বুধবার রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলের সংবাদ সম্মেলন রুম লোকেলোকারণ্য। উপলক্ষ যে হামজা দেওয়ান চৌধুরীকে একনজর দেখা এবং তাঁর কথা শোনা। অনেকের সেলফি তোলার আবদার সুন্দরভাবে গ্রহণ করেছেন শেফিল্ড ইউনাইটেডের এ তারকা। ব্যক্তির মতো কথায়ও বেশ বিনয়ী হামজা মন খুলে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো সমকাল পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন : গত কয়েক দিন আপনাকে নিয়ে ফুটবলে দারুণ উন্মাদনা। ভারতের বিপক্ষে জিতলে সবাই বাহবা দেবে, হারলে সমালোচনা হবে– এই ক্ষেত্রে কোনো চাপ অনুভব করছেন কিনা?
হামজা : না, আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, দিনশেষে আমরা একটা ফুটবল ম্যাচই খেলছি। সেখানে যে কোনো কিছুই হতে পারে। কোচ বলেছেন, ইতোমধ্যে তিনি প্রস্তুতি নিয়েছেন। আমি এখানে এসেছি, আমি যা পারি, তা দলে যুক্ত করার জন্য। আমি কোনো চাপ অনুভব করছি না, আমি অনেক ভালোবাসা অনুভব করছি। আমার দিক থেকে চেষ্টা করব যতটা সম্ভব দলের উন্নতিতে সহায়তা করার।
প্রশ্ন : হামজা চৌধুরী নিজের কাছে কতটা প্রত্যাশা করে?
হামজা : আমার নিজের কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই। আমি খুব আশাবাদী ও উচ্ছ্বসিত। কয়েক সপ্তাহ ধরে কোচ এটা নিয়ে কথা বলেছেন, অনেক ভিডিও ক্লিপ দেখিয়েছেন, দলের ট্যাকটিক্যাল দিক এবং দল যেভাবে আক্রমণ করে, তা দেখে বিস্মিত হয়েছি। আমি আশা করছি, দলে আমি কিছু যোগ করতে পারব। আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। আমি ভিন্ন একটা লিগ থেকে এসেছি, ভিন্ন ঘরানার ফুটবল খেলি। এই ছেলেরা, যেমন জামাল আছে, সে দলের অধিনায়ক, আন্তর্জাতিক ফুটবলে অনেক বেশি অভিজ্ঞ, এখানে অনেক দিন ধরে আছে। আমি এখানে তাদের কাছ থেকেও শিখতে পারব। যেটা বলছিলাম, ইনশাআল্লাহ আমরা সফল হবো। আর আমরা একসঙ্গে একটা পদক্ষেপ ফেলতে চাই।
প্রশ্ন : লেস্টার সিটিতে সাফল্য আর বাংলাদেশের ফুটবলে অভিষেকের গল্পটা কি একই কিনা?
হামজা : হ্যাঁ, অনেকটাই (লেস্টার সিটি ও বাংলাদেশের মিল)। অবশ্যই, যখন সময় আসবে, আমি আমার অভিজ্ঞতা এবং গল্প ভাগাভাগি করব। যেটা বলছিলাম, লেস্টারের গল্প অন্যরকম। তবে একটা জাতি হিসেবে আমরাও দারুণ, আমাদেরও সম্ভাবনা আছে, আমরাও কিছু অর্জন করতে পারি। এ জন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করতে হবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশের হয়ে অনেক বছর খেলব আমি। অবশ্যই এই গল্পে অনেক মিল রয়েছে।
প্রশ্ন : যদি ইংল্যান্ড দলে খেলার সুযোগ পেতেন, তাহলে বাংলাদেশে কি ফিরতেন?
হামজা : হ্যাঁ, আমি সব সময়ই বাংলাদেশের হয়ে খেলার কথা ভেবেছি। এ নিয়ে আমি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে (ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সুযোগ পেলেও বাংলাদেশের হয়ে খেলতাম কিনা) এই সিদ্ধান্ত আমার নিতে হয়নি। আমার যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এলো, তখন পরিবারের সঙ্গে কথা বললাম, তারা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারাই বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য আমাকে এখানে টেনে নিয়ে এলো (হাসি)।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে খেলার জন্য কারা আপনাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। সেই প্রক্রিয়াটা কীভাবে হয়েছে?
হামজা : কয়েক বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছিল। সর্বশেষ নতুন প্রেসিডেন্ট তাবিথ আউয়াল নতুন করে আলোচনা করেন। পরিকল্পনা জানান। কোচের সঙ্গে কথা হয়। আমার মনে হয়েছে, এই দলটা সাফল্য পেতে চায় দারুণ একটা সংগঠন নিয়ে। আমারও পরিবার নিয়ে এখানে আসতে খুব ভালো লাগে। কোচ ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার পর আত্মবিশ্বাস পাই।
প্রশ্ন : ভারত মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলছে। আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশেরও এমন একটা ম্যাচ খেলার প্রয়োজন ছিল?
হামজা : (প্রস্তুতি ম্যাচ না খেলা নিয়ে) আমি মনে করি, কোচ ও সভাপতিই সবচেয়ে ভালো জানেন। তাদের সিদ্ধান্তগুলো হয় দলের সবচেয়ে ভালোর জন্যই। আপনি যেমন বললেন, উন্মাদনা ছিল। পর্দার আড়ালে দল কঠোর পরিশ্রম করছে। তাই এটা হয়তো ভালো হয়েছে, আমি স্পটলাইট ওদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছি। তারা কতটা পরিশ্রম করছে এবং কতটা ভালো করছে, সেটা ২৫ তারিখেই আপনারা দেখবেন।
প্রশ্ন : কোচ আপনাকে ভিডিও ক্লিপস পাঠিয়েছেন, তা দেখে আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসী?
হামজা : আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী। তিনি আমাকে অনেক ক্লিপস দেখিয়েছেন। দল কী করছে, কীভাবে খেলছে, অনুশীলন করছে। আমি খেলতে মুখিয়ে আছি। আশা করছি দলকে সহায়তা করতে পারব।
প্রশ্ন : বাংলাদেশি হওয়ার পর কতটা অভিনন্দন পেয়েছেন?
হামজা : সব জায়গা থেকেই অভিনন্দন পেয়েছি। লিস্টার সিটি থেকে শুরু করে শেফিল্ড ইউনাইটেডের সতীর্থরা আমাকে অভিবাদন জানিয়েছেন। তারা সবাই ইতিবাচক মেসেজ দিয়েছে। আমার পরিবার আমাকে নিয়ে গর্বিত। বাড়িতে হাজার হাজার মানুষ এসে আমাকে দেখেছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল দ শ র হয় পর ব র র জন য ফ টবল
এছাড়াও পড়ুন:
লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা
লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।
আরো পড়ুন:
আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র
মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা
চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।
শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।
তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।
তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।
ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।
রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।
“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”
“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”
“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”
টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”
“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।”
সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।
ঢাকা/আমিনুল