তাঁরা হাত উঁচিয়ে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিতে চান, এ জন্য দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া
Published: 12th, March 2025 GMT
আজ বুধবার সকাল ৯টা ৩৯ মিনিটের দিকে হঠাৎ ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (সিএমএম) হাজতখানার প্রধান ফটক খুলে দেন দুজন পুলিশ সদস্য।
হাজতখানার সামনে পাঁচজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে। তাঁদের প্রত্যেকের ডান হাতে লাঠি। তাঁদের পেছনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক।
সালমানের দুই হাত পেছনে। দুই হাতেই পরানো হাতকড়া। পলকেরও দুই হাত পেছনে, দুই হাতেই পরানো হাতকড়া।
পলকের পেছনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সাবেক সংসদ সদস্য সুলাইমান সেলিম ও ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। সুলাইমান ও আতিকের দুই হাত পেছনে, পরানো হাতকড়া।
সুলাইমানের পেছনে সাবেক সিনিয়র সচিব মহিবুল হক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর পেছনে দুই হাত। দুই হাতেই পরানো হাতকড়া।
মহিবুল হকের বাঁ পাশে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলের সাফি মুদ্দাসসির খান জ্যোতি দাঁড়ানো ছিলেন। তাঁরও পেছনে দুই হাত, পরানো হাতকড়া।
সালমান, পলক, আতিকুল, মহিবুলদের মাথায় পুলিশের হেলমেট। হেলমেটের সামনের অংশ গ্লাস দিয়ে ঢাকা। আর প্রত্যেকের বুকে পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।
মাথা নিচু করে সালমান, পলক, আতিকুল, মহিবুলরা আদালত ভবনের নিচতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠেন।
আদালতকক্ষের সামনে নেওয়ার পর তাঁদের প্রত্যেকের মাথা থেকে পুলিশের হেলমেট খুলে নেওয়া হয়। যখন তাঁদের প্রত্যেককে কাঠগড়ায় তোলা হয়, তখন দুই হাত পেছনে নিয়ে যে হাতকড়া পরানো ছিল, তার এক হাতের হাতকড়া পুলিশ খুলে দেয়। তখন সালমান, পলক, আতিকুল, সুলাইমান ও মহিবুলরা মাথা নিচু করে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন।
তখন সকাল ৯টা ৪০ মিনিট। বিচারক এজলাসে আসেননি। দেখা গেল, পলক তাঁর একজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছেন।
আইনজীবীর উদ্দেশে পলক বলেন, ‘আমি এখন জামিনের আশা করি না। কিন্তু আপনি আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রত্যেকটা মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রর হুবহু অনুলিপি তুলবেন।’
এরপর পলক তাঁর আইনজীবীকে একের পর এক পরামর্শ দিতে থাকেন। পলকের বাঁ পাশে দাঁড়ানো আতিকুল ইসলামও তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছিলেন।
আর সালমান এফ রহমান কাঠগড়ায় যাওয়ার পর থেকেই তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে মামলা–সংক্রান্ত বিষয়সহ নানা বিষয়ে কথা বলতে থাকেন। এর মধ্যে একজন কর্মকর্তা বলে ওঠেন, ‘স্যার (বিচারক) আসছেন।’
এজলাসে বিচারক আসার পর পুলিশের পক্ষ থেকে সালমান এফ রহমান ও আতিকুলের নাম ধরে ডাকা হয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সালমান ও আতিকুলের বিরুদ্ধে ভাটারা থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়েছে। তখন আদালত তাঁদের এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন।
অপলক দৃষ্টিতে পলককাঠগড়ায় দাঁড়ানো পলকের বাঁ হাতে পরানো হাতকড়া। ডান হাত কাঠগড়ার রেলিংয়ের ওপরে রাখা। তাঁর পরনে নীল রঙের টি–শার্ট আর কালো প্যান্ট। বিচারকের দিকে এক দৃষ্টিতে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকেন পলক।
তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা রিয়াজ হত্যা মামলায় পলককে সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।
রিমান্ডের স্বপক্ষে আদালতে যুক্তি তুলে ধরতে শুরু করেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী।
আদালতকে ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের অবৈধ প্রতিমন্ত্রী পলক জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগ নারী শিক্ষার্থীসহ অন্যদের বেধড়ক পিটিয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছিল। আন্দোলনের সময় ধানমন্ডি এলাকায় রিয়াজকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী হলেন পলক।
রাষ্ট্রপক্ষের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন পলকের আইনজীবী। তাঁর আইনজীবী আদালতকে বলেন, সম্প্রতি একটানা পলকের ১২ দিন রিমান্ড কার্যকর করা হয়েছে। এর আগেও তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।
