টাকার সঙ্গে মোহরানায় স্বর্ণের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে
Published: 16th, February 2025 GMT
গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সুপারিশ
শিশুর সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক আসামি থাকলে বিচার যাতে শিশু আদালত আলাদাভাবে করতে পারেন, সে জন্য আইন সংশোধন করতে হবে।
ভিকটিম ও সাক্ষী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্য ও সম্পত্তির সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে।
তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে—এমন অপরাধ প্রথমবার সংঘটনের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে প্রবেশন আদেশ অথবা শুধু জরিমানার বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিয়ের সময় নিকাহনামায় মোহরানার পরিমাণ টাকায় নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে সমমূল্যে স্বর্ণের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। পরিশোধের সময় ওই স্বর্ণের পরিমাণের ভিত্তিতে পরিশোধযোগ্য মোহরানার অঙ্কও নির্ধারণ করতে হবে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ‘আইনের সংস্কার’ অধ্যায়ে এমন সুপারিশ রয়েছে।
প্রতিবেদনে ‘মোহরানা ধার্যের বিধান সংশোধন’ বিষয়ে বলা হয়েছে, মুসলিম আইনে প্রদত্ত মোহরানাবিষয়ক আইনগত অধিকার সুরক্ষার স্বার্থে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে অপরিশোধিত মোহরানা নির্ধারণের বিষয়টি যুক্তিসংগত ও ন্যায়সংগত নয়। এ ক্ষেত্রে বিয়ের পরে যেকোনো সময়ে এমনকি ২০–২৫ বছর পরেও বিচ্ছেদ হলে নিকাহনামায় লিখিত টাকার অঙ্কে প্রকাশিত মোহরানাকে ভিত্তি করে তা পরিশোধের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। সাধারণত পারিবারিক আদালতে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে একই নিয়মে অপরিশোধিত মোহরানা ধার্য ও পরিশোধের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো টাকার ক্রয়ক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নগামী। ফলে মোহরানা ধার্যকরণ ও পরিশোধের অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্যে অর্থাৎ তালাকপ্রাপ্ত নারীর ন্যূনতম সুরক্ষার শর্ত সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়।
সুপারিশে সংস্কার কমিশন বলেছে, এই বাস্তবতার আলোকে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১–এর ধারা ১০ সংশোধন করা প্রয়োজন যে বিয়ের সময় নিকাহনামায় মোহরানার পরিমাণ টাকায় নির্ধারণের সঙ্গে সমমূল্যে স্বর্ণের পরিমাণ (ক্যারেটসহ) উল্লেখ করতে হবে এবং পরিশোধের সময় ওই স্বর্ণের পরিমাণের ভিত্তিতে পরিশোধযোগ্য মোহরানার অঙ্ক নির্ধারণ করতে হবে। যেহেতু মোহরানা পরিশোধ করা ধর্মীয় দায়িত্ব এবং কেবল চুক্তি থেকে উদ্ভূত দায় নয়, সেহেতু মোহরানার দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে তামাদি আইন প্রযোজ্য হবে না।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল গত বছরের ৩ অক্টোবর। কমিশন তাদের ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ৩১টি অধ্যায়ে নানা সুপারিশ ও প্রস্তাব তুলে ধরেছে।
শিশু আইন সংশোধনের সুপারিশ
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর বিচার শিশু আদালত করে থাকেন। কিন্তু একই ঘটনা থেকে উদ্ভূত অপরাধে প্রাপ্তবয়স্ক আসামি ও শিশু অভিযুক্ত থাকলে শিশুর বিচার শিশু আদালত এবং প্রাপ্তবয়স্কের বিচার উপযুক্ত ফৌজদারি আদালত করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন আদালতে বিচারের ফলে প্রাপ্তবয়স্ক আসামি ও শিশুর ক্ষেত্রে অনেক সময় বিচারের ফল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই ঘটনা থেকে উদ্ভূত অপরাধে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক আসামি থাকলে তাদের বিচার যাতে শিশু আদালত আলাদাভাবে করতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সংশোধন দরকার।
কিছু অপরাধে প্রবেশন বা জরিমানা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দণ্ডবিধির অধিকাংশ ধারায় কারাদণ্ডের সঙ্গে অর্থদণ্ডের উল্লেখ আছে। এতে অনেক ছোটখাটো অপরাধেও এবং প্রথমবার সংঘটিত অপরাধেও দোষী ব্যক্তিকে আদালত কারাদণ্ড দিয়ে থাকেন। একজন অপরাধী কারাদণ্ড ভোগ করলে পরবর্তী সময়ে তার সংশোধনের সুযোগ কমে যায়। সুপারিশে সংস্কার কমিশন বলেছে, তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে—এমন অপরাধ প্রথমবার সংঘটনের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে প্রবেশন আদেশ অথবা শুধু জরিমানা দণ্ড প্রদানের বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
শাস্তিসংক্রান্ত শুনানি ও দণ্ড প্রদান নির্দেশিকা
