কথা ছিল সৌরবিদ্যুৎ চালিত ডাগওয়েল বা পাতকুয়ার সাহায্যে চাষিদের সবজি ও বোরো ক্ষেতে সেচের পানি সরবরাহ করা হবে। কৃষক বিনা খরচে তা পাবেন। কিন্তু মাঠে গিয়ে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। অবকাঠামোর অস্তিত্ব ঠিক থাকলেও অধিকাংশ ডাগওয়েল অকেজো। কোথাও ট্রান্সমিটার নেই আবার কোথাও নেই পানি তোলার পাইপ ও পানির ট্যাঙ্কি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রয়াত সংসদ সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী তাঁর নির্বাচনী এলাকা শেরপুরের নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় ২০১৬-১৭ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্পে প্রায় ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন ২৩টি ড্রাগওয়েল বা পাতকুয়া। উদ্দেশ্য ছিল বিনা খরচে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের সবজি ও বোরো ক্ষেতে সেচ দেওয়া। সৌরবিদ্যুৎ চালিত এসব পাতকুয়ার নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প। আর কৃষি বিভাগ সেচকাজের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে আসছিল। কিন্তু এসব পাতকুয়ায় শুরুতে কিছু পানি উঠলেও বছর যেতেই পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতিটি পাতকুয়ার পানি সুবিধা পাওয়ার জন্য ৪১ সদস্যের কৃষক গ্রুপ করা হয়। গ্রুপের প্রত্যেক সদস্য মাসিক স্বল্প টাকা জমা করেন, যা দিয়ে কুয়ার সমস্যা দেখা দিলে মেরামত করা যায়। কিন্তু পাতকুয়ার পানিতে ৪০ জন তো দূরে থাক দু’জন কৃষকের চাহিদাও মেটানো যাচ্ছে না। টাকা দিয়ে সেচের পানি দিয়ে ফসল করতে হচ্ছে তাদের। মাঠে অবকাঠামো থাকলেও সৌরবিদ্যুৎ চালিত পাতকুয়া কেন অকেজো হয়ে আছে, এর সদুত্তর দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
চাষিদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে তদারকি না করায় এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না করায় সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা গচ্চা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কৃষকও বিনা খরচে সেচসুবিধা পাচ্ছেন না।
নালিতাবাড়ী উপজেলার মানিককুড়া গ্রামের কৃষক নবী হোসেন বলেন, ‘এ পাতকুয়া দিয়ে আমাদের দুই শরিকের জমিতেই পুরোপুরি পানি দেওয়া সম্ভব হয় না। অন্যদের পানি কীভাবে দিব? এই পাতকুয়া পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন পাতকুয়া থেকে ঠিকমতো পানি বের হয় না। তাই কেউ সেচের জন্য আসেও না। ক্ষেতে পানি দিতে না পারলে তো আর মাসিক চাঁদাটা কেউ দিতে চায় না।’ 
একই উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া এলাকার কৃষক হাবিবুল্লাহ, শহিদুল ইসলাম ও বুলবুল আহমেদ জানান, ওই পাতকুয়া দিয়ে এক বছর বেশ ভালোই পানি উঠছে। কিন্তু কিছু দিন থেকে এটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তারা টাকা দিয়ে অন্য সেচপাম্প থেকে পানি নিয়ে চাষাবাদ করছেন। পাতকুয়ার খোঁজ নিতে কেউ আসে না। এতে বিপুল পরিমাণ টাকা লাভের পরিবর্তে লোকসানই হচ্ছে। তবে প্রকল্পটি চালু করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি স্থানীয় চাষিদের।
কথা হয় নকলা উপজেলার রামপুর গ্রামের পাতকুয়া কৃষক সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, এখানে ৪১ জনকে পানি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পানি ঠিকমতো ওঠে না। ক্ষেতে পানি দেওয়া যায় না। তাই কেউ চাঁদাও দেয় না। যে উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। দেখাশোনা বা রক্ষণাবেক্ষণে কেউ না থাকায় এটি ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (ক্ষুদ্র সেচ) শেরপুরের সহকারী প্রকৌশলী শামিমা নাসরিন কণা বলেন, ‘পাতকুয়া সম্পর্কে আমি এখন পর্যন্ত কিছু জানি না। ওই সময় যারা কর্মরত ছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জেনে এ বিষয়ে বলতে পারব।’
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স রব দ য ৎ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।

অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আরো পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।

‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’

তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।

বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।

‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।

‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’

একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।

‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’

জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’

তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’

বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