জন-আকাঙ্ক্ষার নাম বিজ্ঞানসম্মত তিস্তা মহাপরিকল্পনা
Published: 20th, October 2025 GMT
তিস্তাপারে শুধু নয়, সারা দেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ নামের সংগঠনটি তিস্তার দুই পারে মশাল প্রজ্বালনের মাধ্যমে আগামী নভেম্বরের মধ্যে এই মহাপরিকল্পনা শুরু করার দাবি জানিয়েছে। বিপুল মানুষের হাতে মশাল প্রজ্বালন দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছে। বিএনপির একজন নেতার উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালিত হয়। দেশে-বিদেশে থাকা প্রচুর মানুষ এই দাবির পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানাচ্ছেন। দেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েও মশাল মিছিল হয়েছে।
এই জাগরণ একদিনে হয়নি। তিস্তাপারের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভাঙন ও যত্নহীনতায় বারবার বন্যায় দিশাহারা। ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’ ২০১৫ সাল থেকে মানুষকে আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করছে, অনেক বড় বড় কর্মসূচি পালন করেছে। ২০১১ সাল থেকে ‘রিভারাইন পিপল’ তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও সুরক্ষার জন্য আন্দোলনে সক্রিয় আছে। এমনকি বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাসদসহ অনেক রাজনৈতিক দলও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে লংমার্চ করেছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অনেক রাজনৈতিক দলও মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চায়।
তিস্তাপারের মানুষের মুক্তির জন্য এই মহাপরিকল্পনা জরুরি। সারা দেশে যখন তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি মেগা প্রকল্প চলমান ছিল, তখন রংপুরে কোনো মেগা প্রকল্প ছিল না। আমরা বহুভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তিন লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি তিস্তা মহাপরিকল্পনা। ওই ১০টি মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য; কিন্তু তিস্তা মহাপরিকল্পনা হলো বেঁচে থাকার প্রকল্প।
২০১৬ সালে তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণের ঘোষণা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দিলেও ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগপর্যন্ত তা চূড়ান্ত করেনি। ২০১৬ সাল থেকে মহাপরিকল্পনার কথা বলার পর তিস্তা নদীর ভাঙন রোধে সরকার আর কোনো কাজও করেনি। এই ৯ বছরে না হয়েছে মহাপরিকল্পনা, না হয়েছে তিস্তা সুরক্ষার কাজ। ফলে এই ৯ বছরে তিস্তার দুই পারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বিশেষ নির্দেশনায় এ বছর ভাঙন রোধে কাজ হয়েছে।
সবচেয়ে কার্যকর প্রযুক্তি ও নদীজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাতে হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনায়। নদীর তলদেশ এখন পার্শ্ববর্তী সমতলের চেয়ে উঁচু। সুতরাং খননের কোনো বিকল্প নেইতিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে অনেকে বিরোধিতা করেছেন। আমরা মনে করি, বিরোধিতা না করে কোথাও সীমাবদ্ধতা থাকলে তা দূর করার পরামর্শ দিলে তিস্তা অববাহিকার দুকূলের মানুষ উপকৃত হবেন। তিস্তাপারের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর শেষ অবলম্বন—বাড়ি, কৃষিজমি, বাগান, পুকুর—সব হারিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। সেই দুঃখী মানুষের কষ্ট বোঝা দরকার। ভাঙন-কবলিত দুঃখী মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায় না।
‘মহাপরিকল্পনা’য় কী আছে, তা সাধারণ মানুষ জানতেন না। তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে আমাদের পরিষ্কার দাবি—শাখা-উপশাখাসহ তিস্তা নদী, নদীপারের মানুষের কৃষি, জীববৈচিত্র্য সবকিছুর সুরক্ষা সাপেক্ষে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হোক।
