেষ্টার নামান্তরমাত্র। একইভাবে আমি সাঁতার জানি বলেই আরেকজনকে সাঁতার শেখাতে পারব, এমন ভাবনার কোনো মানে নেই। সব খেলোয়াড় যেমন কোচ হতে পারেন না, তেমনি সব সাঁতারুই সাঁতারের প্রশিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন। এবার যে চারজন অভিভাবক ডুবে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই সাঁতার শেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সাঁতার শেখানো কোনো তামাশা বা ফান নয়। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।

এত মৃত্যুর কারণ কী

এই প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা দরকার।

যেসব কারণ কথিত বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন, তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। গত শুক্রবার (১৩ জুন) দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিন শিশু (রাফা (২), তাসিব (২) ও তুহিন (৫) ডুবে মারা গেলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমাননির্ভর ধারণা থেকে জানান, শিশুর মৃত্যুর জন্য মূলত অভিভাবকেরাই অনেকটা দায়ী। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি তেমন নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরের পাশেই পুকুর বা ডোবা রয়েছে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে প্রায় পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এবারের মৃত্যুতালিকা দেখলে জানা যাবে অনেকেই তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। কাজেই ছেলেমেয়ে বেশি, তাই নজরদারি নেই, এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। ওয়ারিশজনিত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে খুনখারাবি, শিশুহত্যা এ দেশে নতুন কিছু নয়। বড় ছুটির সুযোগ কেউ নিচ্ছে না তো?

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ আমাদের প্রকল্পনির্ভর গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো কি বড় ছুটিতে খোলা থাকবে? ছুটিতে যখন গ্রামে শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন কি তাদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের কেউ জবাব দেওয়ার নেই।

গত কয়েক বছরের পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে অন্য একটা কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে সেই কারণটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম জানাচ্ছে, হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝোঁক আছে, এমন শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা একেবারেই কম নয়। খিঁচুনির নানা ধরন থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণভাবে এটা মৃগীরোগ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত ২২ জনের বিস্তারিত খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের খিঁচুনি বা মৃগীরোগের প্রভাব ছিল।

গত মে মাসে বড় জোয়ারের সময় মহেশখালীতে যে তিনজন (জামাল মিয়া, দানু মিয়া, ঝুমু) পানিতে ডুবে মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃগীরোগের প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ড. লে সানডার এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত যে মৃগীরোগের উপসর্গ থাকলে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ও তাঁর দল ৮৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই মৃগী বা মৃগীরোগ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা মেডপেজ টুডে লে সানডার–এর গবেষণার সূত্র ধরে জানিয়েছে, অন্যদের চেয়ে মৃগীরোগীদের পানিতে ডোবার আশঙ্কা ২০ গুণ বেশি। আবার বিশেষ ধরনের মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭ গুণ।

মৃগীরোগীর সংখ্যা কম নয়

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মৃগীরোগের উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, সমাজে অবহেলায় বেঁচে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ—সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগ্রহে এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত একটি জরিপ চালানো হয়। এটাই ছিল মৃগীরোগীর সংখ্যা নিরূপণের প্রথম জরিপ। কাকতালীয়ভাবে এই জরিপের ফলাফলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মৃগীরোগীর তথ্য হুবহু মিলে যায়। শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ৯ জন মৃগীরোগী আছে বলে এই জরিপে জানা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মোট মৃগীরোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লাখের মতো। বলে রাখা ভালো, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মৃগীরোগীর গড় সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য আছে।

শিশুর মধ্যে কী কী আলামত দেখলে প্রাথমিকভাবে মৃগীরোগের সন্দেহ করা করা যায়:

এক. হঠাৎ করে কোনো শিশু চোখ-মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে আর তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হলে।

দুই. কোনো শিশু যদি চোখের পলক না ফেলে হঠাৎ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বা অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। অনেক ক্ষেত্রে হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। (অভিভাবকেরা অনেক সময় ভাবেন, এটা শিশুর কাব্যিক ভাব। সন্তান তার কবি হয়ে উঠছে।)

তিন. আপাতদৃষ্টে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এক শিশু যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করে। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করে। আবার কয়েক মিনিট পর আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।

চার. পানি বা আগুনের কাছে গেলেই হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে।

পাঁচ. শিশু চোখেমুখে অন্ধকার দেখার কথা বলে। চোখে আলোর ঝিলিক দেখে, তারপর আর কিছু বলতে পারে না।

এসবের কোনোটাই আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, মৃগী কোনো অভিশাপ নয় বা দৈব কোনো রোগ নয়। মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি অসুখ, যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের শিশু এমনকি বয়স্ক মানুষেরও এটা হতে পারে।

পানিতে নামতে না দেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুদের গাছে চড়তে দেওয়া ঠিক নয়। যেসব শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে, তাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর স্রোত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি

নিয়ত ঠিক থাকলে অবশ্যই সম্ভব। ২০১৯ সালে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ৮৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।

গ্রামে আগে শিশুদের কোমরে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টি বেঁধে দেওয়া হতো। এটা কোনো অলংকার ছিল না। কর্মব্যস্ত মায়ের কান থাকত সেই ঘণ্টির দিকে। সচেতন অভিভাবকেরা বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারেন। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন প্রয়োজন এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে স্থানীয় অভিভাবক ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

লেখক গবেষক: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