বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাত থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সরকারের মেয়াদেই পাচারকারীদের কয়েকজনের বিদেশের সম্পদ জব্দ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে পরবর্তী সরকার এই সংস্কার কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে না নিলে কোনো সুফল মিলবে না। রাজনৈতিক কারণে যেন এই প্রক্রিয়া থেমে না যায়।

আজ বৃহস্পতিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (আইআরএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও অ্যাঙ্গোলা পাচারের টাকা ফেরত পেয়েছে। কোনো দেশই পাচার করা টাকা পাঁচ বছরের আগে ফেরত নিতে পারেনি। আমরা চেষ্টা করছি। আমরা চেষ্টা করে যাব, পাচারকারীদের বিদেশের সম্পদ যেন জব্দ করে যেতে পারি। শুরুটা আমরা করে দিয়ে যাব।’

ঢাকার পল্টনে ইআরএফ মিলনায়তনে ‘সেমিনার অন বাংলাদেশ ম্যাক্রোইকোনমিক ল্যান্ডস্কেপ: চ্যালেঞ্জেস ইন দ্য ব্যাংকিং সেক্টর অ্যান্ড দ্য পাথ এহেড’ শীর্ষক এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন ইআরএফের সভাপতি দৌলত আকতার মালা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সহসাধারণ সম্পাদক মানিক মুনতাসির।

আলোচনায় পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রস্তাব দেন, ৩৩ শতাংশ করে আমানতকারীর প্রতিনিধি, শেয়ারধারী প্রতিনিধি ও স্বতন্ত্র পরিচালক থাকলে ব্যাংকের জন্য ভালো হবে। স্বতন্ত্র পরিচালকদের মতো মনোনীত পরিচালকদের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিলে তাঁরা ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন।

নমুনা হলেও কাজ করে দেখাতে হবে, যাতে পরবর্তী সরকার এসে বলতে না পারে ব্যাংক খাতের পাচার করা অর্থ ফেরানো সম্ভব নয়।মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি

ব্যাংকে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব উল্লেখ করে মোহাম্মদ আলী বলেন, আমানত, ঋণ, আমদানি, রপ্তানিসহ সব ধরনের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানলে ভালো হয়। কোন গ্রুপ কত টাকা ঋণ পাচ্ছে, কী ধরনের পণ্য আমদানির জন্য কত ঋণপত্র খোলা হয়েছে, তা তাৎক্ষণিক জানতে পারলে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। ফলে জেনেশুনে কেউ কোনো প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত অর্থায়ন করবে না। আবার এটা জানতে পারলে চাহিদার বেশি পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘এখন পালিয়ে যাওয়া কেউ বিদেশে থেকে হিসাব খুলে যেকোনো ধরনের লেনদেন করলে আমাদের ধরার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, কারা অপরাধী, আমাদের কাছে কোনো তথ্যভান্ডার নেই।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থনীতি অনেক দিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। তবে এত মাত্রায় চ্যালেঞ্জ কম এসেছে। ভবিষ্যৎ যেন অতীতের মতো না হয়, এ জন্য ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতন হয়েছে। এখন প্রত্যাশার চাপ আছে। অর্থনীতির পুঞ্জীভূত চাপের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নানা প্রভাবও রয়েছে অর্থনীতিতে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় চাপ মূল্যস্ফীতির। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে জানলাম, তাদের পরীক্ষা অর্ধেকে নেমে এসেছে। কারণ, মানুষ আগে খাদ্যের চাহিদা মেটাবে, এরপর স্বাস্থ্যের খরচ নির্বাহ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সুদহার বাড়ায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কম বাড়ছে। তবে এখনো অনেক বেশি। মূল সমস্যা, বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে না।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘বড় সমস্যা ব্যাংক খাত ও রাজস্ব আদায় নিয়ে। প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব ঘাটতি সামাল দিতে হবে, পরোক্ষ কর দিয়ে হবে না। জনগণ ব্যাংক খাতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চায়। ব্যাংক খাতের এত অনিয়মের সুবিধাভোগী বের করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। নমুনা হলেও কাজ করে দেখাতে হবে, যাতে পরবর্তী সরকার এসে বলতে না পারে ব্যাংক খাত থেকে পাচার করা অর্থ ফেরানো সম্ভব নয়। আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ কোনো চ্যালেঞ্জ না, এটা সুযোগ। এখন সুশাসন, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা নিশ্চিতের ভালো সময়। এটা কাজে লাগাতে হবে।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতিতে এত সমস্যা কোনো দেশে কখনো হয়নি। এসব সমস্যা এক বছরে সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকতে হবে। অর্থনীতির বহিঃখাতে বড় সমস্যা তৈরি হয়েছিল। চলতি ও আর্থিক হিসাব দুটোই ইতিবাচক হয়ে এসেছে। বিদেশি ঋণ না আসার পরও রিজার্ভ বাড়ছে। প্রবাসী আয় বাড়ছে। কারণ, অর্থ পাচার কমে এসেছে। এখন ব্যাংকে ও খোলাবাজারে ডলারের দাম কাছাকাছি চলে এসেছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দুবাইয়ে খুব বেশি প্রবাসী না থাকার পরও সেখান থেকে সবচেয়ে বেশি আয় আসছে। কারণ, দুবাইয়ের কিছু প্রতিষ্ঠান অন্য দেশ থেকে ডলার কিনে বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা করছে। আমরা তাতে সমর্থন দিচ্ছি না।’

