জামালপুরে সমবায় সমিতির লোভে পড়ে পথে বসেছেন মধ্যম ও নিম্ন আয়ের ৩৫ হাজার মানুষ
Published: 5th, February 2025 GMT
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায় ভিন্ন দুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন মো. রেজাউল মাসুদ ও তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর যে টাকা পেয়েছেন, তা থেকে ৫৬ লাখ টাকা পার্শ্ববর্তী মাদারগঞ্জ উপজেলার আল-আকাবা সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সংস্থায় জমা রাখেন এই দম্পতি। কিন্তু ২০২২ সালের শেষের দিকে এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যান উদ্যোক্তারা। সারা জীবনের কষ্টে জমানো এই সঞ্চয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে রেজাউল মাসুদ আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। টাকার অভাবে একরকম বিনা চিকিৎসায় গত বছরের ১৭ মে তিনি মারা যান।
মো.
মনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোভে পড়ে ওই সমিতিতে আমার স্বামীর নামে ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ও আমার নামে ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা সঞ্চয় করেছিলাম। হঠাৎ একদিন জানতে পারি, সমিতির লোকজন সব বন্ধ করে চলে গেছেন। এই খবরে আমার স্বামী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। টাকার অভাবে তাঁর চিকিৎসাও করাতে পারছিলাম না। সমিতির লোকজনের সঙ্গে অনেক যোগাযোগ করেছি, কিন্তু তাঁদের আর পাইনি। একরকম বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। আমরা একদম পথে বসে গেছি।’
২০২২ সাল থেকে গত বছরের মধ্যে মাদারগঞ্জ উপজেলায় আল-আকাবাসহ ২৩টি সমিতি বন্ধ হওয়ার খবরে মো. রেজাউল মাসুদের মতো আবদুল হামিদ ও সবর আলী নামে দুজন গ্রাহক অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ ছাড়া মো. শাহীন মিয়া, শাহনাজ পারভীন, আক্তারুন্নেসা, সুজা মিয়া ও রাকিবা সুলতানা স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হলেও আর্থিক সংকটে চিকিৎসার খরচ চালাতে পারছেন না। তাঁদের মতো আরও অনেকেই এসব সমিতিতে টাকা সঞ্চয় করে এখন সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
জেলা সমবায় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভুক্তভোগী এমন গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। বেশির ভাগই মাদারগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে পোশাকশ্রমিক, প্রবাসী ও তাঁদের স্ত্রী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, গৃহকর্মী, দিনমজুর ও চাকরিজীবীরা আছেন। এসব গ্রাহকের ৭৩০ কোটি টাকা সমিতিগুলোর কাছে ছিল।যদিও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের দাবি, টাকার পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।
জেলা সমবায় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মাদারগঞ্জ উপজেলায় ১৬৩টি সমিতির নিবন্ধন দেওয়া আছে। ২০২২ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কারণে ৭৪টি সমিতির কার্যক্রম প্রায় বন্ধের পথে। উদ্যোক্তারা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ করে আত্মগোপনে আছেন। ওই সব সমিতির মধ্যে জেলা সমবায় কার্যালয় ২৩টি সমিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সমিতিগুলো হলো আল-আকাবা, শতদল, স্বদেশ, হলি টার্গেট, নবদীপ, রংধনু, আল-আকসা, পরশমণি, স্বপ্ন তরী, মাদারগঞ্জ সেবা, আশার আলো, রূপালী বাংলা, শ্যামল বাংলা, জনকল্যাণ, মাতৃভূমি কৃষি উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, মিতালী কৃষি উন্নয়ন, স্বাধীন বাংলা কৃষি, অগ্রগামী কৃষি উন্নয়ন, আমানত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দারিদ্র্য শ্রমজীবী, আল ইনসাফ শ্রমজীবী ও জনতা শ্রমজীবী। এগুলোর মধ্যে আল-আকাবা, শতদল, স্বদেশ, নবদীপ, হলি টার্গেট ও রংধনু সমিতির কাছে জমা আছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বেশি।
