নাটক ও সিনেমার মাধ্যমে ভাষার বিকাশ ঘটে। দর্শকরা নাটক, সিনেমায় যে ধরনের ভাষার ব্যবহার দেখেন, তা-ই নিজেরা চর্চা করতে থাকেন। আগের নাটক-সিনেমাগুলোতে ভাষার ব্যবহার বেশ সংযত হয়েই করা হতো। কারণ, এ মাধ্যমে যে ধরনের ভাষা ব্যবহৃত হবে, সে ধরনের ভাষার প্রচলন ঘটবে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কারণ, এ দুই মাধ্যমই মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তারের অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। বর্তমানে নাটক, সিনেমার বাইরেও ডিজিটালিক অনেক মাধ্যমে চলে এসেছে। সিনেমা-নাটকের বাইরে এ মাধ্যমগুলোও ভাষার বিস্তারে বেশ ভূমিকা রাখছে। এখন কথা হচ্ছে, সেই ভূমিকা কতটা সঠিকভাবে হচ্ছে। নিজেরাই কতটা শুদ্ধ বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। এ কথার উত্তর আসবে, শুদ্ধ ভাষার ব্যবহারে তাদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। যা চলছে সেটি হচ্ছে শুদ্ধ প্রমিত ও আঞ্চলিক, ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দুর মিশেল! ফলে ভয়ংকর এক ভাষা বিকৃতির দিকে হাঁটছে মিডিয়া মাধ্যম।
টিভি ও সিনেমায় ভাষার ব্যবহার
এক সময় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও তাদের শিক্ষকরা টিভিতে নাটক ও সিনেমা দেখে ভাষা চর্চা করার পরামর্শ দিতেন। এখন কি আর সেদিন আছে? টিভি থেকে নাটক এখন বেরিয়ে এসেছে ইউটিউবে, যেখানে নেই কোনো মানদণ্ড। যে ভাষাতেই নাটক বানানো হোক না কেন, প্রকাশ করা যাবে। ভাষা বিকৃত করে সিনেমা বা নাটক প্রকাশ করলেও তা ঠেকানোর সেন্সরশিপ নেই। ফলে পাঁচমিশালি ভাষায় নির্মাণ হচ্ছে নাটক। নাটকের ভাষা এখন ‘গ্যাছে, হইছে, ডাকতেছি, করতেছি, মাইরালা আমারে, কান্দস কেরে, আবার জিগায়, ফাঁপরের মধ্যে আছি, দৌড়ের উপরে আছি, পুরাই পাঙ্খা’ ইত্যাদি ক্রমাগত ব্যবহার হচ্ছে। এসব ভাষা এখন বাচ্চারাও শিখছে। হয়তো জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এমনটা বেশি হচ্ছে। আগেও তো অনেক নাটক ও সিনেমা নির্মিত হয়েছে। অনেকগুলো আবার শুধু জনপ্রিয় নয়, কালজয়ীও হয়েছে। আঞ্চলিক ভাষা কিংবা চটুল সংলাপের কয়টি নাটক কালজয়ী হয়েছে, এমন ইতিহাস নেই। টিভি চ্যানেল বা ইউটিউবের জন্য নির্মিত নাটকের সেন্সর না থাকায় নির্মাতারা কোনো ধরনের বিচার-বিবেচনা ছাড়াই উদ্ভট নাটক বানিয়ে চলেছেন। আসলে এমন ঘরানার দু-একটি নাটক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এখন সবাই এ স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। বিশেষ করে অনলাইনে দর্শকদের টোপ গেলাতেই এমন নাটক নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব নাটকের নির্মাতাদের তালিকায় সব কাতারের নির্মাতাই আছেন। টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রিভিউ বোর্ড থাকায় সেখানে অশ্লীল এবং কুরুচিপূর্ণ অকথ্য গালাগালে সয়লাব নাটক প্রচার সম্ভব না হলেও ভাষাকে বিকৃত করে প্রচার হচ্ছে। আবার ইউটিউবে প্রিভিউ বোর্ড না থাকায় সেখানকার নাটকে প্রায়ই অশ্লীল বাক্য প্রয়োগের ছড়াছড়ি চলছে। একটি সফল প্রযোজনার অর্ধেক সাফল্য নির্ভর করে ভালো স্ক্রিপ্ট ও সংলাপের ওপর। নিম্নমানের সংলাপ যেমন প্রযোজনার মান কমায়, ঠিক তেমনি ভাষার দূষণও ছড়ায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সে দূষণে হচ্ছে আক্রান্ত; যা দিনকে দিন আরও মহামারি আকার ধারণ করছে।
উপস্থাপনাতেও বাংলা ভাষার উদাসীনতা