আদালত শুনানি নিয়ে পলকের তিন দিনের রিমান্ডের করেন। শুনানি চলাকালে পলক বিচারকের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন।
সুলাইমান ও সাফির কথোপকথনসাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলের সাফি আজ শুরুর দিকে কাঠগড়ায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে অন্য আসামিদের শুনানির সময় কাঠগড়ায় সাফি ও সুলাইমান নিজেদের মধ্যে বেশ কয়েকবার কথা বলেন।
রামপুরা থানায় দায়ের করে একটি হত্যা মামলায় সাফিকে রিমান্ডে নেওয়ার বিষয় যুক্তি তুলে ধরেন পিপি ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি আদালতকে বলেন, এই আসামি চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। তিনি পুলিশে নিয়োগ–বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। তাঁরা পিতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি একটি গ্যাং তৈরি করেছিলেন।
তবে এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য রাখেন সাফির আইনজীবী। তিনি আদালতকে বলেন, তাঁর মক্কেলকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য একের পর এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। তাঁর পিতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। পিতার দায় সন্তানের ওপর চাপানো হচ্ছে।
উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত সাফির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর তিনি নির্বাক ছিলেন।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আতিকুল ও মহিবুলসাবেক সিনিয়র সচিব মো.
দুজন কিছুক্ষণ নিজেদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মহিবুলকে তেজগাঁও থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। অপর দিকে আতিকুল ও সালমানকে ভাটারা থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গ্রেপ্তার দেখানোর শুনানি শেষ হলে বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন।
তখন পুলিশ আবার কাঠগড়ায় সালমান, পলক, মহিবুল, সুলাইমান ও সাফির হাত দুখানা পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। আবার তাঁদের মাথায় পরানো হয় হেলমেট। মুখের সামনে অংশ ঢেকে দেওয়া হয় গ্লাসে।
সালমান, আতিকুল, মহিবুলদের আদালত ভবনের দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে হাজতখানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ ২৭ জন মন্ত্রী গ্রেপ্তার হন। তাঁরা কারাগারে আছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন হাসিনা সরকারের ৬ জন প্রতিমন্ত্রী ও ৩ জন উপমন্ত্রী। হাসিনার ৩ উপদেষ্টাও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর বাইরে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন সাবেক ৪৩ জন সংসদ সদস্য ও সাবেক ১১ জন আমলা।
গত ৫ আগস্টের পর আনিসুল, সালমানসহ সাবেক অন্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, মেয়রদের এক হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হতো। তবে গত দুই সপ্তাহ ধরে আনিসুল, সালমানসহ বেশ কয়েকজনকে দুই হাত পেছনে নিয়ে উভয় হাতে হাতকড়া পরিয়ে হাজতখানা থেকে আদালতে তোলা হয়েছে।
আজও সালমান, পলকদের দুই হাত পেছনে নিয়ে উভয় হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা প্রসঙ্গে পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, ‘ইদানীং সালমান, আনিসুলসহ বেশ কয়েকজন আসামিকে দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলার বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। মূলত বেশ কয়েকজন আসামি হাজতখানা থেকে আদালতে তোলার সময় হাত উঁচু করে চিৎকার করে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিতে চান। তাঁরা যাতে হাত উঁচু করে এ ধরনের কথাবার্তা না বলতে পারেন, সে জন্য তাঁদের হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হচ্ছে।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ওমর ফ র ক ফ র ক আইনজ ব র র আইনজ ব ন র সময় ক ঠগড় য় হ জতখ ন র স মন সদস য পলক র হ তকড় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’
বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’
শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ
অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।
দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’
এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’
মামলার পূর্বাপর
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।