আমানতের টাকা ফিরে পেতে গতকাল মঙ্গলবার সকালে প্রথমে মাদারগঞ্জ উপজেলা শহরের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জড়ো হন কয়েক হাজার গ্রাহক। সেখানে সমাবেশের পর দুপুর ১২টার দিকে তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় ঘেরাও করে। বেলা তিনটা পর্যন্ত তাঁরা ইউএনওর কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছিলেন। ‘মাদারগঞ্জে বিভিন্ন সমবায় সমিতিতে আমানতকৃত অর্থ উদ্ধারের জন্য সহায়ক কমিটি’ ব্যানারে তাঁরা এ কর্মসূচি পালন করছেন।
ভুক্তভোগীরা যা বলছেনমাদারগঞ্জ উপজেলার একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমি বিক্রি, চাকরি থেকে ঋণ ও বোনেরসহ নিজের যা সঞ্চয় ছিল, সব মিলিয়ে ৭২ লাখ টাকা আল-আকাবা ও নবদীপ সমিতিতে রেখেছিলাম। ২০ লাখ টাকা ওঠাতে পেরেছিলাম। বাকি টাকা আর পাচ্ছি না। এখন আমি একদম নিঃস্ব। আমার মতো প্রত্যেকটি মানুষ আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে। অথচ প্রশাসনের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।’
উপজেলার বানিকুঞ্জ গ্রামের হতদরিদ্র ফুলেরা বেওয়ার (৬৫) স্বামী নুরুল ইসলাম অনেক বছর আগে মারা যান। তিনি ঝিয়ের কাজ করে অল্প অল্প করে কিছু টাকা জমিয়ে শতদল সমবায় সমিতিতে জমা রেখেছিলেন। অন্যান্য সমিতির মতো শতদলও পালিয়েছে। এত টাকার সঞ্চয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ফুলেরা বেওয়া। তিনি বলেন, ‘বাপু, আমার সব টেহা (টাকা) নিয়ে গেছে। কত ঘুরতছি। কেউ টেহা দেয় না।’
বানিকুঞ্জ গ্রামের আরেক বাসিন্দা আসমা বেগমের (৪০) স্বামী মারা যান ২৪ বছর আগে। এর পর থেকে জীবন চালাতে রীতিমতো লড়াই করে যাচ্ছেন। কখনো পোশাক কারখানায় কাজ করেছেন, কখনো দরজির কাজ করেছেন। খেয়ে না–খেয়ে কিছু কিছু করে টাকা জমা রাখতেন আল-আকাবা, শতদল, নবদীপ ও সমাজ উন্নয়ন নামের সমিতিতে। স্থায়ী আমানত, সঞ্চয়সহ তাঁর এখন পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সমিতিগুলোর উদ্যোক্তারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় সবার মতো তিনিও পথে বসেন। আসমা বলেন, ‘আমাদের অনেক কষ্টের টাকা। খেয়ে না–খেয়ে যা পেয়েছি, তা ওখানে জমা করেছি। এখন আমি পথের ফকির। পাগলের মতো টাকার জন্য শুধু ঘোরাঘুরি করছি, কিন্তু টাকা পাচ্ছি না।’
লক্ষ্য ক্ষুদ্র আয়ের লোকজনসমবায় অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে মূলত সমবায় সমিতি গড়ে তোলা হয়। সহজ শর্তে ঋণদান কর্মসূচিও থাকে তাদের। সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ে অধিক হারে মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের লোকজনকে টার্গেট করে থাকে এসব সমবায় সমিতি। যেখানে সাধারণ সঞ্চয়, স্থায়ী আমানত, ডিপিএসের মতো সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের সুদ মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ, সেখানে এসব সমবায় প্রতিষ্ঠান ক্ষেত্রবিশেষে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিত। এ কারণে লোকজন বেশি আকৃষ্ট হন। রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও পোশাকশ্রমিকের পাশাপাশি সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, প্রবাসী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সমিতিগুলোর শিকার হয়েছেন।
গ্রাহকের টাকায় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগগ্রাহকের টাকা নিয়ে আত্মগোপনে চলে যাওয়া সমিতিগুলোর উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছেন। আত্মগোপনে থেকেই তাঁরা এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্বিঘ্নে পরিচালনা করে যাচ্ছেন। কিন্তু গ্রাহকের একটি টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। তাঁদের বিনিয়োগ করা ক্ষেত্রের মধ্যে আছে লেয়ার ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, ফিড ব্যবসা, গ্যাস সিলিন্ডার, ড্রেজার ব্যবসা, স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ল্যান্ড অ্যান্ড হাউজিং, মেডিসিন ব্যবসা, স্টক ব্যবসা, মিষ্টির দোকান, হোটেল, কনস্ট্রাকশন, ইটভাটা, ঠিকাদারি, হাসপাতালের শেয়ার ক্রয়, খামার, অ্যাগ্রো ফার্ম, মৎস্য প্রকল্প, রাইস মিল, বেবি শপ, অফসেট প্রেস, গাড়ি ও জমি ক্রয়।