অনুষ্ঠানের উপস্থাপকদের ভাষার ব্যবহার ও তাদের বলার ধরন আকৃষ্ট করে দর্শকদের। তাদের প্রমিত বাংলার বদলে অন্য ভাষা শ্রোতাদের মন-মগজকে প্রভাবিত করে। সেদিকে এখন ভ্রুক্ষেপ নেই অধিকাংশ উপস্থাপকের। টিভির অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়ও কোনো কোনো গণমাধ্যমের বাংলা ভাষার প্রতি রয়েছে ব্যাপক উন্নাসিকতা। ‘অসাধারণ’ না বলে বলেন, ‘অসাম’, ‘খুব সুন্দর’ না বলে বলেন ‘জোশ’, ‘খুব ভালো’ না বলে বলেন ‘হেব্বি’। তারা অথবা তাদের পেছনের কুশীলবরা ইচ্ছাকৃতভাবে জগাখিচুড়ি বাংলিশ ভাষারীতি তৈরির এবং নতুন প্রজন্মকে বুলি মিশ্রণে প্ররোচিত করায় সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন।
তারা ‘যা হোক’ না বলে বলেন ‘অ্যানি ওয়ে’, ‘প্রসংগত’ না বলে বলেন ‘বাই দি ওয়ে’, ‘চমৎকার’ না বলে বলেন, ‘একসিলেন্ট’। এমনিভাবে তাদের কথায় অবলীলায় স্থান পায় ‘এক্সকিউজ মি’, ‘গুড জব’, ‘টাইম নাই’, ‘সাইড দেন’ ইত্যাদি প্রয়োগ।
ওটিটিতেও লাগামছাড়া ভাষা
করোনা মহামারির মধ্যে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পায় ওটিটি মাধ্যম; যা এখন সিনেমা হল ও টেলিভিশনকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে। কেবল এ মাধ্যমের জন্যই বিগ বাজেটে নির্মিত হচ্ছে সিরিজ, সিনেমা ও ওয়েব ফিল্ম। নেটফ্লিক্স, হটস্টার, অ্যামাজন প্রাইমের আদলে বাংলাদেশেও বেশ কিছু ওটিটি মাধ্যম চালু হয়েছে। যেখানে নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে বাংলা সিনেমা, গান, ওয়েব ফিল্ম ও সিরিজ। প্রশ্ন হচ্ছে এসব কনটেন্টে কতটা মাতৃভাষার যথাযথ ব্যবহার ঘটছে। উত্তর হবে এখানে ভাষার ব্যবহারের দিকটা বিবেচনায় খুব কম। এখানে সাবস্ক্রিবশন বাড়ানোটাই প্রধান উদ্দেশ্য। ফলে কনটেন্ট অশ্লীল শব্দ ও ইংরেজির অধিক ব্যবহারের প্রভাবে মাতৃভাষা প্রবহমানতা হারাচ্ছে।
যুক্ত হয়েছে টিকটক রিলস ও শর্টস
বিশ্বায়ন, আকাশ সংস্কৃতি, ডিজিটালাইজেশনের এ যুগে টিকটক ও ফেসবুক রিলস ও ইউটিউব শর্টস দারুণভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ভাষা বিকৃতির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। এসব প্ল্যাটফর্মে যে ধরনের কনটেন্ট প্রকাশ করা হচ্ছে, তাতে শোনা যায় ‘হ্যালো লিসেনার্স’, ‘হ্যালো ভিউয়ার্স’। তরুণদের মুখে মুখে ‘আবার জিগায়’, ‘খাইলেই দিলখোশ’, ‘এক্সট্রা খাতির’, ‘তোর বেইল নাই’ ইত্যাদি নানান ভাষার ব্যবহার। ফলে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে এ রকম নানা শব্দ ঢুকে বাংলা ভাষাকে দূষিত করছে, বিকৃত করছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন টক ভ ষ র ব যবহ র জনপ র য় উপস থ ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা
রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।
এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”
আরো পড়ুন:
ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত
ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত
উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”
সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”
এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে।
ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।
ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।
ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
ঢাকা/ফিরোজ