সরকারের আশ্বাসে নির্বাচনী জট খুলল, না বাড়ল?
Published: 15th, February 2025 GMT
তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন? জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন কবে পাবে? ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি পারবে না?
এসব প্রশ্নের মীমাংসার আগেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন নিয়ে নানাভাবে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। কেউ মনে করেছেন, যত দ্রুত নির্বাচন হওয়া ভালো। কেউ ভাবছেন, নির্বাচন দেরিতে হলে তারা দল গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
প্রশ্ন হলো নির্বাচনটি কবে হবে? জাতীয় না স্থানীয়—কোন নির্বাচন অগ্রাধিকার পাবে?
অন্তর্বর্তী সরকার ডিসেম্বরকে ডেটলাইন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হবে বলে আশা করছেন। এর আগে তিনি জাপানি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও একই কথা বলেছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়টি রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের ঐকমত্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে কোনো বিষয়েই একমত হতে পারে না, সেখানে নির্বাচনের দিনক্ষণ কিংবা সংস্কারের পরিধি নিয়ে একমত হতে পারবে কিনা সেই প্রশ্নও আছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী প্রায় সব প্রশ্নে ঐকমত্য পোষণ করত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারা ও মাঠ ছাড়া হওয়ার পর দল দুটি বলতে গেলে কোনো বিষয়েই একমত হতে পারছে না। একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।
বিএনপির দাবি, সবার আগে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। জামায়াত বলছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনই আগে হওয়া বাঞ্ছনীয়। ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক কমিটিও সবার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে জোর প্রচার চালাচ্ছে। এই সংগঠনের এক নেতা বলেছেন, বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করলে তারাও জাতীয় নির্বাচন করতে পারবে না। ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আওয়াজ দিয়ে এখন সবাই চুপচাপ। এই সরকারের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে কি না সন্দেহ আছে।
এই প্রেক্ষাপটে শনিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে বৈঠক আহ্বান করেছে, তা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করবে কি না, তা অনেকটা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলের ওপর। তারা একমত হলে নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে না।
যদি একমত না হতে পারে?
বিএনপির নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা নির্বাচন কমিশনের কাছে গেছেন। জামায়াতের নেতারাও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে দাবিনামা দিয়ে এসেছেন। এর পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াত নিজেদের শক্তি বাড়াতে সহযোগী দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করছে।
দ্য ডেইলি স্টার–এর প্রধান শিরোনাম: বিএনপি, জামায়াত অন কলিশন’ বা ‘দ্বন্দ্বের পথে বিএনপি-জামায়াত’।
এতে বলা হয়, ‘বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে টানাপোড়েন এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ এবং সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা নিয়ে মতবিরোধের কারণে। গত সপ্তাহে এই বিরোধ প্রকাশ্যে আসে, যখন দুটি দল একে অপরের বিপরীতে অবস্থান নেয়। বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন চায়। দলটি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার বিপক্ষে তাদের অবস্থানের কথা নিশ্চিত করেছে।’
উল্লেখ্য, আনুপাতিক ভোটের দাবিটি প্রথম আসে বামপন্থী দলগুলোর কাছ থেকে। এরপর জাতীয় পার্টিও আনুপাতিক ভোটের কথা বলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে বিভিন্ন কমিশন করলে আনুপাতিক নির্বাচনের দাবিটি জোরদার হয়। কিন্তু বিএনপি সাফ জানিয়ে দেয়, তারা নতুন পদ্ধতি মেনে নেবে না। সংবিধান বা নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও এ বিষয়ে বড়ধরনের সংস্কারের প্রস্তাব করেনি।
সংবিধান সংস্কার কমিশন উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালুর কথা বলেছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন একটি জরিপের বরাত দিয়ে বলল, ৯০ শতাংশ মানুষ জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন চায়। এখন যদি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন আগে করার সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে কি আমরা ধরে নেব, ৯০ শতাংশ মানুষের বিপক্ষে এটি হয়েছে?
