হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালীন একটি বছরকে বলা হতো ‘আম উর রামাদা’ বা ‘ছাইয়ের বছর’। সেটি ছিল হিজরির অষ্টাদশ বছর। অর্থাৎ মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের সাত বছর পর।

সে বছর সিরিয়া ও তার আশপাশের অঞ্চলে প্লেগের সংক্রমণ শুরু হয়। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে অনেক খ্যাতনামা সাহাবি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হজরত উবায়দা (রা.

) এবং হজরত আবু মালিক আর আশয়ারী (রা.) মতো সাহাবিরা। বিখ্যাত সাহাবি হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) এই প্লেগ এ আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছিলেন।

মৃত্যুর সময় মুয়াজ (রা.)-এর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৩ বছর। জীবিত অবস্থায় তিনি ছিলেন আরবের মুফতি। তিনি ওহি লেখকের দায়িত্বও পালন করেছেন। মহানবী (সা.) নিজেই তাঁকে বলেছিলেন, ‘হে মুয়াজ, আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি।’

আরও পড়ুনআত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না৩০ নভেম্বর ২০২৩

প্লেগ সংক্রমণের সময় মুয়াজ (রা.) ফিলিস্তিনে ছিলেন। সেখানেই তিনি আক্রান্ত হন। প্লেগে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বলছিলেন, ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, এটা হলো নবী (সা.)-এর দোয়ার ফসল। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের এভাবেই উঠিয়ে নেন। যাঁরা প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তাঁরা শহীদ।’

মহানবী (সা.) একবার দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি মুয়াজ ও তাঁর পরিবারকে আপনার রহমতের সবচেয়ে বড় অংশটি দান করুন।’ মুয়াজ (রা.) ঠিকই বুঝেছিলেন, আল্লাহর রহমতের সবচেয়ে বড় অংশ তাঁরাই পাবেন, যাঁরা দুনিয়াতে কষ্টের ভেতর থাকেন।

কিছুদিনের মধ্যেই মুয়াজ (রা.)-এর প্রিয়তম সন্তান আবদুর রহমান অসুস্থ হয়ে পড়েন। মুয়াজ (রা.)-এর বয়স যদি ৩৩ হয়ে থাকে, তাহলে আবদুর রহমানের বয়স ছিল আরও অনেক কম। তিনি খুবই নেককার সন্তান ছিলেন।

অসুস্থ অবস্থায় মুয়াজ (রা.) আবদুর রহমানকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আমার পুত্র, তুমি এখন কেমন আছ?’

আরও পড়ুনজীবনযাপন করতে হবে যেন ভ্রমণে এসেছি২৯ নভেম্বর ২০২৩

আবদুর রাহমান কোরআনের মাধ্যমে জবাব দিয়েছিলেন, আলহামদুলিল্লাহ। ‘প্রকৃত সত্য আপনার প্রতিপালকের থেকে আসে সুতরাং আপনি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৭)

মুয়াজ (রা.) জবাব দিলেন, ‘ইনশা আল্লাহ। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন’। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৩)

বোঝাই যাচ্ছে এই পিতা-পুত্রের মধ্যে কতটা মধুর সম্পর্ক ছিল। এটাই ছিল তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ কথোপকথন। এরপর আবদুর রহমান মারা যান। পরদিন সকালে মুয়াজ (রা.) সন্তানের জানাজা সম্পন্ন করলেন।

এরপর তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুস্থতা এবং দুঃখ একসঙ্গে যেন তাঁকে জড়িয়ে ধরল। কিছু বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি অসুস্থ অবস্থায় লম্বা সময় পর্যন্ত অচেতন হয়ে পরে থাকতেন। যখন জ্ঞান ফিরত, তখন জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতেন।

অসুস্থ অবস্থায় তিনি একটি দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, যা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন, তা দিয়েই আমাকে শেষ করে দিন। আপনি তো জানেন, আমার অন্তরে আপনার ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেই।’