বিগত সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণে তিস্তাপারের মানুষের কোনো মতামত গ্রহণ করেনি। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি তিস্তাপারের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি সেই অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন যে অন্তর্বর্তী সরকার এটি বাস্তবায়ন করতে চায়। প্রকল্প চূড়ান্ত করার আগে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিষয়ে নদীতীরের মানুষের মতামত গ্রহণের ঘোষণা দেন তিনি। এরপর তিস্তা নদীসংলগ্ন পাঁচটি জেলায় পাঁচটি গণশুনানির আয়োজন করা হয়। সেখানে নদী সংগঠক, সাংবাদিক, ভুক্তভোগীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ ছিলেন। আমিও একটি গণশুনানিতে অংশ নিয়েছিলাম।
এ ছাড়া রিভারাইন পিপলের সংগঠকেরা মিলে আমরা তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিষয়ে চীনের প্রতিনিধিসহ গণশুনানিতে আসা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। দেখেছি মহাপরিকল্পনায় অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যখন সীমাবদ্ধতার কথা বলেছি, তখন মহাপরিকল্পনা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তার নোট নিয়েছেন। আমাদের জানিয়েছেন, তাঁরা নদীতীরের মানুষের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। এরপর বিশেষজ্ঞ পর্যায়েরও একটি সভা হয়েছে।
গণশুনানি থেকে প্রাপ্ত মতামতের সমন্বয় সাধন সাপেক্ষে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি শুরু করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন পানিসম্পদ উপদেষ্টা।
সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে দেখা করে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজে তাঁদের আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। উপদেষ্টার আশাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ নভেম্বরে শুরু করার দাবিতে আন্দোলন করছেন অনেকে। অন্তর্বর্তী সরকার ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। আন্দোলনকারীরা মনে করেন, জানুয়ারিতে এ কাজের উদ্বোধন পদ্ধতিগতভাবেও কঠিন।
সবচেয়ে কার্যকর প্রযুক্তি ও নদীজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাতে হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনায়। নদীর তলদেশ এখন পার্শ্ববর্তী সমতলের চেয়ে উঁচু। সুতরাং খননের কোনো বিকল্প নেই। কোন ব্যবস্থাপনায় দ্রুত পলি অপসারিত হবে, ভাঙন রোধ হবে, নদীর জীববৈচিত্র্য সুরক্ষিত থাকবে, নদীতীরের মানুষের ক্ষতি না করে পরিবেশবান্ধব প্রকল্প হবে—এটার অনুকূলে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ কাজ কোনো অবস্থায় কঠিন নয় বলে মনে করি। তিস্তা মহাপরিকল্পনার দাবিতে গণমানুষের দাবির বাস্তবায়ন শিগগিরই হবে—এটা তিস্তাপারের মানুষের একমাত্র চাওয়া।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণশ ন ন উপদ ষ ট প রকল প স রক ষ মত মত গ রহণ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৪টি ক্রীড়া স্থাপনা উদ্বোধন, ৬টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
দেশের ১০টি জেলায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আওতায় নতুন ক্রীড়া উন্নয়নের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চারটি ক্রীড়া স্থাপনা উদ্বোধন ও ছয়টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) সচিবালয় থেকে ভার্চুয়ালি এই উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কার্যক্রম সম্পন্ন করেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
উদ্বোধিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে তিনটি মিনি স্টেডিয়াম এবং একটি সুইমিং পুল, যেখানে মোট ব্যয় হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। এছাড়া ছয়টি মিনি স্টেডিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩১ কোটি টাকা। একই অনুষ্ঠানে ১২ কোটি ৭০ লাখ ৪৭ হাজার টাকায় একটি মিনি স্টেডিয়ামের বাস্তবায়ন কাজের উদ্বোধনও করা হয়েছে।
ভোলা, মৌলভীবাজার, চরফ্যাশন এবং জুড়ী উপজেলার স্টেডিয়ামসহ অন্যান্য স্থাপনার কাজের অগ্রগতি এবং ক্রীড়া বিকেন্দ্রীকরণের পরিকল্পনা নিয়ে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা জানান, উপজেলায় এই মিনি স্টেডিয়ামগুলো খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানের স্পোর্টস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং আঞ্চলিক ক্রীড়া শাখা স্থাপনের কাজও দ্রুত বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে।
ঢাকা/এএএম/এস