২০১৩ সালের ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। ২০১৮ সালে তারা নির্বাচন করেছে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে। ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে হলে তাদের নিবন্ধন ফেরত পেতে হবে। জামায়াত নেতারা আশা করছেন, শিগগিরই তারা নিবন্ধন পেয়ে যাবেন।
নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বিএনপির প্রধান বাধা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে না আসতে পারা। আর জামায়াতের বড় বাধা নিবন্ধন না থাকা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, শিগগির তাদের নেতা দেশে ফিরে আসছেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস পরও এ বিষয়ে কোনো সুসংবাদ নেই।
প্রধান উপদেষ্টা দ্য ন্যাশনালকে বলেছেন, ‘আমরা এসব সুপারিশ নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলো ও সুশীল সমাজের কাছে জানতে চাইব যে আপনারা এখন কোনটা বাস্তবায়ন করতে চান, আর কোনটা আপনারা ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করতে চান এবং কোনটা একেবারেই বাস্তবায়ন করতে চান না।’
সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সেই বৈঠকে তারা তাদের মতামত জানাবে। কিন্তু নাগরিক সমাজ কীভাবে মতামত জানাবে? তাদের সঙ্গে আলোচনাটি হবে কীভাবে? নাগরিক সমাজের একাংশ সরকারেই আছে। তারা নিজেরা কোনো অবস্থান নিতে পারবেন কি না? দ্বিতীয়ত সরকারের বাইরের নাগরিক সমাজের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকবে কি না? তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারবে কি না।
জামায়াত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার কথা বলেছে। কেননা এ ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক থাকবে না। নিবন্ধনেরও প্রয়োজন হবে না। আর জাতীয় নাগরিক কমিটির স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চাওয়ার কারণ, এর মাধ্যমে তারা প্রস্তাবিত দল গুছিয়ে নিতে পারবে। অন্য দলের সমর্থন না পাওয়া প্রার্থীদের নাগরিক কমিটিতে টানার সম্ভাবনাও আছে। নাগরিক কমিটির একজন নেতা ইতিমধ্যে দলীয় পদ ছেড়ে ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক হয়েছেন। এতে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অন্যান্য দল প্রকাশ্যে না বললেও কোনো বিষয়ে তাদের দৃঢ়মত আছে বলে মনে হয় না। তাদের মূল লক্ষ্য জাতীয় নির্বাচনে সমঝোতা বা আসন ভাগাভাগি করে হলেও নিজের অবস্থান সংহত করা। বিএনপি যেহেতু জাতীয় নির্বাচনের পর জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে তাদের সেই জাতীয় সরকারের অংশীদার হতেও বাধা থাকবে না।
মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের ভোটের মাধ্যমে আসেনি; বরং তিনটি নির্বাচনে জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় জনমনে যে ক্ষোভ ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জুলাই আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে। আর এই সরকার হলো সেই অভ্যুত্থানের ফসল।
২০০৭ সালের ১/১১–এর পর যে সরকার গঠিত হয়েছিল, তাদের একটি রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল। তারা নিজেরাই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল। এ কারণে নিজেদের ক্ষমতার ভিত শক্তিশালী করতে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করেছিল। এর আগে সত্তর ও আশির দশকে দুই সেনা শাসকও একই কাজ করেছেন। এই সরকারের যেহেতু কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই, সে ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচনে যাওয়া উচিত হবে কি না, সেটাও ভেবে দেখতে হবে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অবস থ ন সরক র র ব এনপ র ব যবস থ ঐকমত য র বর ত আওয় ম ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট, একমত ইউনূস ও তারেক
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিতে টানাপোড়েন যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছিল, লন্ডন বৈঠকে তা অনেকটা কেটেছে।
গতকাল শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা আসে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের রমজান মাসের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে লন্ডন বৈঠক নিয়ে দেশে যে কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা ছিল, সেটার সমাপ্তি ঘটেছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। এর মধ্যেই ৬ জুন ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারপ্রধানের এই ঘোষণা বিএনপি মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে দলটির নেতারা প্রকাশ্যেই অসন্তুষ্টির কথা জানান। অবশ্য সরকার–ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের জন্য উপদেষ্টাদের কেউ কেউ জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে অধ্যাপক ইউনূসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এপ্রিলকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের এক সপ্তাহের মাথায় লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নতুন ঘোষণা এল। ধারণা করা হচ্ছে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট হতে পারে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ঘটনাকে বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। দলগুলো বলেছে, এর মাধ্যমে জাতি ‘স্বস্তির বার্তা’ পেয়েছে।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে অনেকের দুর্ভাবনা ছিল। সেটা কেটে গেছে, গোটা জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। অধ্যাপক ইউনূস দুঃসময়ে জাতির অভিভাবক হিসেবে নিজের বিশালত্ব, গভীরতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি নেতা তারেক রহমানও যথোচিত সৌজন্যবোধ, পরিণত বুদ্ধি ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বলেন, বিচার বা সংস্কার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির বড় ধরনের মতপার্থক্য নেই। মতপার্থক্য ছিল নির্বাচনের সময় নিয়ে। দুজনের (ইউনূস-তারেক) বৈঠকের পর এই মতপার্থক্যও অনেকটা কমে এসেছে।
যদিও লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে যে প্রক্রিয়ায় সমঝোতা হয়েছে এবং সেটি যেভাবে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের ভিন্নমত নেই। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের সমঝোতায়ও তাঁরা অসন্তুষ্ট নন। তাঁদের প্রশ্ন এক জায়গায়। সেটি হচ্ছে, সরকার এভাবে একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দিতে পারে কি না? এটা কতটা নৈতিক।
লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে এনসিপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচনসংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
এ বিষয়ে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
গতকাল যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে সেখানকার সময় সকাল নয়টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটা) অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। তাঁরা প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলেন। এর মধ্যে বড় একটি সময় অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান একান্তে বৈঠক করেন। পরে ওই হোটেলেই যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। একান্ত আলোচনায় দুই নেতা ‘সন্তুষ্ট’ হয়েছেন বলে তাঁরা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে যৌথ বিবৃতি (সরকার ও বিএনপি) পড়ে শোনান নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। তাতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।
প্রশ্নোত্তরে যা বললেন সরকার ও বিএনপির প্রতিনিধিপরে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক সাংবাদিক জানতে চান, তাহলে কি সরকার এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা থেকে সরে আসছে? জবাবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ ঘোষণায় এই বিষয়টি সুস্পষ্টই বলা আছে। আপনারা শুনেছেন। যদি সব কাজ সময়মতো আমরা করতে পারি এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা করা যেতে পারে।’
তাহলে নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণে সমস্যাটা কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। নির্বাচন সম্পর্কে আজকে যৌথ বিবৃতিতে আমরা বলে দিয়েছি দুই পক্ষই। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ছাড়া লন্ডন বৈঠকে আর কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এ ছাড়া সংস্কার, বিচার, জুলাই ঘোষণা নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি।
তবে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সব বিষয়ে আলোচনা তো হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা তো নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। আমরা সবাই চাই, দেশ গড়ার যে প্রত্যয় আমরা নিয়েছি, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই কাজটা করব। বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে আমরা সবাই ঐকমত্যে এসেছি, শুধু নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও সেটা আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে জুলাই সনদ নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে তো ইতিমধ্যে আলোচনা চলছে দেশে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত আছে যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে। সংস্কারের ব্যাপারেও একই উত্তর আমাকে দিতে হয় যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা সংস্কার ও জুলাই সনদ—দুটোই করব। সবার ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং আমি নিশ্চিত, খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না? জবাবে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখানে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’ এ প্রশ্নে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘এটা তাদের (এনসিপি) জিজ্ঞেস করুন। প্রতিটি দলের নিজস্ব মতামত আছে। তবে আমরা সবাইকে নিয়ে নির্বাচনটা করতে চাচ্ছি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার হত্যাযজ্ঞের বিচারপ্রক্রিয়া তিনি শেষ করতে চান এবং পরে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না, সেটা হয়ে থাকলে নির্বাচনের রূপরেখায় এর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ বিবৃতিতে এর উত্তর দেওয়া আছে। সংস্কার এবং বিচার; দুই বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে এবং আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী) যে এই অগ্রগতি আমরা নির্বাচনের আগেই দেখতে পাব।’
তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না বা তিনি কবে দেশে ফিরতে পারেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আলোচনার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না। তারেক রহমান সাহেব যখনই ইচ্ছা দেশে ফিরে যেতে পারবেন। সুতরাং এটার সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন, সময়মতো।’
সংবাদ সম্মেলনে শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘বৈঠকে আলোচনায় আপনারা কি সন্তুষ্ট?’ সমস্বরে এ প্রশ্নের জবাব দেন খলিলুর রহমান ও আমীর খসরু মাহমুদ। দুজনই বলেন, ‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট।’ এর সঙ্গে আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা তো বলছি নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ এরপর খলিলুর রহমান বলেন, ‘সন্তুষ্ট না হলে তো যৌথ ঘোষণা আসার কথা নয়।’
‘চারদিকে যে অনিশ্চয়তা ছিল, সেটা কেটেছে’অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর ঢাকায় বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বৈঠক সফল হয়েছে। সবকিছু যে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থাকে কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।
মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনের বৈঠকের পর তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। এ সময় তারেক রহমান দলের নেতা–কর্মীদের অভিনন্দন ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। একই সঙ্গে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য তাঁর মা ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানান।
বিএনপির মহাসচিব দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি (ইউনূস) তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সবকিছু একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থা কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনের দিকে ও আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।