আরও পড়ুনজান্নাতে প্রবেশ ও জাহান্নাম থেকে নাজাতের উপায়২৯ নভেম্বর ২০২৩

জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে তিনি কিছু কথা বলেছিলেন, ‘হে মৃত্যু, তোমাকে স্বাগতম। হে আমার মেহমান, তুমি ঠিক তখনই আমার কাছে এলে, যখন তোমাকে দরকার ছিল। হে আল্লাহ, আমি একসময় আপনাকে অনেক ভয় করতাম, আজ আমি আপনার কাছে আসার জন্য পাগল হয়ে আছি। হে আল্লাহ, আপনি তো জানেন দুনিয়াতে আমি কখনো রাজার হালে থাকতে আসিনি। এই পৃথিবীতে আমি সেই লম্বা রাতগুলো পছন্দ করতাম, যে রাতে আপনার ইবাদত করে কাটিয়ে দিতাম। সারা দিন ধরে রোজা রাখতাম। আর আপনার বিজ্ঞ বান্দাদের কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করতাম। শুধু জিনিসগুলোই আমি পছন্দ করতাম। আপনি তো জানেন, আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি।’

এরপর মুয়াজ (রা.) চলে গেলেন। কোরআন ও আল্লাহর প্রশংসা দিয়েই পিতাপুত্রের জীবনাবসান ঘটেছিল।

অনুবাদ: সাজিদ আল মাহমুদ

আরও পড়ুনরুমির মুদিদোকানি ও তোতা পাখির গল্প২৮ নভেম্বর ২০২৩

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আবদ র রহম ন কর ছ ল ন অবস থ য় আল ল হ আপন র করত ম

এছাড়াও পড়ুন:

দোয়ার ফজিলত ও আদব

দোয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ আহ্বান করা বা প্রার্থনা করা। পরিভাষায় দোয়া হলো কল্যাণ ও উপকার লাভের উদ্দেশ্যে এবং ক্ষতি ও অপকার রোধে মহান আল্লাহকে ডাকা এবং তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।

প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘দোয়াই ইবাদত।’ (বুখারি ও মুসলিম) ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কিছু চায় না, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন।’ (তিরমিজি: ৩৩৭৩)

আল–কোরআনের বর্ণনা, ‘আর তোমাদের রব বলেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৬০)

মুমিনের পরিচয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। কেউ জানে না তার কৃতকর্মের জন্য তাদের কী কী চোখজুড়ানো প্রতিদান লুকায়িত আছে।’ (সুরা-৩২ সাজদা, আয়াত: ১৬-১৭)

‘আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে, আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই। কাজেই তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ইমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৬)

দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত হলো হালাল উপার্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎকাজ করো; তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা-২৩ মুমিনুন, আয়াত: ৫১)

দোয়া ও আমল কবুল হওয়ার মূল শর্ত হলো ইখলাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। অতএব, তাঁকে ডাকো খাঁটি ইবাদতের মাধ্যমে।’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৬৬)

দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত হলো হালাল উপার্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎ কাজ করো; তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা-২৩ মুমিনুন, আয়াত: ৫১) ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পাক পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার করো, যেগুলো আমি তোমাদের রিজিক হিসেবে দান করেছি।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৭৩)

নবীজি (সা.) বলেন, ‘উষ্কখুষ্ক ধুলায় ধূসরিত অবস্থায় দীর্ঘ সফরকারী একজন যে স্বীয় দুই হাত আকাশের দিকে প্রসারিত করে বলে, “হে প্রভু! হে প্রভু!” অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং সে হারাম দ্বারা লালিত, তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?’ (মুসলিম: ১৬৮৬)

নির্জনে নীরবে বিনয়ের সঙ্গে দোয়া করা উত্তম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাকো কাকুতি মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৫)। পৃথিবীকে কুসংস্কারমুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না। তাকে আহ্বান করো ভয় ও আশাসহকারে। নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৫-৫৬)

দোয়ার আদব হলো দৃঢ়সংকল্প ও আকুতির সঙ্গে দোয়া করা, দোয়া কবুলে প্রবল আশাবাদী হওয়া।

হজরত জাকারিয়া (আ.) তাঁর দোয়ায় বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনার কাছে দোয়া করে আমি কখনো ব্যর্থ হইনি।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৪) হজরত ইব্রাহিম (আ.) বলেন, ‘আশা করি, আমার প্রতিপালকের নিকট দোয়া করে আমি বিফল হব না।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৪৮)

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দোয়ার ফজিলত ও আদব