টাকা উদ্ধারে কমিটিমাদারগঞ্জে বিভিন্ন সমবায় সমিতিতে আমানতকৃত অর্থ উদ্ধারের জন্য উপজেলার বালিজুড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শিবলুল বারীকে আহ্বায়ক করে ৫১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি গ্রাহকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
কমিটির সদস্যদের দাবি, শুধু মাদারগঞ্জ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের মধ্যে একটি হিসাব করে দেখা গেছে, প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা সমিতিগুলোতে আছে। এ ছাড়া ইসলামপুর, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ী ও জামালপুর সদরের কয়েক হাজার গ্রাহকও আছেন। ফলে টাকার পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। ফলে সমবায় অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাবে ভুল আছে।
কমিটির আহ্বায়ক শিবলুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাওনা আদায়ে প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে ভুক্তভোগীরা ভিড় জমাচ্ছেন। বিক্ষোভও করছেন তাঁরা। আমানতের টাকা ফেরত পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। কিন্তু সমববায়সহ স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ন্যূনতম সহযোগিতা করছে না। সবার মধ্যে এমন একটা ভাব, সমিতিগুলোতে টাকা রেখে গ্রাহকেরাই বড় অপরাধ করেছেন।’
দায় এড়াতে পারে না সমবায় কার্যালয়সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে অধিক মুনাফার প্রলোভন দিয়ে বিপুলসংখ্যক গ্রাহক সংগ্রহ করে সমিতিগুলো। অধিক মুনাফার আশায় গ্রাহকেরা সঞ্চিত অর্থ সমিতিগুলো রাখেন। প্রথম দিকে মুনাফা দিয়ে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করে সমিতিগুলো। একপর্যায়ের সমিতিগুলো ঋণদান কর্মসূচির পাশাপাশি পুরোপুরি অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। এসব কার্যক্রম প্রকাশ্যে চললেও সমবায় দপ্তর বা স্থানীয় প্রশাসন কখনোই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
মাদারগঞ্জে ৩৫ হাজার মানুষকে যখন সর্বস্বান্ত করে সমিতির উদ্যোক্তারা পালিয়েছেন, তখনো সমবায় বা স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের টাকা উদ্ধারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো তারা ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের দোষারোপ করছে এই বলে, কেন তাঁরা এত টাকা সেখানে রেখেছেন।
জামালপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সম্প্রতি এই জেলায় যোগদান করেছি। এই দায় আমাদের যেটুকু, তার চেয়ে বেশি গ্রাহকদের। একটি সমিতিতে এভাবে কেউ কখনো টাকা রাখে না। কোনো গ্রাহক সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে কখনোই অভিযোগ করেননি। হ্যাঁ, এটা ঠিক, সব সমিতি একরকম ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তবে টাকা উদ্ধারের বিষয়ে আমাদের তেমন কিছুই করার নেই। আমরা শুধু ওই সব সমিতির নিবন্ধন বাতিল করতে পারি।’
এই মুহূর্তে সমিতিগুলোর নিবন্ধন বাতিল করা যাচ্ছে না মন্তব্য করে আবদুল হান্নান বলেন, ‘নিবন্ধন বাতিল হলে সমিতির উদ্যোক্তাদের জন্যই ভালো হয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের সঙ্গে আমরা সব সময় যোগাযোগ করে, টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য সমিতির উদ্যোক্তাদের চিঠি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা কোনো টাকা না দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে।’
আল-আকাবা বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. হুমায়ুন আহম্মেদ, শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মোস্তাফিজ, স্বদেশ বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আনিছুর রহমান ও নবদীপ সমবায় সমিতির সভাপতি ইব্রাহিম খলিল দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে আছেন। তাঁদের মুঠোফোন নম্বরগুলোও বন্ধ আছে। ফলে গ্রাহকের টাকা লোপাট করে পালিয়ে থাকার বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম দ রগঞ জ উপজ ল র গ র হক র ট ক র ব যবস ব যবস য় কর ছ ন ন বন ধ র জন য র একট ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।