‘হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছি’– মঙ্গলবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতীয় নারী ফুটবলার মাতসুশিমা সুমাইয়ার এমন স্ট্যাটাস ক্রীড়াঙ্গনে আলোড়ন তুলেছে। ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার ইস্যুতে যে ১৮ ফুটবলার বিদ্রোহ করেছেন, সুমাইয়ার স্ট্যাটাসের পর সবাই জানতে উদগ্রিব হয়ে আছেন বাফুফে ক্যাম্পে কেমন আছেন মেয়েরা? 

সেটা জানার চেষ্টায় একে একে অধিনায়ক সাবিনা খাতুন, সাফের সেরা ফুটবলার ঋতুপর্না চাকমাসহ আরও অনেকের মোবাইলে ফোন দিলেও সাড়া মেলেনি। তবে ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাঠানো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী ফুটবলারের মেসেজ দেখেই স্পষ্ট কতটা ট্রমার মধ্যে আছেন তারা– ‘কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় নেই আমি। যাদের মানসিক অবস্থায়ই ভালো নেই, তারা আর কতটা নিরাপত্তায় থাকতে পারে? মানসিকভাবে অসুস্থ্যতাবোধ করছি আমরা সবাই। ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি প্রতিটা মিনিট।’

নেপালে অনুষ্ঠিত নারী সাফ থেকে পিটার বাটলারের সঙ্গে সিনিয়র ফুটবলারদের দ্বন্দ্বের শুরু। শিরোপা জেতার পর সবাই ভেবেছিল সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গত সপ্তাহে বাটলারের ডাকা মিটিংয়ে সাবিনা–মনিকারা সাড়া না দেওয়ার পরই পরিষ্কার হয়ে যায়, আদতে কোচ-ফুটবলারদের মধ্যে দ্বন্দ্বের মিটমাট হয়নি। এরপর কোচের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তুলে ধরে তিন পৃষ্ঠার বিবৃতি সংবাদ মাধ্যমের কাছে উপস্থাপন করেন মেয়েরা। মেয়েদের বিদ্রোহের পর বিশেষ কমিটিও গঠন করে বাফুফে। রোব এবং সোমবার ১৮ ফুটবলার বাটলারের বিরুদ্ধে তাদের যুক্তিগুলো কমিটির সদস্যদের জানান। আন্দোলনের কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় মেয়েদের সমালোচনার সঙ্গে ব্রিটিশ কোচ বাটলারের পক্ষ নিতে দেখা যায় অনেককে। 

যে দেশকে সাফের শিরোপা এনে দিয়েছেন সেই দেশের মানুষকে পাশে না পাওয়ায় হতাশাটা লুকিয়ে রাখতে পারেননি ওই নারী ফুটবলার,‘ফেসবুকের কিছু ভুয়া নিউজ, কিছু গ্রুপের পেজের ভুয়া নিউজ কীভাবে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে, সেটা দেখে খুবই অবাক হচ্ছি। যেগুলো আমাদের মুখ থেকে কখনো বেরই হলো না সেগুলো আন্দাজে তারা কিভাবে লেখালেখি করছে, সেটাই আমাদের মাথায় আসছে না।’ 

শুধু নিজেরাই নন, সামগ্রিক বিষয়টি ফুটবলারদের পরিবারেও প্রভাব ফেলেছে,‘আমাদের ফ্যামিলির ওপর দিয়েও কী যাচ্ছে, সেটা শুধু আমরাই জানি। আমরা কি সবসময় মুখ বুঝে মেনে নেব? কোনো অভিযোগ করা যাবে না। অভিযোগ করলে উল্টো আমাদেরই দোষ খুঁজে বের করা হয়।’ 

এই নারী ফুটবলারের মতো সুমাইয়ার স্ট্যাটাসেও স্পষ্ট– মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা, ‘আমি জানি না, এই মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আমার কত সময় লাগবে। তবে এটা বলতে চাই, শুধু তাদের স্বপ্ন অনুসরণ করার জন্য আর কাউকে যেন এর মধ্য দিয়ে যেতে না হয়।’ সুমাইয়ার লেখা পোস্টটি বেশ কয়েকজন নারী ফুটবলারকে শেয়ার করতে দেখা গেছে। তাতে স্পষ্ট– আন্দোলনে তারা কতটা একাট্টা আছেন। 

বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালকে লেখা একটা ইংরেজি চিঠিই হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি পাওয়ার বড় কারণ বলে গতকাল সমকালকে জানিয়েছেন জাপানি বংশোদ্ভূত ফুটবলার সুমাইয়া। বাংলায় কেন চিঠি লেখেননি– এই বিষয়টি এভাবে পরিষ্কার করেছেন তিনি,‘যখন আমরা কোনো পত্র লিখি, সেখানে শুরু করতে হয় ‘টু দ্য প্রেসিডেন্ট’। তখন আমাদের যেকোনো প্রয়োজনে ইংলিশে চিঠি লিখতে হয়। আমি সেভাবেই লিখেছি।’ শুধু সুমাইয়াই নয়, আরও কয়েকজন নারী ফুটবলার বিভিন্নভাবে হুমকি পাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে বাফুফে ক্যাম্প ছেড়ে বাসায় চলে যাওয়া সুমাইয়াকে ভবনে ফিরতে না করার অভিযোগ উঠেছে নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণের বিরুদ্ধে। সুমাইয়ার বাবাকে নাকি ফোন করে এমনটা জানিয়েছেন কিরণ। এই বিষয়ে জানতে সুমাইয়ার মোবাইলে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। কিরণের কাছ থেকেও সাড়া মেলেনি। ক্যাম্পে থাকা মেয়েদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার জানান, ‘মেয়েরা আমাদের জাতীয় দলের ফুটবলার। তাদের দেখভালের দায়িত্ব  আমাদের। এটা বড় একটা অভিযোগ। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি আমরা। তাদের যারা হুমকি দিয়েছে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।’

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন র ফ টবল ফ টবল র

এছাড়াও পড়ুন:

লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা

লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।

আরো পড়ুন:

আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা

চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।

তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।

শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।

তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।

তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।

ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।

রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”

“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”

“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”

টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”

“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।” 

সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