গভর্নর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসতে ৫-১১ মাস সময় লাগবে। আরও ৬ মাস সময় লাগতে পারে। নীতি ঠিক থাকলে তা কাজে দেয়, এটা বোঝা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়ানো ও সরকারের ঋণ কম হলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে। আমরা কঠিন সময় পার করে এসেছি, সঠিক পথে এগোচ্ছি।’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এক ব্যাংক থেকে একটি পরিবার ৮৭ শতাংশ অর্থ নিয়ে গেছে। ওই ব্যাংকের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা জানি না। আমরা ব্যাংক রেজল্যুশন আইন করছি। যেখানে ব্যাংক নিয়ে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকবে। সব আমানতকারী ব্যাংক থেকে শতভাগ টাকা ফেরত পাবেন। ইস্টার্ণ, পূবালী ও সিটি ব্যাংক যেমন সমস্যায় পড়া ব্যাংক থেকে উঠে এসেছে, এসব ব্যাংকও সেভাবে উঠে আসবে। ব্যাংক খাতে আস্থাই সবচেয়ে বড় শক্তি। এটি ধরে রাখতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ ব্যাংককে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হবে জানিয়ে গভর্নর বলেন, ‘এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা থেকে নির্দেশনা পেয়েছি। আমাদের সমস্যা হলো সক্ষম জনবলের ঘাটতি আছে। আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হবে আর্থিক খাত প্রতিপালন, তদারকি ও বাস্তবায়ন করা। প্রতিষ্ঠানটি হবে স্বাধীন, সরকার দ্বারা অবদমিত হবে না।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আহস ন এইচ মনস র ম স ত ফ জ র রহম ন পরবর ত আম দ র র বল ন ধরন র সমস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন এম এন লারমা

মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমাই দেশে প্রথম আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি প্রথম দেশে কাঠামোগতভাবে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে স্পষ্ট করেন। একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এন লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।

‘বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬ম জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন কমিটি’ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়।

আলোচনা সভায় লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ১৯৫৫-৬৫ সালের মধ্যে তৈরি হওয়া ‘বাইনারি বিভাজন’ পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশে সরকার। ‘বাইনারি’ মনস্তত্ত্বকে এখনো এই দেশে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এম এন লারমা ‘বাঙালি হেজিমনি’র বিরুদ্ধে আত্মপরিচয়ের বয়ান বাঁচিয়ে রাখতে তৎকালে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন।

জেএসএসের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, কাপ্তাই বাঁধ না করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই ছাত্র এম এন লারমার প্রতিবাদী জীবন শুরু হয়। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর যে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে, এম এন লারমা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালেই এসব বিষয় নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন।

দীপায়ন খীসা বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কখনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে সংলাপ করেনি। আমরাও এই দেশের অংশ। তাহলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের কেন কোনো সংলাপে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হলো না?’ তিনি বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদেরও অংশীদারত্ব আছে। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তাদেরই ভুলে গেল এই সরকার।

সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, ‘বাঙালি হয়ে যাও’ কথাটার পেছনে বাঙালি মুসলিমদের জাত্যভিমানের ব্যাপারটি রয়েছে। এম এন লারমা বাংলাদেশের মধ্যে থেকে নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক মেইনথিন প্রমীলা, সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা।

অনুষ্ঠানটি শুরু হয় এম এন লারমাকে সম্মান জানিয়ে কবিতা পাঠের মাধ্যমে। কবিতা পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেই চাকমা ও লাল নিকিম বম। কবিতা আবৃত্তির পর এম এন লারমার জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা, জেএসএসের কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য অনন্ত বিকাশ ধামাই, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনার অতিআগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন টিআইবির
  • আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনার অতি আগ্রহের কারণ কী, প্রশ্ন টিআইবির
  • ডাকসুর ব্যালট পেপারে ২ ভোট নিয়ে যা বলছে নির্বাচন কমিশন
  • নরসিংদীতে ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি স্থগিত
  • দক্ষিণ এশিয়ায় জেন–জি বিপ্লবের পরবর্তী নিশানা কে
  • নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা: দক্ষিণ এশিয়ায় জেন–জি বিপ্লবের পরবর্তী নিশানা কে
  • গাজায় পাগলের মতো বোমা ফেলছে ইসরায়েল
  • ফতুল্লা পুলিশের সহায়তায় আপন ঠিকানায় মানসিক প্রতিবন্ধী নারী
  • দেশে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন এম এন লারমা
  • ফতুল্লায় প্রতারণা করে ১৫ লাখ টাকার রড নিলো প্রতারক চক্র, কুমিল্লায় গ্রেপ্তার ৩