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশে শাস্তি বা দণ্ড বিষয়ে শুনানি প্রচলিত আছে। অভিযুক্ত আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে কিংবা অপরাধ স্বীকার করে দেওয়ার পরে একটি পৃথক তারিখে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। দেশে বিচারকেরা একই অধিবেশনে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি দিয়ে কারাগারে পাঠান। সুপারিশে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধিতে শাস্তিসংক্রান্ত শুনানি পুনঃপ্রবর্তন এবং পৃথক দণ্ড প্রদান নির্দেশিকা প্রণয়ন করতে হবে।
সাক্ষী ও ভিকটিম সুরক্ষায় সুপারিশ
আমাদের বিচারব্যবস্থায় ভিকটিম (ভুক্তভোগী) ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। দেশে এখন পর্যন্ত সাক্ষীর সুরক্ষার জন্য কোনো আইন করা হয়নি। ভিকটিম একটি মামলার অন্যতম সাক্ষী। কিন্তু আমাদের দেশে একইভাবে ভিকটিমের সুরক্ষা, ভিকটিমের খরচ বা ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত বিধান নেই। ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৫ ধারাটি অপ্রতুল। এ বিষয়ে তিন দফা সুপারিশে কমিশন বলেছে, ভিকটিম ও সাক্ষীর এবং তাদের পরিবারের সদস্য ও সম্পত্তির সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর শ ধ র অপর ধ র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
কর অব্যাহতির রাস্তা সামনে কঠিন হবে
কর অব্যাহতির বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করা হবে জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, ব্যবসায়ীরা শুধু করছাড় চাচ্ছেন। তবে সামনে কর অব্যাহতির রাস্তা কঠিন হয়ে যাবে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) অডিটোরিয়ামে ‘সামষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজস্ব ব্যবস্থা’ শীর্ষক সেমিনারে এমন মন্তব্য করেন তিনি। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অর্থ উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন কর অব্যাহতি বিষয়ে নীতি তৈরি করতে। সেই নীতি আইনে প্রতিফলিত হবে। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের প্রস্তাব হলো, সরকার কিংবা এনবিআর কোনো কর অব্যাহতি দিতে পারবে না। এ ক্ষমতা যাবে সংসদের হাতে। এর মানে হলো— কারও সঙ্গে একটু ভালো সম্পর্ক হলে অথবা বোঝাতে সক্ষম হলে কর অব্যাহতি পেয়ে যাবে– এমনটা থাকছে না। কর অব্যাহতির রাস্তা সামনের দিনে কঠিন হয়ে যাবে। এই ধরনের নীতি প্রণয়নের দিকে যাচ্ছে সরকার।
তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এতদিন ব্যাপক কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এর দরকারও ছিল। এখন নতুন করে ভাবতে হবে। রাজস্ব আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। দেশের চাহিদা মেটানোর মতো রাজস্ব আয় হচ্ছে না। রাজস্ব কম কেন– সেই প্রশ্নও তুলছে জনগণ। এসব জায়গায় আরেকটু সচেতন হলে আগামী বাজেটের আকার কিছুটা ছোট হতে পারে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব আয়ের মধ্যে পরোক্ষ করের পরিমাণ অনেক বেশি, যা সভ্য দেশের লক্ষণ নয়। প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে হবে। যে পরিমাণ কর আদায় করার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। করযোগ্য সবার থেকে কর আদায় করতে না পারার কারণে করজাল সংকুচিত। কর আদায় বাড়ানোর বিষয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, একদিকে আয় বাড়ানো, অন্যদিকে নীতি-সহায়তা দেওয়ার মধ্যে ভারসাম্য আনা বড় চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সুশাসনের ঘাটতি। যার যে কাজ করা দরকার, তিনি তা করছেন না। ফলে পদে পদে ভোগান্তি হচ্ছে। সে জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। এ বিষয়ে কাজ চলছে।
তিনি বলেন, অর্থনীতির খারাপ সময়েও রাজস্ব আদায় আগের চেয়ে বাড়ছে। এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি আরও ভালো হবে। যারা কর দিচ্ছেন না, তাদের নোটিশ করা হচ্ছে। আগামী বছর থেকে কোম্পানির কর রিটার্ন অনলাইনে দাখিলের নিয়ম করা হবে।
মাসরুর রিয়াজ বলেন, রমজানের আগে নিত্যপণ্যে করছাড়, পর্যাপ্ত আমদানি এবং সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। গত জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত টাকা ছাপিয়ে যেভাবে ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে, এখন তা কমে আসছে। টাকা পাচার কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রি কমেছে। এর ফলে রিজার্ভ ইতিবাচক। তিনি বলেন, যারা ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে কর অব্যাহতি পেয়ে আসছেন, তাদের বিষয়ে এনবিআরকে নতুন করে ভাবা দরকার।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক নুরুল কবীর। ইআরএফ প্রেসিডেন্ট দৌলত আক্তার মালা সভাপতিত্ব করেন। সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সঞ্চালনা করেন।